শুধু ২০২৩ নয়। যে কোনও বছরেই ভারতীয় অর্থনীতিকে যে তিনটি বিষয় উদ্বেগে রাখে- তা হল জিডিপি বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি (পড়ুন মুদ্রাস্ফীতি), এবং বেকারত্ব। এই সব ব্যাপারে ২০২৩ শুরু থেকেই ছিল নড়বড়ে। ২০২২ সালের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি। ২০২৩ শুরু হওয়ার সময়, মুদ্রাস্ফীতি কমতে শুরু করে। তারপরও উদ্বেগটা ছিলই। কারণ, ধনী দেশগুলোয় দ্রব্যমূল্য বেড়েছিল। যার অর্থ ছিল, সেদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের জন্য ভারতীয় ভোক্তাদের অতিরিক্ত খরচ।
নিজস্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি
খাদ্য এবং জ্বালানির দাম কমানো সম্ভব হলেও, নজরটা বারবার চলে গিয়েছে সুদের হার এবং বেকারত্বের দিকে। তার মধ্যে আবার আন্তর্জাতিক অর্থনীতির মেজাজ ছিল খারাপ। কারণ, বারবার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগই মন্দায় ডুবে যাবে। ভারত, মন্দা পরিস্থিতির থেকে দূরে থাকলেও বিভিন্ন নিজস্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। কারণ, ভারতীয় ভোক্তাদের ব্যক্তিগত খরচ বৃদ্ধি। এই ব্যক্তিগত খরচ, ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় ইঞ্জিন (বার্ষিক প্রায় ৫৫% থেকে ৬০% অবদান) রাখে। আগের তিন বছরেও ভারতীয় ভোক্তাদের ব্যক্তিগত খরচ বেড়েছে। বিনিয়োগ ব্যয় বা উৎপাদনশীল ক্ষমতা তৈরির জন্য ব্যয় করা অর্থ, ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির দ্বিতীয় বৃহত্তম ইঞ্জিন। সেটা কিছুটা বাড়লেও, বেশিটাই ছিল পুরোনো বিনিয়োগের বদলে সেই জায়গায় বিনিয়োগ। অর্থাৎ, অতিরিক্ত বিনিয়োগ নয়। সরকারি ব্যয়, যা ভারতের ডিজিপি বৃদ্ধির তৃতীয় ইঞ্জিন, খুব বেশি বাড়েনি।
বেকারত্বের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক
বেকারত্বের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা ছিল উদ্বেগজনক। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)-এর প্রকাশিত ডেটা অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে ভারতে মোট কর্মরত লোকের সংখ্যা ২০১৬-এর শুরুতে মোট নিযুক্ত লোকের সংখ্যার চেয়ে কম ছিল। শুধু তাই নয়, ২০২৩ সালের প্রাথমিক মাসগুলোয়, ভারতীয় স্টক মার্কেটগুলো বিশ্বের স্টক মার্কেটগুলোর চেয়ে পিছিয়ে ছিল। এটা কিন্তু আদানি গ্রুপ অফ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টের জন্য হয়নি। বাজারের হিসেবে বলা যায়, সাধারণ ভোক্তাদের মনোভাবটাই ছিল নেতিবাচক।
একটি অত্যাশ্চর্য শেষ
এতকিছুর পরও ভারতীয় অর্থনীতি ২০২৩-এ রীতিমতো সাফল্য অর্জন করেছে। যা ভারতীয় অর্থনীতির সাফল্যের ক্ষেত্রে হ্যাটট্রিক বলেই মনে করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমিক শ্রম বাহিনী সমীক্ষা (পিএলএফএস) অনুযায়ী, ভারত কেবল বেকারত্বের হার কমাতেই সক্ষম হয়নি। দেশের কর্মশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণও বেড়েছে। ভারতের জিডিপি কমার পরিবর্তে বেড়েছে। আরবিআইকে তাড়াহুড়ো করে ভারতের জিডিপির অনুমানগুলোকে সংশোধন করতে হয়নি। মুদ্রাস্ফীতিও ইতিমধ্যে কমফোর্ট জোনের মধ্যে এসেছে। মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার সময়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন যে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন, তখন ভারত ছিল বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম অর্থনীতি। আট বছর পরে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। মোদী বলেছেন, শীঘ্রই ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন- তাকলাগানো প্রযুক্তি-অস্ত্র, ভারতের সমুদ্রজয়ে মোতায়েন ‘INS ইম্ফল’, কতটা ক্ষমতা এই জাহাজের?
তারপরও উদ্বেগ
মোদী সরকারের প্রথম ৯ বছরে ভারতীয় অর্থনীতির বিশ্লেষণ দেখায় যে ইউপিএর ১০ বছরের তুলনায় গড় ভারতীয়দের আয় বৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। গড় ভারতীয়রা তো বটেই, অতি ধনীরাও দল বেঁধে ভারত ছাড়ছেন। বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই। ব্যাংক অফ বরোদার জুলাইয়ের রিপোর্ট, এই ব্যাপারে উদ্বেগজনক ফলাফল তুলে ধরেছে। সেই রিপোর্ট বলছে যে, ব্যক্তিগত বিনিয়োগও কমছে। একমাত্র বিভাগ যেখানে ভারতীয় উদ্যোক্তা বাড়ছে তা হল 'স্ব-কর্মসংস্থান'। যেমন, ট্যাক্সি ড্রাইভার, জ্যোতিষী ইত্যাদির মতো কাজ। এই ছবিটা, ভারতের বৃহত্তর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির খারাপ চিত্রকেই প্রতিফলিত করেছে। শুধু তাই নয়। সরকারি থেকে বেসরকারি চাকরির স্থায়িত্ব, চুক্তি ইত্যাদির মানেরও অবনমন ঘটেছে।