Advertisment

গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে কী বলা হয়েছে নানাবতী কমিশনের রিপোর্টে?

এ ধরনের ঘটনার সময়ে সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের ব্যাপারে বিধিনিষেধ লাগু করা হোক, কমিশনের একটি অন্যতম প্রস্তাব।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Gujarat Riot 2002, Nanavati Commission

কমিশন মনে করছে দাঙ্গা ঘিরে কোনও ষড়যন্ত্র হয়নি, যা হয়েছে তা মূলত ছিল গোধরা ট্রেন পোড়ানোর ঘটনার উদ্ভূত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ

বুধবার গুজরাট সরকার বিধানসভায় নানাবতী কমিশনের রিপোর্ট পেশ করেছে। ২০০২ সালে সবরমতী এক্সপ্রেসে আগুন এবং তার পরবর্তী দাঙ্গার তদন্তের জন্য এই কমিশন নিয়োগ করা হয়। কমিশন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, পুলিশ, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলকে ক্লিন চিট দিয়েছে।

Advertisment

নানাবতী কমিশন কী?

২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরা স্টেশনের কাছে সবরমতী এক্সপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মারা যান ৫৯ জন। ২০০২ সালেই এই কমিশন নিয়োগ করা হয়। প্রাথমিক ভাবে কেজি শাহের নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চের কমিশন তৈরি হলেও, পরে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জিটি নানাবতীর নেতৃত্বে এই কমিটির কলেবর বৃদ্ধি করা হয়। ২০০৮ সালে কেজি শাহ মারা যান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন বিচারপতি অক্ষয় মেহতা। আমেদাবাদের নারোদা হিংসার মূল অভিযুক্ত বাবু বজরঙ্গি যখন জামিন পায়, তখন সে মামলার বিচারপতি ছিলেন অক্ষয় মেহতা।

আরও পড়ুন, নরেন্দ্র মোদী প্রমাণ লোপাট করেননি, বলল কমিশন

এই কমিশন সবরমতী এক্সপ্রেসের ঘটনা এবং রাজ্যে তৎপরবর্তী হিংসা, যাতে ১২০০ জনের মৃত্যু ঘটেছিল (সবরমতী এক্সপ্রেসের ৫৯জন সহ), তার তদন্ত করে। তদন্ত করা হয় এই বিশৃঙ্খলা রোধে প্রশাসনিক পদক্ষেপে কোনও কমতি ছিল কিনা তারও। গোধরা ট্রেনে আগুনের ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল কিনা, সে ব্যাপারে আগাম খবর ছিল কিনা, এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, কমিশনের এক্তিয়ারে ছিল এসব কিছুও।

Gujarat Riot 2002, Nanavati Commisiion ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হবার কয়েক মাস পর গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন প্যাটেলের কাছে রিপোর্ট জমা পড়ে

২০০৪ সালে কমিশনের এক্তিয়ার বৃদ্ধি করা হয়। মোদী এবং অথবা তাঁর মন্ত্রী, পুলিশ অফিসার, অন্যান্য ব্যক্তি ও সংগঠনের ভূমিকা খতিয়ে দেখার বিষয়টিও তদন্তের আওতাধীন করা হয়। কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় ২৪ বার। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালে কমিশন তার চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয়।

রিপোর্ট পেশ করতে পাঁচ বছর লেগে গেল কেন?

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হবার কয়েক মাস পর গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন প্যাটেলের কাছে রিপোর্ট জমা পড়ে। স্বরাষ্ট্রদফতরের প্রতিমন্ত্রী প্রদীপসিং জাদেজা রিপোর্ট পেশ করতে কেন পাঁচ বছর লাগল, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "রিপোর্টটি বিশালকায় ছিল এবং জনগণের সামনে আনার আগে এর প্রতিটি বিষয় খুঁটিয়ে দেখবার প্রয়োজন ছিল।"

অবসরপ্রাপ্ত ডিজিপি আর বি শ্রীকুমার, যিনি কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তিনি এই রিপোর্ট পেশ করবার জন্য গুজরাট হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। গুজরাট সরকার সেপ্টেম্বর মাসে আদালতে জানায় আসন্ন (বর্তমানে চালু) বিধানসভায় তারা বিল পেশ করবে।

আরও পড়ুন, আমেরিকায় অমিত শাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চায় কারা?

চূড়ান্ত রিপোর্টে কী বলা আছে?

প্রথম রিপোর্ট ছিল এক খণ্ডের। সেখানে কেবলমাত্র ট্রেনে আগুনের ঘটনার তদন্ত করা হয়েছিল। এই বিল ২০০৮ সালে বিধানসভায় পেশ করা হয়। সেখানেও মোদীকে ক্লিন চিট দেওয়া হয়, ক্লিন চিট দেওয়া হয় মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য এবং পুলিশ অফিসারদের। সেখানে বলা হয় ট্রেন পোড়ানোর ঘটনা "পূর্ব পরিকল্পিত" ছিল এবং "কামরায় যেসব করসেবকরা ছিলেন, তাঁদের ক্ষতি করবার উদ্দেশ্যেই" এই ঘটনা ঘটানো হয়।

চূড়ান্ত রিপোর্টে কী কী ছিল?

চূড়ান্ত রিপোর্ট ৯ খণ্ডের, ২৫০০ পৃষ্ঠার। মোদী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের ফের একবার ক্লিন চিট দেওয়া হয়েছে এই রিপোর্টে। কমিশন তিন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার, অবসরপ্রাপ্ত ডিজিপি শ্রীকুমার, রাহুল শর্মা এবং সঞ্জীব ভাটের দেওয়া প্রমাণ নাকচ করে দিয়েছে। এই তিন প্রাক্তন পুলিশকর্তার অভিযোগ ছিল সরকার ও তার কার্যনির্বাহীদের একাংশ এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার ছিল। কমিশন প্রাক্তন মন্ত্রী প্রয়াত হরেন পাণ্ডিয়া, অশোক ভাট এবং ভারত বারোটকেও ক্লিন চিট দিয়েছে।

কমিশন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী গোরধন জাডাফিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া প্রমাণকে ভুয়ো বলে আখ্যা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী জাদেজা বলেছেন সরকার এই তিন প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকের বিরুদ্ধে বিভাগীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করবে।

এই রিপোর্টে উত্তর, দক্ষিণ, মধ্য গুজরাট, সৌরাষ্ট্র এবং কচ্ছ অঞ্চলের জন্য পৃথক পৃথক খণ্ড রয়েছে। ভদোদরা শহরের জন্য একটি আমেদাবাদ শহর ও জেলার জন্য দুটি খণ্ড রয়েছে। এই শহরাঞ্চলের বেস্ট বেকারি, নারোদা পাতিয়া, নারোদা গাম ও গুলবর্গা সোসাইটিতে সবচেয়ে বেশি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে যে ৯টি মামলার তদন্ত এবং বিচার হয়, সেগুলি ঘটেছিল এখানেই।

আরও পড়ুন, কেন ক্যাব প্রসঙ্গে বারবার উঠছে নেহরু-লিয়াকত চুক্তির কথা?

 তদন্ত থেকে মূল কী কী বিষয় বেরিয়ে এসেছে?

কমিশন মনে করছে দাঙ্গা ঘিরে কোনও ষড়যন্ত্র হয়নি, যা হয়েছে তা মূলত ছিল গোধরা ট্রেন পোড়ানোর ঘটনার উদ্ভূত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। তিস্তা শেতলবাদ পরিচালিত সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস এবং প্রয়াত মুকুল সিনহা পরিচালিত জনসংঘ মঞ্চ, যাা সরকারি আধিকারিক ও রাজনৈতিক নেতাদের জেরা করেছিল তাদের দেওয়া তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখেছে কমিশন।

মোদী সম্পর্কে কমিশনের রায় কী?

মোদীকে উদ্ধৃত করেছে কমিশন। তাঁকে "২৭.০২.২০০২-এ ঘটনার শুরু থেকে ২৮.০২.২০০২ পর্যন্ত সমস্ত কিছু বিভিন্ন দফতরের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা জানাতে থেকেছেন। বিভিন্ন বিভাগের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা গোধরা ট্রেন জ্বালানোর ঘটনার পর হঠাথ যে হিংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা নিয়ন্ত্রণে আনবার জন্য পদক্ষেপের কথাও জানাতে থেকেছেন। জানানো হয়েছে আধা সেনা এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করা এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য দেবার কথাও।"

মন্ত্রী, পুলিশ ও বিভিন্ন সংগঠন সম্পর্কে কী বলেছে কমিশন?

রিপোর্টের শেষে বলা হয়েছে, "মুসলিমদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় বিজেপি, ভিএইচপি বা অন্য কোনও রাজনৈতিক দল বা নেতা বা কোনও ধর্মীয় সংগঠন বা তার নেতাদের জড়িত থাকার কোনও ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেবলমাত্র দুটি ঘটনায় ভিএইচপির সদস্যদের যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে... মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনা গোধরাকাণ্ডের পর মানুষের ক্রোধের কারণেই হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে... এ ধরনের ঘটনায় সমাজবিরোধীরাই অংশগ্রহণ করেছে।"

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: পুলিশের মেরে ফেলার অধিকার

বেশ কিছু হলফনামায় বলা হয়েছে পুলিশ হিংসা ঠেকাতে তৎপরতার সঙ্গে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছে, যার জেরে প্রাণ ও সম্পত্তি রক্ষা পেয়েছে। কমিশন বলেছে জেলায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় কোনও রকম অবহেলা করেছে বা নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রাজ্য সরকারের কোনও মন্ত্রী এ ধরনের ঘটনায় যুক্ত বলে বা কোনও পুলিশি কাজকর্মে কোনও মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রমাণও পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে কমিশন।

কমিশনের মূল সুপারিশ কী?

এ ধরনের ঘটনার সময়ে সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের ব্যাপারে বিধিনিষেধ লাগু করা হোক, কমিশনের একটি অন্যতম প্রস্তাব। কমিশন এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমকে দায়ী করে একাধিক সাক্ষ্যের উল্লেখ করেছে। "গোধরাকাণ্ডের এবং তৎপরবর্তী ঘটনাসমূহের ব্যাপক প্রচারের ফলে মানুষ উত্তেজিত হয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছেন।" সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অন্যতম কারণ হিসেবে "হিন্দু মুসলিমদের কিছু অংশের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘৃণা"র কথা উল্লেখ করেছে নানাবতী কমিশন। সরকারকে বলা হয়েছে সমাজ থেকে এ ধরনের "দুর্বলতা" অপসারণ করবার জন্য পদক্ষেপ নিতে। হিন্দুরা যে মুসলিমদের সাহায্য করবার জন্য বা সম্ভাব্য হামলার ব্যাপারে সাবধান করার জন্য হেনস্থা হয়েছেন, সে কথা উল্লেখ করেছে কমিশন।

পড়তে ভুলবেন না, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা ক্যাব আসলে কী?

gujarat riots, 2002 gujarat riots report, Nanavati Commission, gujarat riots Nanavati Commission report, Nanavati Commission full report, gujarat riots Nanavati Commission, narendra modi gujarat riots,

gujarat Godhra Riot
Advertisment