দার্জিলিংয়ে গিয়ে গ্লেনারিজে খাননি এমন লোক বোধ হয় হাতে-গোনা। আহা কী অপূর্ব সেই খাদ্যের স্বাদ। আর তেমনই আবহ রেস্তোরাঁর। বাঁধ না মানা ভিড় সেই টানে। টাকাপয়সা যেন ঝড়ের বেগে ক্যাশবাক্সে ঢুকছে। সব মিলিয়ে বেশ চমক লাগে বৈকি! কিন্তু আরও বড় চমকে যাওয়ার ঘটনা হল এই গ্লেনারিজের মালিক নতুন দল খুলে যা করলেন, সেইটা! তিন মাসের পার্টি বাঘাবাঘাদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়ে দার্জিলিং পুরসভা পকেটে পুরে ফেলেছে। অজয় এডওয়ার্ডসের নাম এখন স্বাভাবিক ভাবেই মুখে মুখে ফিরছে। এই ব্যক্তিটিই গ্লেনারিজের মালিক এবং হামরো পার্টির ফার্স্ট পার্সন। আসুন, রকেট-বেগে আকাশে ওঠা দলটির দিকে একটু নিবিড় নজর রাখি।
কে এডওয়ার্ডস
অজয় এডওয়ার্ডস। রাজনীতিতে নব্য কোনও চরিত্র নন। আগে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা জিএনএলএফ করতেন। তাঁরা এবারের নির্বাচন লড়েছেন কোন ইস্যুতে? যেটা পাহাড়ে না করলে এত দিন চলত না, সেই পৃথক গোর্খাল্যান্ডের অস্ত্রে অজয় শান দেননি মোটেই। উন্নয়নের কথা বলেছেন ভোট চাইতে গিয়ে। বলেছেন, দৈনন্দিন জীবনে প্রতি পদে দার্জিলিংয়ের মানুষের যে দুর্ভোগ, তা দূর করবেন তাঁরা। হ্যাঁ, গোর্খাল্যান্ড ছাড়াই ভোটের লড়াইয়ে নেমে যাওয়া, অনেকের মতে অস্ত্র ছাড়াই পাগলের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়া, কিন্তু শেষ হাসি হেসে বুঝিয়ে দিয়েছেন এতদিনের ব্রহ্মাস্ত্র গোর্খাল্যান্ড তামাদি, এবং বিমল গুরুংদের ভার লঘু হয়ে গিয়েছে। আকচা-আকচি অনেক হয়েছে, এবার নতুনকে পথ ছেড়ে দিতে হবে। অজয় এডওয়ার্ডসের দল দার্জিলিংয়ের এই ভোটে পেয়েছে ৩২টি আসনের মধ্যে ১৮টি। যদিও এডওয়ার্ডস নিজে হেরে গিয়েছেন, ২২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে।
অজয় এডওয়ার্ডস কেন জিএনএলএফ ছাড়লেন?
দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে পুরনো বেকারি গ্লেনারিজের মালিক অজয় জিএনএলএফ প্রেসিডেন্ট মন ঘিসিংয়ের বন্ধু ছিলেন। মন হলেন জিএনএলএফের প্রতিষ্ঠাতা সুবাস ঘিসিংয়ের ছেলে। কিন্তু বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার উত্থানকালে এডওয়ার্ডসকে দার্জিলিং ছাড়তে হয়েছিল, বাগডোগরায় গিয়ে থাকতে শুরু করেন। এক-দু' দিন নয়, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাত বছর সেখানে থাকলেন। তার পর ঘরের ছেলে ঘরে ফেরেন। গত বছরের অগস্টে তিনি জিএনএলএফ ত্যাগ করেন। কারণটা সহজ, তাঁর সঙ্গে মনকষাকষি চরমে উঠেছিল মনের।
কেন চরমাবস্থা তৈরি হয়েছিল?
জিএনএলএফ এখন বিজেপির পদ্মের পাঁপড়ি হয়ে গিয়েছে। না না, মিশে যায়নি, বিজেপির সঙ্গী তারা। ১৯-এর বিধানসভা ভোটে অজয় দার্জিলিং আসনে প্রার্থী হতে পারেন, এমন একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। অজয়ও যা মনেপ্রাণে চাইছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁকে হতাশই হতে হয়েছিল, কারণ প্রার্থী করা হয় নীরজ জিম্বাকে। এর পর মতপার্থক্যটা যেন উপরের তলে উঠে এল। এডওয়ার্ডসকে দিল্লিতে পাঠানো হল বিজেপির হেভিওয়েটদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে। কিন্তু দেখা গেল, ওই সময়তেই মন ঘিসিং সদলবল দিল্লি পৌঁছে গিয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। তখনই এডওয়ার্ডস স্থির করে নেন আর নয় এখানে। অগস্টে দার্জিলিং ফিরে আসেন তিনি, পাবলিক উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়, এবং জলটা মেপে ফেলেন অজয়।
হামরো পার্টির জন্ম
বেশ আটঘাঁট বেঁধেই এ পথে এগিয়েছেন অজয় এডওয়ার্ডস। কী নাম হবে দলের, তা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা চলে। পাঁচটি নাম সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সাধারণের উদ্দেশে বলা হয়, আপনারা বাছুন। অনলাইন ভোটিংয়ের মাধ্যমে বাছাবাছির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হামরো নাম স্থির করা হল তা থেকে, হামরো পার্টি মানে আমার দল। যার আত্মপ্রকাশ ঘটে গত বছরের ২৫ নভেম্বর। এবং আত্মপ্রকাশের পরই তাতে যোগদানের জোয়ার আসে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে হামরো কাছে টানতে মাঠে নামে। বুদ্ধিজীবীদের একাংশকেও যোগ দেন অজয়ের দলে। এডওয়ার্ডস বহু দিন ধরেই সমাজসেবার কাজে যুক্ত রয়েছেন। তার দল ১৪০টি রাস্তা তৈরি করেছে দার্জিলিং এবং আশেপাশের গ্রামে। প্যান্ডেমিকের ভরা সময়ে এডওয়ার্ডসের ফাউন্ডেশন বডি ফেলেছিল। ১০০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়েছিল প্রান্তিকে।
কেন উত্থান
মানুষ বিকল্প শক্তির খোঁজ করছিল, সেই শক্তিই হামরো। তাদের উত্থানের কারণ এতটাই সরল। এবার দেখার, পাহাড়ে উন্নয়নে গ্লেনারিজের সুগন্ধটা ছড়িয়ে দিতে পারেন কিনা অজয়? অজয়ের আসল জয় তো হবে সেটাই।
Read story in English