হরিয়ানায় এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছতে পারেনি বিজেপি। বেশ কিছু বিষয় এবারের নির্বাচনে কাজ করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাঁচটির কথা এখানে আলোচিত হল।
হরিয়ানার ফল: যুবকদের কাছে কর্মহীনতা
মনে করা হচ্ছিল বিজেপি রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের ঢেউ এনে অর্থনৈতিক প্রশ্ন মুছে দিতে পেরেছে। হরিয়ানার ফল তার উল্টোটাই প্রমাণ করেছে। হরিয়ানায় জনসংখ্যার মধ্যে ৪০ লক্ষের বয়স ২০-২৯-এর মধ্যে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক কর্মহীনতার সাক্ষী থেকেছেন।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়া নামের এক সংস্থার দেওয়া ২০১৯ সালের মে-অগাস্ট রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বেশি কর্মহীনতা (২৮.৭ শতাংশ) এ রাজ্যে। কয়েক বছর আগে এ সংখ্যাটা ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। এ রাজ্যে মোটামুটি ২০ লক্ষেরও বেশি যুবক-যুবতী বেকার এবং তাঁদের অর্ধেক মাধ্যমিক পাশ বা তার চেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: ৩০৩+৩৭০-এর হিসেব কাজে এল না
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে স্বচ্ছতার বিষয়ে বিজেপি যেখানে জোর দিতে চেয়েছে, সেখানে বিরোধীরা বারবার বেরোজগারির প্রসঙ্গ তুলেছেন। মানেসর-গুরুগ্রাম এলাকার কর্মহীনতাও বিজেপি-কে যে প্রভাবিত করেছে তাতে সন্দেহ নেই।
চাকরির সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হয়েছিল কংগ্রেস এবং জননায়ক জনতা পার্টি (জেজেপি) এবং জেজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা ক্ষমতায় এলে কাজের অধিকার সুনিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়দের জন্য ৭৫ শতাংশ চাকরিও সুনিশ্চিত করবে। হরিয়ানার বহু বাসিন্দাই লোকসভা ভোটে জাতীয়তাবাদের ইস্যুতে ভোট দিলেও বিধানসভা ভোটে স্থানীয় ইস্যুই তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বলেই মনে হচ্ছে।
হরিয়ানার ভোটের ফল: কংগ্রেসের গান্ধীরা আলোয় নেই
এবারের ভোটে কংগ্রেসের হয়ে প্রচারে গান্ধী পরিবার নেতৃত্বদায়ী ভূমিকায় ছিল না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রচার করেছেন ভোটপ্রার্থীরা নিজেরাই, তাঁদের কিছুটা সাহায্য করেছেন রাজ্য কংগ্রেসের পরিষদীয় প্রধান ভুপিন্দর সিং হুড়া এবং প্রদেশ কংগ্রেসের নতুন প্রধান কুমারী সেলিজা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হরিয়ানায় সাতটি সভা করেছেন, রাহুল গান্ধী করেছেন মাত্র দুটি।
২০১৪ সালে মাত্র ১৫টি আসন পাওয়া কংগ্রেস এবার ৩১টি আসন পেয়েছে, যা থেকে বোঝা যাচ্ছে গান্ধীদের তারকা ভাবমূর্তি খুব একটা প্রয়োজনীয় নয়। দুবারের মুখ্যমন্ত্রী হুড়া, যাঁর বিরুদ্ধে মানেসর জমি কেলেঙ্কারির তদন্ত চলছে, সেই তিনিই স্থানীয় ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে নেতা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
আশঙ্কা করা হয়েছিল কংগ্রেসের প্রাক্তন রাজ্য প্রধান অশোক তানওয়ারের পদত্যাগ এবং জেজেপি ও এনএলডি-কে তাঁর সমর্থন দলের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলবে- যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিতরণের জন্য হুডার হাতে ছিল সিংহভাগ টিকিট, এবং কংগ্রেস তাঁর ঘাঁটি রোহতক, সোনিপত এবং ঝাজ্জরে ব্যাপক জয় পেয়েছে। জাঠ বলয়ে ১৫টির মধ্যে ১১টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস এবং বিজেপি পেয়েছে ৩টি আসন। একটি গিয়েছে নির্দলের দখলে।
আরও পড়ুন, গুজরাট উপনির্বাচনে কংগ্রেসের সাফল্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হরিয়ানায় দুষ্যন্ত চৌতালার উত্থান
লোকদল থেকে বিভক্ত হয়ে গঠিত জেজেপি প্রথমবার ভোটে লড়েই ১০টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। চৌধরি দেবীলালের প্রপৌত্র ৩১ বছরের দুষ্যন্ত চৌতালা নতুন নেতা হিসেবে উদিত হয়েছেন। সুবক্তা হিসেবে এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার ব্যাপারে সুপরিচিত দুষ্যন্ত দেখিয়ে দিয়েছেন রাজ্য তরুণ নেতাদের জন্য প্রস্তুত। একদা লোক দলের বহু ভোট দুষ্যন্তের ঘরে আসায় এ কথাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে প্রাচীন নেতাদের উপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে দল। এ ছাড়া দেবীলালের বংশোদ্ভূত হওয়াও তাঁকে বেশ কিছুটা সাহায্য করেছে।
আরেকটি কৌতূহলপ্রদ বিষয় উঠে এসেছে এবারের ফল থেকে। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যরা ভাল ফল করেছেন। কংগ্রেসের কিরণ চৌধরি তাঁর আসন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন, কুলদীপ বিষ্ণোইও তাই। লোকদলের অভয় চৌতালা দলের ভরাডুবির মধ্যে জিতেছেন। ১৯৯৬ সালে হরিয়ানা লোকদলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চৌধরি দেবী লাল, যিনি উপমুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দুবার রাজ্য শাসন করেছেন। হরিয়ানায় লোক দলই একমাত্র জাতীয় দলগুলিকে বেগ দিতে পারত। এমনকি ২০১৪ সালেও তারা জিতেছিল ১৯টি আসন, কংগ্রেসের থেকে চারটি বেশি এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ধাক্কা
মনোহরলাল খট্টরের 'ফের মনো' স্লোগান হরিয়ানভিদের ক্ষেত্রে কাজে লাগেনি। মুখ্যমন্ত্রী খট্টরের 'ম্যায় আনাড়ি নেহি সিয়াসত কা খিলাড়ি হুঁ' স্লোগান তাঁর বিরুদ্ধেই কাজ করেছে, বিরোধীরা তাঁকে উদ্ধত বলে দাগিয়েও দিতে পেরেছে এই শ্লোগানের জেরে। ভোটের আগে জন আশীর্বাদ যাত্রার সময়ে তাঁকে মুকুট পরিয়ে দেওয়া এক ব্যক্তির মাথা কেটে নেওয়ার হুমকি দেওয়ার জেরে খট্টরের বিরুদ্ধে সোশাল মিডিয়ায় আলোড়ন ওঠে। পরে খট্টর নিজের সমর্থনে বলেন, তিনি সমতায় বিশ্বাস করেন বলেই ওই কথা বলেছিলেন।
তাঁর মন্ত্রিসভায় হেভিওয়েটদের পতন ঘটেছে। আটজন মন্ত্রী ও বিজেপির রাজ্য প্রধান হেরে গিয়েছেন, যা থেকে বোঝা যাচ্ছে জনমুখী বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও সরকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ গঠনে সমর্থ হয়নি। আসান্ধের বিজেপি প্রার্থী বকশিস সিং বির্ক যিনি বলেছিলেন যে বোতামেই চাপ দিন ভোট বিজেপি-তে যাবে, তিনি হেরে গিয়েছেন। এ আসনে ২০১৪ সালে জিতেছিলেন তিনি।
তারকা দিয়ে ভোট জেতার কৌশল বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ। ক্রীড়াজগতের তারকা ববিতা ফোগট এবং যোগেশ্বর হেরে গিয়েছেন, টিকটক তারকা সোনালি ফোগট আদমপুর আসন থেকে পরাজিত হয়েছেন। প্রাক্তন হকি অধিনায়ক সন্দীপ সিং, যিনি ভয়ংকর চোট সারিয়ে মাঠে ফিরেছিলেন, তিনি পেহওয়া কেন্দ্র থেকে দিতেছেন কারণ তাঁর মনের জোরের কাহিনি দেশভাগজনিত উদ্বাস্তু অধ্যুষিত ওই কেন্দ্রের মানুষের মনে অনুরণন তুলেছিল।
হরিয়ানায় জাঠ ফ্যাক্টর
বিজেপি জাঠদের আধিপত্যকে অতিক্রম করতে চাইলেও চারটি লোকসভা কেন্দ্রের মোট ৩৬টি বিধানসভায় তারাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। লোকসভা ভোটে বিজেপি অ-জাঠ উচ্চবর্ণীয় ভোট এবং ওবিসি ভোটের ৭০ শতাংশ নিজেদের দখলে রেখেছিল, একই সঙ্গে ৫০ শতাংশ জাঠ ভোটও পেয়েছিল তারা। কিন্তু লোকসভা ভোটে যে জাঠরা জাতীয়তাবাদী ইস্যুতে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের বড় অংশই বিধানসভা ভোটে স্থানীয় ইস্যুতে ভোট দিয়েছেন।
Read the Full Story in English