গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চিন সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ফের একবার উঁচু এলাকার যুদ্ধ কৌশল এবং সেখানে বাহিনীকে যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, বিশেষ করে যখন অপর পক্ষ উচ্চতার সুবিধাজনিত জায়গায় রয়েছে, তার উপর নজর এনে দিয়েছে।
অধিক উচ্চতায় কীভাবে লড়াই হয়?
অধিক উচ্চতার যুদ্ধ কৌশলে মাথায় রাখতে হয় ভূমি ও আবহাওয়া। সেনাকে অধিক উচ্চতায় লড়াই করার জন্য কী পরিকাঠামো ও ট্রেনিং দেওয়া হয়, তা মূল বিষয়। এ ধরনের যুদ্ধের বিবর্তন ঘটেছে প্রাচীন কালে, যখন ইউরোপিয় দেশগুলিতে পার্বত্য ব্রিগেড ছিল। তার কারণ সেখানকার ভূমির অবস্থা। ওই ভূমির রুক্ষতার কথা মাথায় রেথে এ ধরনের সেনাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।
কার্গিল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মহাবীর চক্র খেতাবে সম্মানিত কর্নেল সোনম ওয়াংচুক লেহ অঞ্চলের মানুষ। তিনি বলেন, এই সেনাদের পর্বতারোহণের বেসিক ও অ্যাডভান্সড ট্রেনিং দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন, গালওয়ান উপত্যকা নিজের বলে কেন দাবি করছে ভারত?
ভারত এ ধরনের যুদ্ধের জন্য কতটা তৈরি?
সাধারণভাবে ভারতের উত্তর ও উত্তরপূর্বে এ ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয় বলে ভারতকে পার্বত্য যুদ্ধকৌশলের হাব বলে মনে করা হয়। লাদাখের স্কাউটরা এ ব্যাপের সেরা। যে পার্বত্যভূমিতে আরোহণ করা শক্ত, সেখানকার জন্য উপযোগী কৌশল মাউন্টেন চপ ভারতেই তৈরি।
কর্নেল সোনম বলেন, উপরে বলে থাকা শত্রুর মনোভাব বোঝা খুব জরুরি। গোটা পরিস্থিতির খতিয়ান নেওয়ার জন্য সহজতম পদক্ষেপ করতে হয়। বিশেষ করে যেখানে খাড়া পাথর, সেখানে শত্রুপক্ষ সবচেয়ে কম সুরক্ষিত থাকার কথা, সবচেয়ে কঠিন পথ দিয়ে গেলে শত্রুর প্রতিরোধ সবচেয়ে কম হবে, এবং সেটাকেই ঠিকভাবে কাজে লাগাতে হয়।
গালওয়ান উপত্যকার মত উঁচু জায়গায় যুদ্ধকৌশলের চ্যালেঞ্জ কী?
সবচেয়ে বড় বিষয় হল তারা ডিফেন্সিভ পজিশনে রয়েছে এবং উঁচুতে কারা রয়েছে। একবার সেনাবাহিনী উঁচুতে অবস্থান নিয়ে ফেললে সেখান থেকে তাদের সরানো শক্ত। গালওয়ান উপত্যকার মত জায়গায়, যেখানে কোনও গাছপালা নেই, সেখানে লুকোনো সম্ভব নয়। পার্বত্যযুদ্ধে সাধারণত যারা নিচে থাকে তারা ১:৬ অনুপাতে সংঘর্ষ করে, গালওয়ানের মত জায়গায় তা ১:১০ পর্যন্তও হতে পারে।
সাধারণত পার্বত্যযুদ্ধে অন্ধকারে প্রতিপক্ষের কাছে পৌঁছে তাদের সঙ্গে লড়াই করে ভোরের আলো ফোটার আগে কাবু করে ফেলতে হয়। যদি কোনও সেনাবাহিনীর সেই সক্ষমতা ও কৌশল না থাকে, তাহলে তাদের পরাজয় অনিবার্য। কর্নোল সোনম বললেন, কার্গিলের স্থানীয় বাহনী চমৎকার প্রমাণিত হয়েছিল কারণ তারা চমৎকার পর্বতারোহী ছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী ছাড়া এ কাজ সহজ নয়।
উঁচু জায়গায় সেনাকে আর কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়?
আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ অক্সিজেন সরবরাহ প্রবল ভাবে কমে যায়। এর পর ভার বহনের ক্ষমতাও কমে যায়। পার্বত্য এলাকায় খুব ধীরে ধীরে নড়াচড়া করতে হয় এবং যে কারণে সেনাবাহিনীকে জড়ো করতে সময় লাগে। ফলে সময় এবং স্থান অন্যতম চূড়ান্ত অগ্রাধিকারের বিষয়।
আরও পড়ুন, গালওয়ান সংঘর্ষ: অস্ত্র থাকতেও কেন গুলি চালায় নি ভারতীয় ফৌজ?
এ ধরনের যুদ্ধে লজিস্টিকাল চ্যালেঞ্জ কী থাকে?
একটা বড় চ্যালেঞ্জ অস্ত্র জ্যাম হয়ে যাওয়া। ১৭ হাজার ফুট বা তার বেশি উচ্চতায়, যেখানে প্রবল ঠান্ডা সেখানে সপ্তাহে অন্তত একবার অস্ত্রে গ্রিজ মাখাতে হয় এবং ব্যারেল সাফ করতে হয়। কিন্তু লড়াইয়ের সময়ে তা মুশকিল।
ফুয়েল জ্যাম হয়ে গেলে গাড়ি স্টার্ট নেয় না। যদি ডিজেল হয়, তাহলে থিনার বা অন্য কোনও রাসায়নিক না দিলে ইঞ্জিনে আগুন জ্বলবেই না। এর পরিকল্পনা আগে থেকে করতে হয়, রেকিও করতে হয়, যা পার্বত্য এলাকায় অসুবিধাজনক।
গালওয়ানের মত জায়গায়, যা কৌশলগত ভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং যেখানে ভারতীয় সেনা সুবিধাজনক জায়গায় নেই, সেখানে রিইনফোর্সমেন্ট পরিকল্পনা অতি গুরুত্বপূর্ণ। যোগাযোগের জন্য সেনাকে বেশি ব্যাটারি বহন করতে হয় কারণ উঁচু জায়গায় ব্যাটারি দ্রুত ফুরিয়ে যায়। এরকম জায়গায় পরিবহণের জন্য খচ্চরের ব্যবস্থা রাখতে হয় পর্যাপ্ত সরবরাহের জন্য, যা সহজ নয়। আবহাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে।
ভারতীয় সেনাকে পার্বত্যযুদ্ধের জন্য কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে?
প্রথমত, সেনাবাহিনীকে পর্বতারোহণে দক্ষ করে তোলা হয়। কর্নেল সোনমের কথায় যেসব সেনাকে ইউনিটে নেওয়া হবে তাদের একমাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই ট্রেনিং দিয়ে থাকেন প্রতিটি ইউনিটের সেরা ইনস্ট্রাকটর। এর পর আসে আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পালাস যাতে লড়াই ছাড়াই, ঠান্ডায় কোনও ক্ষয়ক্ষতি না ঘটে। প্রায় সমস্ত ইউনিটেই এ ধরনের ট্রেনার থাকেন যিনি বাহিনীকে যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় দক্ষ করে তোলেন।