গত ১৪ সেপ্টেম্বর হিন্দি দিবসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সারা দেশে এক ভাষার ডাক দিয়েছিলেন। তা নিয়ে বিস্তর প্রতিবাদও হয়েছে। অমিত শাহ বলেছিলেন, ভারতের মত বৈচিত্র্যময় দেশে সরকারি ভাষা নিয়ে মতানৈক্য থাকা স্বাভাবিক হলেও, সংবিধানপ্রণেতারা গণ পরিষদের সমস্ত মতামত খতিয়ে দেখে হিন্দিকে রাজভাষার স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন।
প্রায় ৭০ বছর আগে, ১৯৪৯ সালের ১২ ও ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে, ভারতের গণপরিষদে ভারতের ভাষা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। যে সব বিষয়ে সেখানে আলোচনা তার মধ্যে সরকারি ভাষার বদলে জাতীয় ভাষা নামক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল। বিতর্ক হয়েছিল বিচারবিভাগের উচ্চক্ষেত্রে কোন ভাষা ব্যবহার করা হবে, হিন্দি নাকি বাংলা, তেলুগু, সংস্কৃত, অথবা হিন্দুস্তানি, দেবনাগরী হরফ ব্যবহৃত হবে নাকি রোমান, সংখ্যার ব্যবহার হবে আন্তর্জাতিক হরফে নাকি দেবনাগরীতে।
রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ এ বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, "গোটা সংবিধানে আর কোনও বিষয় নেই যা প্রতি দিন প্রতি ঘণ্টা, প্রতি মিনিটে ব্যবহৃত হওয়া প্রয়োজন... এমনকি যদি আমরা একটি প্রস্তাবের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাই, তার অর্থ এই নয় যে জনগণের বড় অংশের সমর্থন আমরা পাব..., সংবিধান লাগু করা অন্যতম সমস্যার হয়ে দাঁড়াবে।"
গণ পরিষদের কিছু সদস্য ওই বিতর্কে যা বলেছিলেন তার সংক্ষিপ্তসার এখানে উদ্ধৃত হল। এর অনেক যুক্তিই আজও উচ্চারিত হয়।
এন গোপালাস্বামী আয়েঙ্গার খসড়া কমিটির সদস্য হিসেবে তাঁর প্রাথমিক খসড়া ও প্রথম সংশোধনী পেশ করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, "হিন্দি ও দেবনাগরী হরফ দেশের সরকারি ভাষা হওয়া উচিত, তবে ইংরেজি চালু রাখা উচিত অন্তত ১৫ বছর। এই (ভাষা) প্রকল্প... প্রভূত আলোচনা ও প্রচুর সমঝোতার ফসল। আমি যে বিষয়ে জোর দেব, তা হল এই সমগ্রটা এতটাই সমন্বিত... এর একটা অংশ স্পর্শ করলে, অন্য অংশগুলি ভেঙে পড়বে।"
শেঠ গোবিন্দ দাস এক ভাষা, এক হরফের পক্ষে সওয়াল করেন এবং বলেন, "যত দ্রুত সম্ভব হিন্দিকে ইংরেজির জায়গা নিতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে সম্মান করাই গণতন্ত্র। যদি আমাদের মতপার্থক্যে থাকে তাহলে ভোটাভুটি হওয়া উচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত সংখ্যালঘুর সসম্মানে মেনে নেওয়া উচিত... আমরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কথা মেনে নিয়েছি, কিন্তু তাই বলে এ কথা কখনও ভাবিনি যে আমাদের বহুমুখী সংস্কৃতি মেনে নিতে হবে। ভারত প্রাচীন দেশ, এ দেশের ইতিহাসও প্রাচীন। হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশে প্রাচীন সংস্কৃতি প্রবহমান। সে ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য সারা দেশে একটি ভাষা ও একটি হরফ চাই। এখানে দুটি সংস্কৃতি রয়েছে, এরকম কথা আমরা শুনতে চাই না।"
আরও পড়ুন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে এত বিতর্ক কেন?
নাজিরউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, "সারা দেশে এক ভাষার ব্যাপারে এখনই কোনও ঘোষণা করে উচিত হবে না... যেমনটা চলছিল, তেমনভাবে ইংরেজিকেই আপাতত সরকারি ভাষা হিসেবে সব ক্ষেত্রে চালানো উচিত, যতদিন না একটি সর্বভারতীয় ভাষা তৈরি হয়ে ওঠে- যে ভাষায় আমরা বৈজ্ঞানিক, গাণিতিক, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক- সমস্ত বিষয়ে নিজেদের ভাবনা ও ধরাণা প্রকাশ করতে পারব।"
এসভি কৃষ্ণমূর্তি রাও বলেন, ইংরেজিই থাকা উচিত এবং ভবিষ্যৎ সংসদের হাতে এ বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, "হিন্দি অনেক দক্ষিণ ভারতীয় ভাষার চেয়েই নিকৃষ্ট ভাষা। হিন্দি ও হিন্দুস্থানি একেবারেই উত্তরের ব্যাপার। কিন্তু আমরা হিন্দি মেনে নিতে রাজি আছি। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ বিষয়টি মীমাংসিত হওয়া উচিত এমন একটা সময়ে যখন অনুভূতির তীব্রতা কমে আসবে।"
মহম্মদ হিফাজুর রহমান হিন্দির বদলে হিন্দুস্থানি ভাষা, যে ভাষায় মহাত্মা গান্ধী কথা বলতেন তার পক্ষে সওয়াল করেন। এ ভাষায় যে বিহার থেকে ফ্রন্টিয়ারের ভাষা সে ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল কংগ্রেসও। তিনি বলেন, "হিন্দির পক্ষে এত আওয়াজ ওঠার কারণ হল দেশভাগ। এই ক্রোধ ও বিষাদের সময়ে... ওরা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। রাজনৈতিক গোঁড়ামির পরিবেশের সুযোগ নিয়ে ভাষা প্রশ্নের সমাধান করতে চাইছে, ভাষাসমস্যার সমাধান করতে চাইছে না।"
আর ভি ধুলেকর মনে করিয়ে দেন যে রামদাস থেকে তুলসীদাস এবং স্বামী দয়ানন্দ থেকে মহাত্মা গান্ধী, সকলেই হিন্দি ভাষায় লিখে গিয়েছেন। জোরের সঙ্গে তিনি বলেন, "আপনারা অন্য কোনও জাতির লোক হতে পারেন, কিন্তু আমি ভরাতীয় দাতির, হিন্দি জাতির, হিন্দুস্থানি জাতির। আমি জানি না আপনারা কেন বলছেন হিন্দি জাতীয় ভাষা নয়। দেশে স্বরাজ আসার পরেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালেয়, আমাদের বিদ্যালয়ে, আমাদের বিজ্ঞানীরা ইংরেজি ভাষাতেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন একথা ভাবতেই আমি কেঁপে উঠছি। লর্ড মেকলের ভূত কী বলবে! সে নিশ্চিতভাবেই অট্টহাস্য করে বলে উঠবে 'পুরনো জনি ওয়াকার এখনও দারুন চলছে'।"
আরও পড়ুন, জম্মু কাশ্মীরের যে অংশগুলি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে
ফ্র্যাঙ্ক অ্যান্টনি বলেছিলেন, "বহু কারণে ইংরেজি এ দেশের জাতীয় ভাষা হতে পারে না।" তবে একই সঙ্গে তিনি সাবধান করে দেন যে "বহু মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, হিন্দি তা থেকে আলাদা। একটা স্রোত তৈরি হয়েছে..., এই ধর্মান্ধ সময়ে নতুন ধরনের একটি হিন্দি, অধিকতর সংস্কৃতসমন্বিত হিন্দি মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, যা রাস্তার হিন্দিভাষী হিন্দুদের ভাষা নয়... আপনারা একদিকে সকলের জন্য সমান সুযোগ সুবিধার কথা বলবেন এবং অন্য দিকে তার বিপরীতধর্মী একটা নীতি জোরের সঙ্গে চাপিয়ে দেবেন।"
কাজি সৈয়দ করিমউদ্দিন হিন্দুস্থানির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। "আপনারা ইতিমধ্যে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর ইংরেজি ভাষা চালানোর ব্যাপারে সহমত হয়েছেন, তাহলে আপনারা উর্দু হরফ নিষিদ্ধ করে মুসলিমদের অধিকার হরণ করছেন কেন! আপনাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে ফলে আপনারা একে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে চাইছেন, শেষ করে দিতে চাইছেন... একমাত্র যে ভাষায় হিন্দু ও মুসলিমরা নিজেদের কথা বলতে পারে, যে ভাষা সাধারণ বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে, সেই হিন্দুস্থানি ভাষাকে জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।"
লক্ষ্মীনারায়ণ সাহু বলেছিলেন হিন্দিকেই ভারতের জাতীয় ভাষা করা উচিত। "আমি ওড়িয়ার জন্যও একই দাবি জানাতে পারি, যা বাংলার চেয়েও বেশি প্রাচীন... দক্ষিণ থেকে আমার বন্ধুরা দাবি করেছেন তাঁদের ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন। কিন্তু এটা প্রাচীন না মধ্যযুগীয়, সেটা কোনও বিষয় নয়। অনেকেই ইংরেজির পক্ষে সওয়াল করছেন, কারণ ইংরেজি জাতীয় ভাষা না হলে তাঁদের অস্তিত্বই থাকবে না... আমাদের গোটা জাতি ও দেশের স্বার্থে অগ্রসর হওয়া উচিত, এবং যদি স্বল্পসংখ্যক মানুষের তাতে অসুবিধে হয়, তাঁদের সে নিয়েই চলতে হবে।"
এনভি গ্যাডগিল চেয়েছিলেন জাতীয় ভাষা হওয়া উচিত সংস্কৃত এবং ইংরেজিকে আরও অন্তত একশ বছর রেখে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন "হিন্দি একটি প্রাদেশিক ভাষা, অনেক ভাষা রয়েছে, যার সাহিত্য অনেক বেশি ঋদ্ধ কিন্তু তবু আমরা জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দিকে মেনে নিচ্ছি।"
টি এ রামলিঙ্গম চেট্টিয়ার বলেছিলেন "এটি খুবই কঠিন প্রশ্ন... দক্ষিণের কাছে সম্ভবত জীবন মরণের প্রশ্ন। চেট্টিয়ার বলেছিলেন, হিন্দি জনতার প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা রয়েছে, কিন্তু তাঁদেরও বুঝতে হবে যে যে আমাদেরও দেশপ্রেম রয়েছে এবং আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপারে ভালবাসা রয়েছে। হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে তিনি বলেন, হিন্দি আমাদের কাছে ইংরেজি বা অন্য ভাষার চেয়ে বেশি জাতীয় কিছু নয়।" তিনি বলেন, "দক্ষিণের মানুষ যাতে বুঝতে পারেন দেশের জন্য তাঁদেরও কিছু করার রয়েছে, তেমন কিছু পদক্ষেপ করা উচিত... আমার মনে হয় না দক্ষিণ আদৌ সন্তুষ্ট... এর ফলে যা হবে, তা সহজ নয়।"
সতীশচন্দ্র সামন্ত বলেন বাংলা ভাষাকে হিন্দির উপর জায়গা দেওয়া উচিত কারণ বাংলা ভাষা হিসেবে একটি বেশি ঋদ্ধ ভাষা যা আন্তর্জাতিক স্তরে পড়ানো হয়ে থাকে, এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধকারী কবিতা বন্দে মাতরম বাংলা ভাষাতেই লেখা হয়েছিল।
আলগু রাই শাস্ত্রী বলেছিলেন "সংস্কৃত যে ভারতের সব ভাষার জননী তাতে কোনও সন্দেহ নেই এবং এর প্রাচীনতম কন্যা (হিন্দি) আজকের জাতীয় ভাষা হতে পারে।"
আরও পড়ুন, ‘চূড়ান্ত’ এনআরসি কেন চূড়ান্ত নয়?
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন ভারতের এক এবং একমাত্র ভাষা থাকবে বলে যাঁরা বলছেন, তিনি তাঁদের সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, "ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং বোঝাপড়া ও সহমতের ভিত্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, এবং তার জন্য যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। হিন্দিকে যারা মেনে নিয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই বুঝেছেন আজ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।" শ্যামাপ্রসাদ বলেন, য"দি হিন্দি ভাষার সমর্থকরা হিন্দি লাগু করার ব্যাপারে দাবিতে এত বেশি সক্রিয় না হতেন, তাহলে তাঁরা যা চাইছেন তাই পেতেন, সারা দেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার মাধ্যমে তার চেয়েও বেশি পেতেন।"
গণ পরিষদের একটি সিদ্ধান্ত কোনও ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করতে পারে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। "আপনারা যদি চান হিন্দি সত্যিই সারা ভারত জুড়ে লাগু হবে, কেবল সরকারি কাজে হিন্দি ভাষার বদলে নয়, তাহলে আপানারা হিন্দি ভাষাকে সে জায়গায় নিয়ে আসুন। সে জন্য সংস্কৃত ছাড়া ভারতের অন্য ভাষার শব্দ ও বাগধারা হিন্দির মধ্যে নিয়ে আসুন... আমি নিজে বাঙালি পদ্ধতিতে হিন্দি বলি। মহাত্মা গান্ধী তাঁর মত করে হিন্দি বলতেন। সর্দার প্যাটেল গুজরাটি পদ্ধতিতে হিন্দি বলতেন। যদি আমার উত্তর প্রদেশ বা বিহারের বন্ধুরা বলেন তাঁদের হিন্দিটাই মান্য হিন্দি তাহলে তা শুধু হিন্দি ভাষার পক্ষে নয়, সারা দেশের পক্ষেও দুর্ভাগ্যজনক হবে।"
পি টি চাকো বলেন, "একটি জাতীয় ভাষা নিজে থেকে উৎসারিত হয়,তাকে কৃ্ত্রিম ভাবে বানিয়ে তুলতে হয় না। ভারতের মত দেশের জাতীয় ভাষাক আধুনিক সভ্যতার সব প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া উচিত।" তিনি এর বদলে অতি জরুরি কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন, যেমন "স্বাধীনতা সংগ্রামীরা খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে মারা যাচ্ছেন", "শিল্প ও বাণিজ্য দিনদিন খারাপ অবস্থায় উপনীত হচ্ছে", "ব্যাপক কর্মহীনতা", "উত্তরে কাশ্মীর সমস্যা" এবং "দক্ষিণে কমিউনিস্ট গুণ্ডাদের বাড়বাড়ন্ত।"
ডক্টর পি সুব্বারায়ন প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রোমান হরফে হিন্দি চালু হোক। ইংরেজি ভাষার প্রতি ঘৃণার ব্যাপারে অবাক হয়ে তিনি আমেরিকার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন ২০ শতাংশ মার্কিন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও তারা ইংরেজিকে নিজস্ব ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
কুলধর চালিহা আসামের বাসিন্দা। তিনি বলেছিলেন "সংস্কৃতকে জাতীয় ভাষা করা উচিত কারণ সংস্কৃত ও ভারত অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। হিন্দি কেবল সমঝোতা হতে পারে, কারণ তা ভারতের পক্ষে ভাল এ কারণে নয়, যে হিন্দি অন্য ভাষার চেয়ে ভাল। তবে হিন্দুস্থানি ভাষাকে তিনি অধিকতর সমর্থন জানান।"
রেভারেন্ড জেরোম ডিসুজা বলেছিলেন, তিনি মোটের উপর আয়েঙ্গারের প্রস্তাব সমর্থন করছেন। তবে একই সঙ্গে তিনি ফরাসি চালু কথাও মনে করিয়ে দেন যেখানে বলা হয়ে থাকে, "সব মানুষের দুটি ভাষা রয়েছে, তাঁদের নিজেদের ভাষা এবং সুমিষ্ট ফরাসি ভাষা।" জেরোম ডিসুজা বলেন, "হয়ত এমন একদিন আসবে যেদিন সভ্য পৃথিবীর মানুষ বলবেন, সমস্ত মানুষের দুটি ভাষা রয়েছে, একটি নিজের ভাষা এবং একটি ভারতের মধুর ভাষা।"
আরও পড়ুন, ফের বালাকোট চালু: দেখে নিন পাকিস্তানের জঙ্গি ক্যাম্পের ইতিহাস ভূগোল
জওহরলাল নেহরু এ বিষয়ে গান্ধীর বক্তব্যের কথা মনে করিয়ে দেন। "প্রথমত ইংরেজি মহান ভাষা, তা আমাদের যথেষ্ট উপকারসাধন করেছে... কিন্তু কোনও জাতিই ভিনদেশের ভাষার মহান হয়ে উঠতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যে ভাষাকে বেছে নেওয়া হচ্ছে তাকে এমন ভাষা হতে হবে যা কমবেশি অনেক মানুষের ভাষা, হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষিতের ভাষা নয়। এবং তৃতীয়ত সে ভাষাকে ভারতের মিলিত সংস্কৃতির প্রতিভূ হতে হবে। নেহরুর বক্তব্য ছিল, "গান্ধী যে হিন্দুস্থানি ভাষায় কথা বলতেন, তা মোটামুটি ভাবে মিলিত সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে।"
তবে নেহরু ভারতের মানুষের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেবার বিরোধিতা করেন। "আপনারা কোন পদ্ধতি গ্রহণ করবেন, গণতান্ত্রিক নাকি কর্তৃত্বমূলক?" নেহরু বলেন, "হিন্দি ভাষার সমর্থকদের মধ্যে তিনি কর্তৃত্বের স্বর দেখতে পেয়েছেন, যেন হিন্দি ভাষী এলাকা ভারতের কেন্দ্রে অবস্থিত, যেন মাধ্যাকর্ষণ বিন্দু, এবং অন্যরা যেন শুধু ভারতের প্রান্তবাসী মাত্র।"
নেহরু বলেন, "এ শুধু ভুল দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গি, - একদল মানুষ বা গোষ্ঠী যখন প্রতিরোধ করছে, তখন তাদের উপর কোনও ভাষা চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।"
পণ্ডিত রবিশংকর শুক্লা
বলেন ১৮৭৪ সালে কেশব চন্দ্র সেন বলেছিলে একটি আঞ্চলিক ভাষা ছাড়া ভারেতর ঐক্য অসম্ভব। তিনি বলেন, "বহু ভাষার মধ্যেই হিন্দি ঢুকে পড়েছে, এবং হিন্দি প্রায় সর্বত্র প্রভাবশালীও বটে। ফলে হিন্দিকেই দেশ জুড়ে সাধারণ ভাষা বলে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। দক্ষিণের বন্ধুদের তিনি পরামর্শ দেন, যত দ্রুত সম্ভব হিন্দি শিখে ফেলতে, না হলে তাঁরা পিছিয়ে পড়ে থাকবেন।"
জি দুর্গাবাঈ মাদ্রাজের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, এবং জাতীয় ভাষা হিসাবে হিন্দুস্থানির পক্ষে সওয়াল করার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে দেবনাগরী হরফে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, "একটি আঞ্চলিক ভাষাকে জাতীয় চরিত্র দেওয়ার ব্যাপারে আপনাদের যে মনোভাব তা অহিন্দিভাষী মানুষদের মধ্যে তিক্ততার অনুভব আনতে বাধ্য।" হিন্দি সংখ্যা চাপিয়ে দেবার দাবিকে "ভাষা স্বেচ্ছাচার ও অসহিষ্ণুতার চরম উদাহরণ" বলে বর্ণনা করেন দুর্গাবাঈ।
শংকররাও দেও ছিলেন বম্বের প্রতিনিধি। তিনি বলেন "এক সংস্কৃতির জন্য এই রোদনের ফলাফল সাংঘাতিক হতে পারে এবং সংস্কৃতি কথাটাই বিপজ্জনক হতে পারে। তিনি বলেন, আরএসএস সংগঠনের প্রধান সংস্কৃতির নামে আবেদন করছেন। কিছু কংগ্রেসের লোক সংস্কৃতির নামে আবেদন করছেন। কেউ আমাদের বলছেন না সংস্কৃতি শব্দটার অর্থ কী। আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, যা বোঝা যাচ্ছে তার মানে হল কয়েকজনের উপর অনেকের কর্তৃত্ব। যদি আপনারা আমাকে একটি সংস্কৃতির বিষয়ে চাপ দেন তাহলে আমার কাছে তা ভারতাত্মাকে সংহারের শামিল। ভারত বিবিধতার পক্ষে, সেটাই আমাদের ঐশ্বর্য্য... যদি আপনারা জাতীয় ভাষা বলতে সারা দেশে এক ভাষা বোঝাতে চান, তাহলে আমি তার বিপক্ষে।"
আরও পড়ুন, আবার নতুন পরিচয়পত্র? অমিত শাহের ঘোষণার ইতিহাস
সর্দার হুকম সিং বলেন, তিনি সর্বদাই দেবনাগরী হরফে হিন্দি ভাষার পক্ষে সওয়াল করে এসেছেন। কিন্তু এর সমর্থকদের "গোঁড়ামি ও অসহিষ্ণুতা" দেখে তিনি "মন বদল" করেছেন। এখন তিনি রোমান হরফে হিন্দুস্থানির পক্ষে। "যা কক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দূর করতে সহায়ক হবে এবং দক্ষিণের বন্ধুদের পক্ষে শেখাও সহজ হবে।"
জয়পাল সিং বলেন তিনি সংবিধানে মুণ্ডারি, গোণ্ডি এবং ওরাওঁয়ের মত আদিবাসী ভাষার স্বীকৃতির পক্ষে।
পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন সংযুক্ত প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি বলেন আয়েঙ্গারের খসড়ায় যে "আগামী পাঁচ বছর হিন্দি ব্যবহার করা চলবে না এবং ইংরেজি ব্যবহার করতেই হবে, যতদিন না পর্যন্ত কমিশন প্রস্তাব দেয় এবং রাষ্ট্রপতি সে প্রস্তাব অনুমোদন করেন- এই সংস্থানটি একটু কঠোর। দেবনাগরী সংখ্যার বদলে আন্তর্জাতিক সংখ্যার ব্যবহার এক ধরনের বিকৃতি এবং আমি বলতে চাই আন্তর্জাতিকতা কোনও তর্কের বিষয় নয় এবং আমাদের জনগণকে তাঁদের নিজেদের সংখ্যা ছেড়ে দিতে বলা ঠিক নয়।"
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বলেন ইংরেজিকে প্রতিস্থাপিত করা কঠিন হচ্ছে কোনও একটি সাধারণ ভাষার অভাবের জন্য। কংগ্রেস হিন্দুস্থানির ব্যাপারে নিজেদের সহমতের বিষয়টি পরিত্যাগ করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। "সংকীর্ণমনস্কতা প্রাধান্য বিস্তার করছে। সংকীর্ণমনস্কতার অর্থ হল মহৎ কিছুকে প্রত্যাখ্যান, যা প্রাচীন ভারতের মহিমাকে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে... হিন্দুস্থানি ভাষার বিরোধিতায় যে যুক্তিগুলি এসেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে যে এ ভাষায় উর্দুকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যাকে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু উর্দু একটি ভারতীয় ভাষা। এর জন্ম ভারতে, বিস্তার ভারতে এবং এ দেশের লাখলাখ হিন্দু মুসলিমের মাতৃভাষা এই উর্দু।"
Read the Full Story in English