কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সোমবারই বলেছেন সরকারি দফতরে হিন্দি ভাষা ব্যবহার করার কথা। যা নিয়ে দেশে বিস্তর জলঘোলাও হয়েছে। কিন্তু এই বিতর্ক আজকের নয়। স্বাধীনতার পর থেকে একাধিকবার হিন্দি ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি সামনে আনা হয়। কিন্তু ভারতের মতো বহুভাষিক দেশে তা সম্ভব হয়নি। একসময় উর্দু ছিল ভারতের অন্যতম একটি ভাষা। সেই উর্দুকে সরিয়ে কেন হিন্দি ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হল তা বলতে গেলে ইতিহাস খুঁড়তে হবে। কয়েক যুগের লড়াই দেখতে হবে যে লড়াইয়ের পর উর্দুকে হারিয়ে সামনের সারিতে আসে হিন্দি ভাষা।
ইতিহাসের কথায় যখন হল তখন সাহিত্য ক্ষেত্রে অন্যতম নাম সাদাত হাসান মান্টোর কথাই আনা যাক। এ বিষয়ে তিনি নিজের অভিমত জানিয়েছিলেন তাঁর একটি ছোটো গল্প 'হিন্দি ঔর উর্দু'। সেখানে মান্টো বলেন, “হিন্দুরা কেন হিন্দিকে সমর্থন করে তাদের সময় নষ্ট করছে এবং উর্দু সংরক্ষণের বিষয়ে মুসলমানরাই বা কেন একই কাজ করে চলেছে? একটি ভাষা নিজেই নিজেকে তৈরি করে। আর কোনও পরিমাণ প্রচেষ্টা কখনই কোনও ভাষাকে মেরে ফেলতে পারে না।"
হিন্দি বনাম উর্দু বিতর্ক আসলে প্রায় এক শতাব্দী পুরানো। ১৮০০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে দুটি ভাষা নিয়ে রাজনীতিকরণ এবং মেরুকরণ দেখা যায়। সেই প্রেক্ষিতকে টেনেই ভাষাতত্ত্ববিদ ও সংস্কৃতি কর্মী গণেশ দেভি বলেন, “এটি একটি ভুল ধারণা যে হিন্দুরা হিন্দী এবং মুসলমানরা উর্দু ভাষায় কথা বলে। প্রেমচাঁদ ও অমৃতা প্রীতমের মতো স্বনামধন্য লেখকরা মুসলমান না হলেও উর্দুতে লিখেছিলেন”। তিনি আরও বলেন, "আজও পাঞ্জাব, বিহার এবং মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উর্দু ভাষার ব্যবহার রয়েছে। তা যে কেবল মুসলমানরাই বলেন এমনটা কিন্তু নয়।”
আরও পড়ুন, সরকারি দফতরের কাজে হিন্দি ব্য়বহার করুন, আর্জি শাহের
ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার যেমন তাঁর বই 'মর্ডান ইন্ডিয়া, ১৮৮৫-১৯৪৭'-তে উল্লেখ করেছেন, "উত্তর ভারতের বেশিরভাগ অংশে উর্দু শিক্ষিত সংস্কৃতির ভাষা ছিল। ১৮৮১-৯০ সময়কালে উত্তরপ্রদেশ থেকে উর্দু বই প্রকাশিত হয়েছিল ৪৩৮০ আর হিন্দি ভাষার বই প্রকাশিত হয়েছিল ২৭৯৩টি। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে উর্দু সার্কুলেশন ছিল ১৬ হাজার ২৫৬ আর হিন্দি ছিল ৮ হাজার ২।"
এই ভাষা বিবাদের সূত্রপাত কবে থেকে?
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার আগে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ভাষা ছিল পার্সি। ১৮৩০ সালে ইংরেজরা পার্সি ভাষা বদলে তা ইংরেজি করে দেয়। এর ফলে উত্তর ভারতের একাধিক জায়গায় পার্সি ভাষা বদলে হয়ে যায় উর্দু। ১৮৬০ সাল থেকে উত্তর ভারতে 'সরকারি ভাষা' কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার কিং তাঁর প্রকাশিত পেপারে লেখেন, "১৮৩০ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত ভাষা নিয়ে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বদল হয় উত্তরভারতে। সমীক্ষায় জানা যায় হিন্দি স্কুলগুলিতে মূলত ব্রাহ্মণ, রাজপুত এবং বেনিয়া বর্ণরা পড়াশুনো করতেন। অন্যদিকে, মুসলমান এবং কায়স্থদের পরিবার পার্সি ও উর্দু বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে যেতেন।
কবে থেকে ধর্ম এবং ভাষা এক হয়ে গেল?
বর্তমানে হিন্দু ভাষার সমর্থকেরা এই ভাষাক প্রশাসনের সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচনা করে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এমনভাবে বর্ণনা করেন যেন মুসলিমদের আধিপত্য বিস্তারের আগে ভারতের আদি বাসিন্দারা এই ভাষাতেই কথা বলতেন।
বেনারসের বাবু শিব প্রকাশ একটি বিবৃতিতে এক সময় বলেছিলেন নতুন মুসলিম শাসকরা নতুন ভাষা শেখার জন্য আগ্রহী ছিলেন না , বরং হিন্দুদের পার্সি শিখতে বাধ্য করেছিলেন। একই রকম যুক্তি দিয়েছিলেন হিন্দি সাহিত্যের জনক হিসাবে পরিচিত ভারতেণ্ডু হরিশচন্দ্র এবং পণ্ডিত মদন মোহন মালভিয়ার যিনি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার কিং তাঁর বইতে লিখেছেন, "বেশ কয়েকটি উত্তর পশ্চিম প্রদেশ এবং হিন্দু সংগঠনের পক্ষ থেকে ৬৭ হাজারেরও বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এবং তা কমিশনে প্রেরণ করেছে"।
Read the full story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন