বিহার সরকার সম্প্রতি সেরাজ্যে জাতপাতের ওপর হওয়া সমীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে। যাতে ধরা পড়েছে যে, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) এবং অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণি (ইবিসি) বিহারের জনসংখ্যার ৬৩%-এরও বেশি।
মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার জাতসমীক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সমগ্র দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং বলেছেন, 'বিহার বিধানসভায় জাতসমীক্ষার প্রস্তাব সর্বসম্মতির মাধ্যমে পাস করা হয়েছিল। নয়টি রাজনৈতিক দল বিহার বিধানসভায় জাতসমীক্ষার ব্যয় বহন করার বিষয়ে রাজ্য সরকারকে সম্মতি দিয়েছিল। সমীক্ষায় শুধুমাত্র একজনের জাত নয়, তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থাও বিবেচনা করা হয়েছে। যা, আমাদের সকল শ্রেণির উন্নয়নের জন্য আরও নীতি ও পরিকল্পনা তৈরি করতে সাহায্য করবে।'
আদমশুমারিতে জাতপাতের কী ধরনের তথ্য প্রকাশিত হয়?
১৯৫১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত স্বাধীন ভারতে প্রতিটি আদমশুমারি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতির তথ্য প্রকাশ করেছে। তবে অন্যান্য জাতিগুলির ওপর কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি। তার আগে, ১৯৩১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি আদমশুমারিতে জাত সম্পর্কিত তথ্য ছিল।
যাইহোক, ১৯৪১ সালে, জাতভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল, কিন্তু প্রকাশ করা হয়নি। এমডব্লিউএম ইয়েটস, তৎকালীন সেন্সাস কমিশনার, একটি নোটে বলেছিলেন, 'কোনও সর্বভারতীয় জাতসারণি থাকত না। কেন্দ্রীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই বিশাল এবং ব্যয়বহুল সমীক্ষার সময় শেষ হয়ে গেছে।' তিনি যখন একথা বলেছিলেন, সেটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল।
এই ধরনের আদমশুমারির অনুপস্থিতিতে ওবিসি, ওবিসিদের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং অন্যান্যদের জনসংখ্যার জন্য কোনও সঠিক অনুমান আর তাই তৈরি হয়নি। মণ্ডল কমিশনের অনুমান ছিল, দেশে ওবিসি জনসংখ্যা ৫২%। কিছু অন্যান্য অনুমান আবার জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। আর, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময় রাজ্য এবং লোকসভা আর বিধানসভা আসনগুলোতে তাদের নিজস্ব অনুমান ধরে এতদিন এগিয়েছে। তবে, সবটাই ছিল অনুমান-নির্ভর।
কতবার জাতশুমারির দাবি উঠেছে?
এই দাবি প্রায় প্রতিটি আদমশুমারির আগেই উঠে আসে। কারণ, সংসদে বিতর্ক ও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এই দাবি, সাধারণত অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) এবং অন্যান্য দলিত সংগঠনগুলোর মধ্যে থেকেই উঠে আসে। এই সংগঠনগুলো উচ্চবর্ণের বিরোধিতার রাজনীতি করে।
এবার অবশ্য ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। ২০২১ সালের আদমশুমারি বেশ কয়েকবার বিলম্বিত হওয়ায়, বিরোধী দলগুলো একটি জাতশুমারির জন্য গলা ফাটাচ্ছে। তারা ভোটমুখী 'সামাজিক ন্যায়বিচার'-এর দাবিতে সরব।
চলতি বছরের গোড়ার দিকে কর্ণাটকে প্রচারের সময় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন যে নরেন্দ্র মোদী সরকারের উচিত ইউপিএ-২ সরকারের অধীনে পরিচালিত আর্থ-সামাজিক ও জাতশুমারির (এসইসিসি) তথ্য প্রকাশ করা। তদুপরি, তিনি একটি জাতিশুমারি এবং এসসি/এসটি/ওবিসি সংরক্ষণের ৫০% ঊর্ধ্বসীমা অপসারণের দাবি জানিয়েছেন।
বর্তমান সরকারের অবস্থান কী?
জুলাই ২০২১-এ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই লোকসভায় একটি প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, 'ভারত সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আদমশুমারিতে এসসি এবং এসটি ব্যতীত অন্য জাতভিত্তিক সংখ্যা গণনা করা হবে না।'
এই বিবৃতির আগে, নিত্যানন্দ রাই ২০২১ সালের মার্চ মাসে রাজ্যসভায় বলেছিলেন, 'স্বাধীনতার পরে ভারত, তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি ব্যতীত অন্য বর্ণভিত্তিক জনসংখ্যার গণনা না-করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
কিন্তু ৩১ আগস্ট, ২০১৮ সালে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সভাপতিত্বে একটি বৈঠকের পরে ২০২১ সালের আদমশুমারির প্রস্তুতি নিতে পর্যালোচনা হয়েছিল। সেই সময় প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো একটি বিবৃতিতে বলেছে, 'প্রথমবারের মতো ওবিসি ডেটা সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।'
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস যখন বৈঠকের কার্যবিবরণী জানতে চেয়ে একটি আরটিআই করেছিল, তখন ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেলের অফিস (ওআরজিআই) জানায়, '৩১ আগস্ট, ২০১৮-এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ঘোষণার পর ওআরজিআই এই আলোচনার নথি, ওবিসি তথ্য সংগ্রহ করা, বৈঠকের কোনও কার্যবিবরণী, কিছুরই রেকর্ড রাখেনি।'
ইউপিএর অবস্থান কী ছিল?
২০১০ সালে, তৎকালীন আইনমন্ত্রী বীরাপ্পা মইলি সেই সময় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে জাতপাতের তথ্য সংগ্রহের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। ১ মার্চ, ২০১১-এ, লোকসভায় একটি স্বল্পমেয়াদি আলোচনার সময়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম তেমনটাই জানিয়েছিলেন। বেশ কিছু 'অস্বস্তিকর প্রশ্ন'কে সামনে রেখে তিনি জানিয়েছিলেন, 'ওবিসির একটি কেন্দ্রীয় এবং কিছু রাজ্যের তালিকা আছে।'
রেজিস্ট্রার জেনারেল আরও উল্লেখ করেছেন যে তালিকায় অনাথ এবং নিঃস্ব শিশুদের বিভাগও আছে। তফসিলি জাতির তালিকা এবং ওবিসি, উভয় তালিকাতেই কিছু বর্ণের নাম পাওয়া গিয়েছে। খ্রিস্টান বা ইসলামে ধর্মান্তরিত তফসিলি জাতিরাও বিভিন্ন রাজ্যে ওবিসির তালিকায় আছে। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যের বাসিন্দার মর্যাদা নিয়েও যেমন প্রশ্ন রয়েছে। তেমনই জাতিগত শ্রেণিবিন্যাসের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন জাতের মধ্যে বিবাহের ফলে, তাঁদের সন্তানদের অবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
তাহলে এসইসিসি ডেটার কী হবে?
৪,৮৯৩.৬০ কোটি টাকার অনুমোদিত ব্যয়ের সঙ্গেই এসইসিসি গ্রামীণ এলাকায় গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং শহরাঞ্চলে আবাসন ও নগর দারিদ্র্যমোচন মন্ত্রক দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। ২০১৬ সালে দুটি মন্ত্রকের দ্বারা গৃহীত নথিতে জাতের তথ্য বাদ দিয়ে এসইসিসি নথি চূড়ান্ত আকারে প্রকাশ করা হয়েছিল।
সেই তথ্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল, যা তথ্যের শ্রেণিবিভাগ এবং শ্রেণিকরণের জন্য প্রাক্তন নীতি আয়োগের ভাইস-চেয়ারপারসন অরবিন্দ পাঙ্গারিয়ার অধীনে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেছিল। এটি তার রিপোর্ট জমা দিয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়। কারণ, এই ধরনের কোনও রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি।
৩১ আগস্ট, ২০১৬-এ লোকসভার স্পিকারের কাছে উপস্থাপিত গ্রামীণ উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে এসইসিসি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যে, 'তথ্যটি ইতিমধ্যেই পরীক্ষা করা হয়েছে এবং ব্যক্তির জাত এবং ধর্মের ৯৮.৮৭ শতাংশ ডেটা ত্রুটিমুক্ত। ওআরজিআই মোট ১১৮,৬৪,০৩,৭৭০ জন এসইসিসি জনসংখ্যার মধ্যে ১,৩৪,৭৭,০৩০ জনের ক্ষেত্রে ত্রুটির ঘটনা উল্লেখ করেছে। রাজ্যগুলোকে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।'
আরও পড়ুন- নাম থেকে বাদ দিয়েছিলেন বাবার পদবি, কেমন মানুষ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী?
বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি কি?
আরএসএস এখনও জাতিশুমারি নিয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি, তবে আগে এই ধারণার বিরোধিতা করেছে। ২৪ মে, ২০১০-এ, যখন এই বিষয়ে বিতর্ক ২০১১ সালের আদমশুমারির আগে তুঙ্গে ছিল, তখন আরএসএসের সর-কার্যবাহ সুরেশ ভাইয়াজি যোশী নাগপুর থেকে একটি বিবৃতিতে বলেছিলেন, 'আমরা বিভাগ নথিবদ্ধ করার বিরুদ্ধে নই। তবে, আমরা জাতি নথিবদ্ধের বিরোধিতা করি।' তিনি বলেছিলেন যে জাতিশুমারি সংবিধানে বাবাসাহেব আম্বেদকরের মত নেতাদের দ্বারা পরিকল্পিত বর্ণহীন সমাজের ধারণার বিরুদ্ধে। আর, তা সামাজিক সম্প্রীতি তৈরির চলমান প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দেবে।