"গোটা সিন্ধিয়া পরিবার এবার একত্রিত হল।" জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ১৮ বছর পর বিজেপিতে যোগ দেবার পর এমনটাই বলেছেন মধ্যপ্রদেশের শিবপুরীর বিজেপি বিধায়ক তথা জ্যোতিরাদিত্যের পিসি যশোধরা রাজে। তাঁর কথায় তাঁদের "রক্তে বিজেপির আদর্শ।"
গোয়ালিয়রের পূর্বতন রাজ পরিবারের সদস্যরা গত ৬ দশকের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে রয়েছেন, এবং স্বাধীন ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের মধ্যে অন্যতম। এই প্রথম রাজনীতিতে সক্রিয় সমস্ত সিন্ধিয়ারা বিজেপিতে এলেন।
শুরু হয়েছিল বিজয়রাজে সিন্ধিয়াকে দিয়ে
হিন্দু মহাসভা বহুদিন থেকে গোয়ালিয়র-গুণা এলাকায় জনপ্রিয়। বিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশকে জ্যোতিরাদিত্যের ঠাকুর্দা জিভাজিরাওের মহাসভার প্রতি নরম মনোভাব ছিল, যা জওহরলাল নেহরুকে বিরক্তির কারণ হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে মহারাজা যখন বম্বেতে ছিলেন, সে সময়ে বিজয়রাজে সিন্ধিয়া দিল্লি গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আশ্বাস দেন জিভাজিরাওয়ের রাজনীতিতে কোনও আগ্রহ নেই, এবং তিনি হিন্দু মহাসভাকে সমর্থন বা অর্থসাহায্য করেন না।
নেহরু এরপর বিজয়রাজেকে গোবিন্দ বল্লভ পন্থ ও লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এঁরা বিজয়রাজেকে কংগ্রেসের টিকিটে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলেন। বিজয়রাজে এরপর ১৯৫৭ সালে গুণা থেকে কংগ্রেসের সাংসদ হন, ১৯৬২ সালে সাংসদ হন গোযালিয়র থেকে। মহারাজা মারা গিয়েছিলেন ১৯৬১ সালে।
কংগ্রেসের সঙ্গে বিচ্ছেদ
১৯৬৬ সালের ২৫ মার্চ। সে সময়ে মধ্যপ্রদেশে ব্যাপক খরা চলছে। বস্তারের জনপ্রিয় মহারাজা প্রবীর চন্দ্র ভঞ্জ তাঁর ১১ সহযোগীর সঙ্গে জগদলপুরের প্রাসাদে গুলিতে খুন হলেন। বিজয়রাজে সিন্ধিয়া তাঁর আত্মজীবনী রাজপথ সে লোকপথ পর (১৯৯৭)-এ লিখছেন, সত্য সম্ভবত কোনওদিন জানা যাবে না। কিন্তু এ কথা সত্যি যে যাঁরা ওঁকে খুন করেছিল তারা প্রাসাদে ঢুকতে পেরেছিল। খুনিদের মধ্যে কেউ একজন পুলিশ ছিল, যারা বাইরে জড়ো হওয়া জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালায়।
সিন্ধিয়াকে দিয়েই কি শেষ, নাকি তরুণ প্রজন্মের আরও অনেকে কংগ্রেস ছাড়ার লাইনে?
সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশ গোয়ালিয়রে বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়ে দুজনকে হত্যা করে। সে সমেয় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দ্বারকাপ্রসাদ মিশ্র, যাঁর দুর্বিনয় ও রাজপরিবারের প্রতি উষ্মা সর্বজনবিদিত। রাজমাতার ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছিল, তাঁকে লোকে ডাকতে শুরু করেছিল নারাজমাতা বলে। এ সময়ে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ দেখে, এই সুযোগ।
আরএসএস প্রচারক কুশভাউ ঠাকরে এবং প্যারেলাল খাণ্ডেলওয়াল, সে সময়ে ভারতীয় জনসংঘ সংগঠন সচিব ছিলেন। তাঁরা বিজয়রাজে সিন্ধিয়াকে দলে যোগদানের সম্মতি আদায় করেন। ১৯৬৭ সালে রাজ্য ও কেন্দ্র ভোটে তিনি গোয়ালিয়রের কারেরা বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে জনসংঘের টিকিটে এবং গুণা লোকসভা আসনে স্বতন্ত্র পার্টির টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
দুটি নির্বাচনেই জয়লাভ করার পর, বিজয়রাজে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার বিরোধী দলনেত্রী হন। এর পরই গোবিন্দ নারায়ণ সিংয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস বিধায়করা ডিপি মিশ্রর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ভারতীয় জনসংঘ গোবিন্দ সিংকে মুখ্যমন্ত্রী করে সরকার গঠন করে। কংগ্রেস গোবিন্দ সিংকে দলে ফেরাতে পারলেও বিজয়রাজেকে পারেনি। ১৯৭১ সালের লোকসভা ভোটে চিনি জনসংঘের টিকিটে ভিন্ড থেকে জয়ী হন। গুণা কেন্দ্র তিনি ছেড়ে দেন পুত্র মাধররাও সিন্ধিয়ার জন্য, যিনি সেখান থেকে জনসংঘ সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। গোয়ালিয়র আসন যেতেন জনসংঘের আরেক বড় নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী। ১৯৮০ সালে জনসংঘ যখন বিজেপি রূপে জন্ম নেয়, বিজয়রাজে ছিলেন তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
মাতা-পুত্রের বিচ্ছেদ
জরুরি অবস্থার সময়ে জেলে যান বিজয়রাজে সিন্ধিয়া। পরে তিনি প্যারোলে ছাড়া পান। গ্রেফতার করা হবে না, এই মোতাবেক সরকারি আশ্বাস পেয়ে নেপাল থেকে ভারতে ফেরেন মাধবরাও সিন্ধিয়া। বিজয়ারাজে লিখছেন "ভাইয়া (মাধবরাও) আমাকে বলেছিল ও যদি কংগ্রেসে যোগ না দেয় তাহলে আমাকে ফের জেলে ভরা হবে।" ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর যখন নির্বাচন ঘোষণা হল, তখন বিজয়ারাজে ও তাঁর সহযোগী বাল আংরেকে মাধবরাও বলেছিলেন, "এবার আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নেব। তোমাদের পরামর্শের দরকার নেই।"
গোয়ালিয়র থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেেব প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মাধবরাও সিন্ধিয়া। রাজমাতা জনতার কাছে আবেদন করেন মাধবরাওতে ভোট দেবার জন্য। মাধবরাও জনতা ঢেউ ঠেকাতে সক্ষম হন। পরবর্তী বছরগুলিতে তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। মাধবরাওয়ের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধীর সখ্য বাড়ে। ১৯৮০-র ভোটে রায়বেরিলি থেকে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে বিজয়রাজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিলে মাধবরাও অত্যন্ত হতাশ হন। ভোটে হেরে যান বিজয়রাজে, মাধবরাও গুণা থেকে কংগ্রেসের টিকিটে জেতেন।
মাধবরাও রাজীব গান্ধী ও পিভি নরসিমা রাওয়ের সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ভোটের আগে জৈন হাওয়ালা ডায়েরিতে তাঁর নামের উল্লেখ থাকায় তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। দল তাঁকে টিকিট না দেবার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি কংগ্রেস পরিত্যাগ করেন, গড়ে তোলেন মধ্য প্রদেশ বিকাশ কংগ্রেস। এইচ ডি দেবগৌড়া ও আইকে গুজরালের নেতৃত্বাধীন যুক্ত ফ্রন্ট সরকারকে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসে ফেরেন মাধবরাও। ২০০১ সালে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যু পর্যন্ত কংগ্রেসেই ছিলেন তিনি।
রাজনীতিতে অন্য সিন্ধিয়ারা
বিজয়রাজে মারা যান ২০০১ সালে। তাঁর চার কন্যাও রয়েছে, যার মধ্যে দুজন রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন।
৬৭ বছরের বসুন্ধরা রাজে ১৯৮৫ সালে রাজস্থানের ঢোলপুর থেকে নির্বাচিত হন, ১৯৮৯ সালে ঝালওয়ার থেকে হন সাংসদ। ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি সাংসদ ছিলেন। এরপর তিনি রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী হন। তার পর থেকে তিনি বিধায়ক রয়েছেন, ২০১৩-১৮ পর্যন্ত আরেক দফায় মুখ্যমন্ত্রীও হন।
৬৫ বছরের যশোধরা রাজে আমেরিকা থেকে ভারতে ফেরেন ৯-এর দশকের প্রথমার্ধে। অবং তার পর থেকে মায়ের লোকসভা কেন্দ্র গুণার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৯৮, ২০০৩, ২০১৩, ২০১৮ সালে চিনি মধ্য প্রদেশ বিধানসভায় নির্বাচিত হন এবং শিবরাজ সিং চৌহানের সরকারের মন্ত্রীও হন।
বসুন্ধরা রাজের ছেলে দুষ্যন্ত সিং ঝালওয়ার-বরণ লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত।