ম্যানডেট অফ হেভেন (Mandate of Heaven)। চিনা বিশ্বাস। চিনা ভাষায় তিয়ানমিং। মানে কী? স্বর্গাদেশ বা প্রাকৃতিক নির্দেশ অথবা মহাবিশ্বের ইচ্ছা। যে ইচ্ছায় ড্রাগনভূমিতে কেউ রাজা হতে পারেন। ঈশ্বরের বরপুত্রই রাজা। শাসক। বা বলা যেতে পারে, রাজা নিজেকে এই বলে শাসক হিসেবে ন্যায়সংগত করে তোলেন। মানে তিনি নিজে থেকে রাজা হননি, তাঁর রাজা হওয়াটা মহাবৈশ্বিক, ঈশ্বরের ইচ্ছায়। স্বর্গ থেকে দেবতারা রাজাকে নির্দেশ পাঠান, তিনি কখন কী করবেন। কখন চাষ করতে বলতে হবে কৃষকদের, কী ভাবে শাসন করতে হবে, ইত্যাদি। যদি কোনও গৃহযুদ্ধের ফলে রাজা সিংহাসনচ্যুত হন, যদি কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে হাজির হয়, তা হলে ধরে নেওয়া হয়, ঈশ্বরের সমর্থন হারিয়েছেন সেই রাজা, কী করিতে হইবে-- সেই নির্দেশ আর পাচ্ছেন না। এখন অবশ্য সে দেশে ঈশ্বরের ইচ্ছার অজুহাত দরকার হয় না। এখন কুরসিতে থাকার অধিকার দেয় যে প্রতিনিধিদের সভা, সেখানে আইন বদল করলেই সব হয়। যেমন চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং অজীবন প্রেসিডেন্ট সেই আইন বদলে। এই লেখাটা শি জিনপিংকে নিয়ে নয় কিন্তু-- চিনা কমিউনিস্ট পার্টি তৈরির একশ বছর এ লেখার কারণ। ১ জুলাই সেই শতবর্ষের দিন। এবার টাইম মেশিনে উঠুন এবং সিটবেল্ট বেঁধে নিন। অনেকটা পিছনে যেতে হবে।
হলুদ নদী, হলুদ শাসক
হলুদ পাখি শৈশবের সকালে ডাকাডাকি করে। গান রয়েছে বাংলা ভাষায়। চিনের শৈশবও কিন্তু হলুদ। পীতবর্ণে ছয়লাপ। চিনের হলুদ নদী আপনাকে নিয়ে যাবে সভ্যতার শিকড়ে। চিনা সভ্যতার অঙ্কুরোদ্গমে। অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে, হলুদ নদী মানে হোয়াং হো-র তীরে। আর শাসনেরও শুরুতে আছে হলুদ। হলুদ রাজা। কে তিনি? ওই শাসক পুরাণ-মাখা। তাঁর নাম হুয়াং দি। চিনা সংস্কৃতির পিতা হিসেবে ধরা হয় হুয়াং দি-কে। মনে করা হয় চিনা সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা। প্রায় ২,৭০০ খ্রিষ্টপূর্বে এই হুয়াং দি রাজত্ব করতেন। তিনি ছিলেন ধারক-বাহক-রক্ষক। আকাশে ঘুরে বেড়াতেন। মানুষকে কোনও দরকারি শিক্ষা দিতে হলে নামতেন মাটিতে। তাঁর রাজত্বকালের মেয়াদ ছিল একশ বছর। তার পর আকাশ থেকে নেমে হলুদ ড্রাগনরা নেমে তাঁকে আকাশে নিয়ে গিয়েছিল। ফুটফুটে তারা হয়ে গেলেন সেই প্রথম সম্রাট। নাহ, একশো বছর পর দোর্দণ্ড প্রতাপ চিনের কমিউনিস্ট পার্টির টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তা ছাড়া এ তো আর হলুদ নয়, রক্ত-লাল!
ক্ষমতা আরও ক্ষমতা
চিনের প্রবাদপুরুষ মাও জে দং। যেন হয়ে উঠেছিলেন এক হলুদ সম্রাট। জনমানসে তাঁর অসীম গ্রহণযোগ্যতা। আধিপত্য ছিল একচ্ছত্র। দেং জিয়াও পিং এবং শি জিনপিংয়ের ক্ষমতা নিয়েও মিনারস্পর্শী আলোচনা হয়ে থাকে। চিনে ১৩টি রাজবংশ শাসন করেছে, এর মধ্যে আটটি ক্ষমতায় থেকেছে শত বছরের বেশি। তবে, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা এবং তার বিস্তার সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠেছে। শক্তির শিখরে উঠেছে তাদের সামরিকতা, রেড ফৌজ।
একশ বছর আগে, মানে ১৯২১ সাল-- সাংহাই। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করলেন চেন দুজিউ এবং লি দাজাও-- দুই বিপ্লবী। চেন দুজিউকে চিনা লেনিন বলা হত। প্রথমে হয়েছিল ছোট করে আত্মপ্রকাশ। তার পর ওই বছরের ১ জুলাই। প্রথম পার্টি কংগ্রেস। কংগ্রেসে সদস্য ছিলেন ৫৩ জন। তাঁদের মধ্যে মাও জে দং-ও। হুনান কমিউনিস্ট গোষ্ঠী থেকে আসা দু'জনের একজন ছিলেন তিনি মাও। আর রেড ফৌজ? গৃহযুদ্ধ শুরু পর, চাইনিজ ওয়ার্কাস অ্যান্ড পেসেন্ট রেড আর্মি তৈরি হল, ১৯২৮ সালে। যাকে রেড আর্মি বলা হত। গৃহযুদ্ধের শেষ লগ্নে ১৯৪৫-এ গিয়ে রেড আর্মি নতুন চেহারা নিল, নাম হল পিপল'স লিবারেশন আর্মি। পিএলএ। গৃহযুদ্ধ এক রক্তপাতের স্রোত। কুওমিনতাং বা কেএমটির বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম, কুওমিনতাংয়ের সেনার নেতৃত্বে চিয়াং কাই শেক, তীব্র দমনপীড়নের বিরুদ্ধে মাওয়ের লাল ফৌজ। ১৯৩৪ সাল, মাওয়ের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। চিয়াংয়ের ঘেরাটোপ ভেঙে এগিয়ে গেল মাওয়ের দল। ৩৪ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ৩৫-এর ২২ অক্টোবর। চলল সেই এগিয়ে যাওয়া। দীর্ঘ ৬ হাজার মাইল। বহু পর্বত, নদী, বাধা পেরিয়ে যাওয়া। বহু মানুষের প্রাণক্ষয়। মাও-রা পৌঁছলেন গন্তব্যে। গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় ধাপ ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯। কাই শেকের কুওমিনতাংয়ের পরাজয়। পিছু হটে তারা তাইওয়ানে। ১ অক্টোবর, ১৯৪৯। নতুন চিনের জন্ম: পিপল'স রিপাবলিক অফ চায়না, গণপ্রজাতন্ত্রী চিন। তার আগে, ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান হয়েছেন মাও।
চিনে মাওয়ের উত্থান এক রূপকথা। মানুষের উপর তাঁর চরম নিয়ন্ত্রণ। সেই নিয়ন্ত্রণ একের পর এক বিতর্কিত পদক্ষেপের দিকে নিয়ে গিয়েছে মাওকে। কেমন সেই পদক্ষেপ? নতুন চিনের জন্মের পর মাও দেখলেন পাশ্চাত্য দেশগুলির তুলনায় চিন অনেক পিছিয়ে। তাই উন্নয়নে লাফ দেওয়া প্রয়োজন। ১৯৫৮ সালে অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের নীতি নিলেন। মাওয়ের এই পরিকল্পনা পাঁচ বছরের। মাওয়ের বিশ্বাস সমাজবাদী ব্যবস্থাই লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারে, ফলে সেই পথেই অগ্রগতি। কৃষিকাজকে নিয়ে আসা হল পুরোপুরি রাষ্ট্রের অধীনে। যৌথ কৃষিকাজ শুরু, জমির পর জমি মিলিয়ে, জমির বিভাজন তুলে, কমিউন করে চাষাবাদ। লক্ষ্য হল, কৃষিজাত পণ্যের উদ্বৃত্ত অর্থে শিল্পের উন্নয়ন। দলের দু-এক নেতা এর বিরুদ্ধে বললেন, শুনলেন না মাও। পরিকল্পনার চরম অভাবে সব মুখ থুবড়ে পড়ল 'লাফ'। পর পর তিন বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ এল তার উপর, ডেকে আনল ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। খাদ্যাভাবে মৃত্যুমিছিল। ৫৯ থেকে ৬২ সালের মধ্যে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুসংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়েছিল।
সাংস্কৃতিক বিপ্লব
এই ব্যর্থতার পরও মাও বাঁধ মানলেন না। এবার লেনিনের তত্ত্বে হেঁটে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন লক্ষ লক্ষ তরুণ। গড়ে উঠল রেড গার্ড বাহিনী। পুরনো পুঁজিবাদী ধ্যানধারণা উপড়ে ফেলে, সমাজতান্ত্রিক চেতনা তৈরিই এই আন্দোলনের লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত যা চরম দমনপীড়ন এবং তীব্র হিংসাত্মক। রেড গার্ডরা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল।
দেং জিয়াও পিং
মাওয়ের মৃত্যুর পর দেং ক্ষমতার কেন্দ্রে এলেন, দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতা তিনি। তখন কৃষকরা নিজেদের অধিকার ফিরে পেয়েছেন অনেকটা। কৃষিজ পণ্য বিক্রিতে এসেছে কিছুটা স্বাধীনতার হাওয়া। ১৯৭৮ সালে দেশের দরজা খুললেন দেং। বোয়িং চিনকে ৭৪৭ বিমান বিক্রির কথা ঘোষণা করল। কোকাকোলা সাংহাইতে তাদের কারখানা তৈরির ইচ্ছা প্রকাশ করল। বিদেশি বিনিয়োগ এল বিপুল। চিনের অর্থনীতিতে যেন এক ঝলক বাতাস।
যে উদারীকরণের ধ্বজা উড়িয়েছিলেন দেং, তাতে তাঁর হাতও পুড়ল। উদারবাদের ফলে দেশে দুর্নীতি বাড়ল, বাড়ছিল স্বজনপোষণ। সঙ্গে যোগ হল বাক-স্বাধীনতা ও সেন্সরশিপ কমানোর দাবি। ১৯৮৯ সালে বিক্ষোভ শুরু বেজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে। জুনে তা চরম আকারে। সামরিক পদক্ষেপ সরকারের। দেখা গেল সারিবদ্ধ সাঁজোয়া গাড়ি তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে। পরবর্তী কালে একটি গোপন নথি থেকে জানা যায়, এই সামরিক হামলায় মৃত্যুসংখ্যা ১০ হাজার। যদিও চিন বলেছিল, সব মিলিয়ে মৃত ২০০।
দেংয়ের সময় চিনের সংবিধান সংশোধন করা হয়। এর আগে প্রেসিডেন্ট পদটা তুলে দেওয়া হয়েছিল, তা ফেরানো হল, তবে ক্ষমতা কমিয়ে। দু-দফার বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না, লেখা হল সংবিধানে। ভাইস প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রেও একই মেয়াদ। পদ দুটি খানিকটা আলঙ্কারিক। সরকার চালানোর ভার প্রধানমন্ত্রীর, আর চিনা কমিউনিস্ট পার্টি চালাবে চেয়ারম্যান। দেং পিছন থেকে চালাবেন এই তিন জনকে, তিনিই শেষ কথা।
দেংয়ের পর, চিনের ক্ষমতার রাশ গেল জিয়াং জেমিন, হু জিনতাওয়ের হাতে। এঁরা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এর পর শি জিনপিং। ২০১৮-র মার্চে সংবিধান বদল করে তিনি আজীবন প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। চিনা কংগ্রেসে এই সংবিধান বদলের প্রস্তাব ২,৯৫৮ ভোট পেল। দুটি ভোট বিরুদ্ধে পড়েছিল, দু'জন ছিলেন অনুপস্থিত।
একশ বছরের জীবনে চিনা কমিউনিস্ট পার্টিতে কত কিছুই না হল। শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা চোখ ধাঁধানো। যা-ই হোক না কেন, রিংটোন একটাই-- ক্ষমতা, আরও ক্ষমতা, দাও মোরে আরও আরও ক্ষমতা।
Read in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন