আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীদের উপর বাড়তে চলেছে নির্বাচন কমিশনের নজরদারি। এখন থেকে শুধুমাত্র গত এক বছরের নয়, নির্বাচনী প্রার্থীদের গত পাঁচ বছরের আয়কর জমা দেওয়ার হিসাব প্রকাশ করতে হবে। জানাতে হবে দেশের বাইরে থাকা সম্পত্তিরও বিস্তারিত তথ্য। কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক ২৬ নম্বর ফর্মের সংশোধন করে গত সপ্তাহে এই মর্মে নির্দেশিকা জারি করেছে। নির্বাচন কমিশন এই বিষয়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রকে চিঠি লেখার পরই জারি হয়েছে ২৬ নম্বর ফর্ম সংক্রান্ত এই সংশোধনী।
কী এই ২৬ নম্বর ফর্ম?
ফর্ম ২৬ আদতে একটি এফিডেভিট বা ওকালতনামা, যাতে যে কোনও নির্বাচনী প্রার্থীকে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পূর্ব-অপরাধের কোন ইতিহাস আছে কিনা, সরকারের কাছে কোন বকেয়া ঋণ আছে কিনা ইত্যাদি জানাতে হয়। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে এই ওকালতনামা দাখিল করতে হয় এবং সেটা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের বা নোটারি পাবলিকের প্রথাসিদ্ধ আইনি মধ্যস্থতায়।
সংশোধনীতে কী বদল এল?
আগে প্রার্থীদের শুধু নিজের, স্ত্রী/ স্বামীর এবং তাঁর উপর নির্ভরশীল পরিবারের অন্য সদস্যদের শুধুমাত্র গত এক বছরের আয়কর জমা দেওয়ার হিসাব দিলেই চলত ফর্ম ২৬-এ। এখন থেকে দিতে হবে গত পাঁচ বছরের হিসাব।
বিদেশে থাকা সম্পত্তির হিসাব এতদিন দিতে হত না প্রার্থীদের। এখন থেকে দিতে হবে। আইন মন্ত্রকের ২৬ ফেব্রুয়ারির নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রবাসে থাকা সম্পত্তির আওতায় পড়বে বিদেশি ব্যাংকে জমা রাখা টাকা এবং বিদেশে যাবতীয় বিনিয়োগের হিসাব। নিয়মটি প্রযোজ্য হবে প্রার্থীর স্ত্রী/ স্বামী এবং প্রার্থীর উপর নির্ভরশীল পরিবারের অন্য সদস্যদের ক্ষেত্রেও।
কেন প্রয়োজন এই বাড়তি তথ্য? ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্থেই এই সংশোধনী। ভোটাররা জানতে পারবেন, প্রার্থীর কোনরকম অপরাধের পূর্ব-ইতিহাস আছে কিনা। জানতে পারবেন গত পাঁচ বছরে প্রার্থীর সম্পত্তি বৃদ্ধির খতিয়ান।
কবে চালু হয়েছিল এই ফর্ম ২৬?
আইনি নির্দেশে ২০০২-এর ৩ সেপ্টেম্বর চালু হয়েছিল ফর্ম ২৬ সংক্রান্ত নিয়ম। এই নির্দেশের উৎস ১৯৯৯-এর মে মাসে ১৭০ তম 'আইন আয়োগ'-এর একটি রিপোর্ট, যাতে অপরাধীদের নির্বাচনী ময়দানে প্রবেশ রুখতে প্রার্থীদের অপরাধের পূর্ব ইতিহাস এবং সম্পত্তির হিসাব দাখিলের সুপারিশ করা হয়েছিল।
তৎকালীন সরকার এই সুপারিশ কার্যকর করেনি। যার ফলে ১৯৯৯-এর ডিসেম্বরে একটি জনস্বার্থ মামলা রুজু হয় দিল্লি হাইকোর্টে। ২০০০-এর ২ নভেম্বর আদালত নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেন প্রার্থীদের অপরাধ-সংক্রান্ত ইতিহাস এবং সম্পত্তির পরিমান বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে।
কেন্দ্রীয় সরকার এই নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি হাইকোর্টের সঙ্গে সহমত হয়ে আরও এক ধাপ এগোয়। ২০০২-এর ২ মে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেয়, প্রার্থীদের সম্পত্তির পরিমান ছাড়াও তাঁরা মনোনয়নপত্র দাখিলের ছয় মাস আগে পর্যন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে কোন তদন্তাধীন মামলা রুজু হয়েছে কিনা, সে নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে। এবং আরও পুরোনো কোনও অপরাধের মামলায় যুক্ত থাকলে সেই মামলার কীভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে,তা নিয়েও তথ্য জোগাড় করতে। সম্পত্তির পরিমান এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের নির্দেশও বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট।
২০০২-এর ২৮ জুন নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ কার্যকর করে। কিন্তু এর দুই মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে 'রিপ্রেজেন্টেশন অফ দ্য পিপল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স ২০০২' জারি করে সংশোধনী আনে। যাতে বলা হয়, একজন প্রার্থী শুধু এটুকুই জানাতে বাধ্য থাকবেন যে দুই বছরের বেশি কারাদণ্ড হতে পারে, এমন কোন মামলা তাঁর বিরুদ্ধে আছে কিনা যাতে চার্জশিট জমা পড়েছে আদালতে। এছাড়া কোন মামলায় এক বছরের বেশি কারাদণ্ড ভোগ করেছেন কিনা। ২০০২-এর সেপ্টেম্বরে এই মর্মে 'ইলেকশন কন্ডাক্ট রুলস ১৯৬১'-তেও বদল আনে সরকার।
সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনী বাতিল করে দেয় এবং ২০০৩-এর ২৭ মার্চ জারি করা এক নির্দেশে ২০০২-এর ২ মে-র নিৰ্দেশটিই বহাল রাখে।
এফিডেভিটে মিথ্যে বললে কী হতে পারে প্রার্থীর?
রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা করা ফর্ম ২৬ খতিয়ে দেখা। ফর্মটি সম্পূর্ণভাবে ভর্তি না করলে মনোনয়ন বাতিলও হতে পারে।
যদি কোনো নির্বাচিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ফর্ম ২৬-এ সত্য গোপনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাঁর নির্বাচন অবৈধ বলে ঘোষিত হবে।এবং এই মিথ্যাচারের শাস্তি হতে পারে ছয় মাস অবধি কারাদণ্ড বা জরিমানা, অথবা দুটোই।
ফর্ম ২৬-এ সত্য গোপনের দায়ে আজ পর্যন্ত কারও শাস্তি হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে। বিহারের সাসারাম কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ ছেদি পাসোয়ান ফর্ম ২৬-এ তাঁর বিরুদ্ধে চলতে থাকা একটি ফৌজদারি মামলার কথা গোপন করার দায়ে লোকসভার সদস্যপদ হারান ২০১৬ সালে, পাটনা হাইকোর্টের নির্দেশে। পাসোয়ান ২০১৪ সালে হারিয়েছিলেন প্রাক্তন লোকসভা স্পিকার মীরা কুমারকে। সুপ্রিম কোর্ট পাটনা হাইকোর্টের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে, কিন্তু লোকসভায় তাঁর ভোটাধিকার কেড়ে নেয় বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত।