ভারতীয় নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় নির্দেশ দিয়েছে যে একনাথ শিণ্ডে শিবির শিবসেনার আসল নাম এবং দলের 'ধনুক ও তীর' প্রতীক পাবে। আর, উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী তাদের অন্তর্বর্তী দলীয় নাম শিবসেনা ইউবিটি (শিবসেনা উদ্ধব ঠাকরে) এবং তার নির্বাচনী জ্বলন্ত মশাল প্রতীক রাখতে পারবে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে তেমনটাই খবর বেরিয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি মহারাষ্ট্রের কসবা পেঠ এবং চিঞ্চওয়াড়ে বিধানসভায় উপনির্বাচন। তার আগে এই নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
কমিশনের নির্দেশ
নির্বাচন কমিশন তার ৭৮ পৃষ্ঠার নির্দেশে জানিয়েছে যে শিবসেনার বর্তমান সংবিধান 'অগণতান্ত্রিক'। কোনও নির্বাচন ছাড়াই অগণতান্ত্রিকভাবে একটি গোষ্ঠীর লোকেদের পদাধিকারী নিয়োগ করা হয়েছে। এই ধরনের দলীয় কাঠামো আস্থা অর্জনে ব্যর্থ। এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবরে, কমিশন শিবসেনার প্রতীক এবং দলের নাম ফ্রিজ করেছিল। আর, দলের দুই বিবাদমান গোষ্ঠীকে নতুন অন্তর্বর্তী নাম এবং প্রতীক দিয়েছিল। একমাস পরে, উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী কমিশনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে একটি আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু, সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আদালত।
কে প্রতীক পাবে কমিশন কীভাবে সিদ্ধান্ত নিল?
যখন আইনসভার বাইরে একটি রাজনৈতিক দলে বিভাজন ঘটে, তখন বিভাজিত গোষ্ঠীগুলোর সকলেই দলের প্রতীক দাবি করে। আর, এজন্য নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়। কমিশন তখন ১৯৬৮ সালের প্রতীক সংক্রান্ত নির্দেশ খতিয়ে দেখে। এই নির্দেশের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, কমিশন যাবতীয় পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবে। সমস্ত তথ্য বিচার করবে। সমস্ত পক্ষের প্রতিনিধিদের কথা শুনবে। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। কমিশন মনে করতেই পারে, বিবাদমান গোষ্ঠী আর যে দল ভেঙে গোষ্ঠীগুলোর জন্ম হয়েছে, তা এক নয়। কমিশন যা সিদ্ধান্তই নিক, তা হবে নিরপেক্ষ। আর, সেই নির্দেশ বিবাদমান গোষ্ঠীগুলোকে মানতে হবে।
অতীতে কী হয়েছিল?
এই নিয়ম নথিবদ্ধ রাজ্যভিত্তিক দল বা জাতীয় দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু, নথিভুক্ত অথচ স্বীকৃত নয়, এমন দলে বিভাজনের ক্ষেত্রে কমিশন বিবাদ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মিটিয়ে নিতে বলে। অথবা, আদালতের দ্বারস্থ হতে বলে। ১৯৬৮ সালের এই আদেশের ভিত্তিতে কমিশনের কাছে প্রথম বিচারের জন্য এসেছিল কংগ্রেসের বিবাদমান গোষ্ঠী। সেটা ১৯৬৯ সাল। সেই সময় কে কামরাজ, নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, এস নিজলিঙ্গপ্পা ও অতুল্য ঘোষের মত পুরোনো নেতারা ইন্দিরা গান্ধীকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। সেই সময় কংগ্রেস দুটো ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। একটি ভাগ ছিল নিজলিঙ্গাপ্পার নেতৃত্বাধীন পুরোনো কংগ্রেস বা কংগ্রেস (ও)। আর, নতুন কংগ্রেস বা কংগ্রেস (জে)। যার নেতৃত্বে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। পুরোনো কংগ্রেসকে দলের প্রতীক জোয়াল বহনকারী জোড়া বলদ দেওয়া হয়েছিল। নতুন কংগ্রেসকে দেওয়া হয়েছিল নতুন প্রতীক গাভীর সঙ্গে বাছুর।
১৯৬৮ সালের আগে কী হয়েছিল?
১৯৬৮ সালের আগে, নির্বাচন কমিশন ১৯৬১ সালের নির্বাচনী আইনের অধীনে বিজ্ঞপ্তি আর কার্যনির্বাহী নির্দেশ জারি করত। সেই সময় ১৯৬৪ সালে সিপিআই ভেঙে দলের কিছু নেতা-কর্মী সিপিএম তৈরি করেন। তাঁরা স্বীকৃতি চেয়ে কমিশনের দ্বারস্থ হন। অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গের বিধায়ক এবং সাংসদদের একটি তালিকা সিপিএম কমিশনকে দিয়েছিল। দাবি করেছিল, এই সব বিধায়ক এবং সাংসদদের সমর্থন তাদের সঙ্গে আছে। কমিশন সিপিএমকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কারণ, দেখা যায় যে তিন রাজ্যের মোট ভোটের সংখ্যা চার শতাংশেরও বেশি।
সংখ্যাগরিষ্ঠতাই তাহলে স্বীকৃতির ভিত্তি?
এখনও পর্যন্ত এই ধরনের প্রায় সব বিবাদে দলীয় প্রতিনিধি, দলীয় আধিকারিক, সাংসদ এবং বিধায়কদের সমর্থনকেই কমিশন গুরুত্ব দিয়েছে। শিবসেনার ক্ষেত্রে, দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিকাংশই শিণ্ডের পক্ষ নিয়েছেন। দলের আধিকারিকরা কে কার পক্ষে, তা অবশ্য কমিশন বিচার করতে পারেনি। কারণ, দলে পদাধিকারীদের দু'রকম তালিকা বিবাদমান দুই গোষ্ঠী দিয়েছে। শুধুমাত্র বিধায়ক ও সাংসদদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেই তাই কমিশন সমর্থনের বিষয়টি বিচার করেছে।
কোনও গোষ্ঠী প্রতীক না-পেলে কী হবে?
প্রথমে কংগ্রেসে বিভাজনের ক্ষেত্রে, নির্বাচন কমিশন পুরোনো কংগ্রেস বা কংগ্রেস (ও) এবং নতুন কংগ্রেস উভয়কেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। নতুন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন বাবু জগজীবন রাম। কমিশনের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ, কিছু রাজ্যে কংগ্রেস (ও)-এর যথেষ্ট উপস্থিতি ছিল। যার জেরে প্রতীক আদেশের অনুচ্ছেদ ৬ ও ৭-এর অধীনে দলগুলোর স্বীকৃতির ক্ষেত্রে নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করেছিল। ৬৮ সালের এই নীতি কমিশন ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল। তারপর কংগ্রেস, জনতা দলের মত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভাজনের সময় এই নিয়ম কমিশন পরিবর্তন করে। এই সময়ই গড়ে ওঠে সুখ রাম এবং অনিল শর্মার হিমাচল বিকাশ কংগ্রেস, নিপামাচা সিংয়ের মণিপুর রাজ্য কংগ্রেস, মমতা ব্যানার্জির পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস, লালু প্রসাদের আরজেডি, নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দল।
আরও পড়ুন- মোদীর নিন্দা করে ফের শিরোনামে জর্জ সোরোস, বিজেপির নিশানায় কে এই ধনকুবের?
নিয়ম বদলের কারণ, নির্বাচন কমিশন মনে করছে যে শুধুমাত্র একটা গোষ্ঠীর সঙ্গে যথেষ্ট সাংসদ এবং বিধায়ক থাকাই যথেষ্ট নয়। কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের অবিভক্ত দলের টিকিটে নির্বাচনে লড়াই করেছেন এবং জিতেছেন। তাই কমিশন একটি নতুন নিয়ম চালু করেছে। যার অধীনে, বিচ্ছিন্ন গ্রুপকে একটি পৃথক দল হিসেবে নিজেকে নথিভুক্ত করতে হবে। আর, পরবর্তীতে রাজ্য এবং কেন্দ্রে তাদের নির্বাচনী ফলাফলের ভিত্তিতে রাজ্য বা জাতীয় দলের মর্যাদা দাবি করতে পারবে।
Read full story in English