Advertisment

বিদেশি অর্থে বড় বাধা, এনজিও-রা অথৈ সাগরে, কী ভাবে?

মিশনারি অফ চ্যারিটিজের এফসিআরএ বাতিলের পর কংগ্রেস সরব হয়েছিল, এই আইনটা কিন্তু ইন্দিরা গান্ধির বানানো।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

২০১২ সালে মনমোহন সিং সরকার অন্তত ৪ হাজার এনজিও-র রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছিল।

অর্থলাভে বিদেশ নাস্তি! মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টেও কোনও রকম স্বস্তি পায়নি এনজিওগুলি। ৬ হাজারের মতো এনজিও-কে এ ব্যাপারে সরকারের কাছে যেতে বলে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।  এনজিও গ্লোবাল পিস ইনিসিয়েটিভ শীর্ষ আদালতের কাছে আর্জি জানিয়েছিল বিদেশি অনুদানের পথটি অনর্গল রাখা হোক মহামারিকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত। যে কথা মানেনি আদালত। এফসিআরএ বা ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন অ্যাক্ট, বিদেশি অনুদান পেতে গেলে যে আইনে ছাড়পত্র পেতে হয়। ৫,৯০০-র মতো এনজিও সেই ছাড়পত্রের নবীকরণ করতে পারেনি-- তাদের এই রেজিস্ট্রেশনের শেষ দিন ছিল গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। 

Advertisment

মাদার টেরিজার মিশনারিজ অফ চেরিটিসের ভাগ্য অবশ্য সেই হিসেবে ভাল। কিছু গর্হিত তথ্য মিলেছে, এমন কারণ দেখিয়ে মাদারের সংস্থার এফসিআরএ রেজিস্ট্রেশন নবীকরণ প্রথমে করেনি কেন্দ্র। ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ এই খবরে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়। তার পর কিছু নথি জমা দেওয়া হয় ওই সংস্থার তরফে, এবং ৬ জানুয়ারি তাদের কাঙ্ক্ষিত নবীকরণ হয়েছে। এফসিআরএ-র যে সার্টিফিকেট তারা পেয়েছে, তার মেয়াদ নিয়মানুযায়ী ২০২৬ সাল পর্যন্ত।

এফসিআরএ কী?

মিশনারি অফ চ্যারিটিজের এফসিআরএ বাতিলের পর কংগ্রেস সরব হয়েছিল, এই আইনটা কিন্তু ইন্দিরা গান্ধির বানানো। জরুরি অবস্থার সময়ে, ১৯৭৬ সালে। কারণ, তৎকালীন ইন্দিরা সরকারের ভিতরে ভয় ঢুকে পড়েছিল যে, বিদেশি ক্ষমতা এ দেশের কার্যকলাপে নাক গলাতে পরে, এবং সেই জন্য অর্থ ঢোকাতে পারে। সংসদে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল ১৯৬৯ সালের শুরুতে। এখন বিদেশি অনুদান পেতে গেলে এই কড়া খাতুতে তৈরি আইনের ছাড়পত্র পেতে হয়। যাতে দেশের দেশে কোনও আঁচ না আসে, তাই এই ব্যবস্থা। এই ছাড়পত্র পাবে না কারা? এই আইন বলছে, এ দেশের ভোট-প্রার্থী, সাংবাদিক, সংবাদপত্র, খবরের চ্যানেল, আইনজীবী, সরকারি আধিকারিক, আইনসভার সদস্য এবং রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনৈতিক সংগঠন অথবা তাদের আধিকারিক-- এরা বিদেশি অনুদান নিতে পারবে না।

কী ভাবে এফসিআরএ রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়?

এনজিওগুলিকে অন-লাইনে এফসিআরএ-র জন্য আবেদন করতে হয়, প্রয়োজনীয় নথিপত্র সহ। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষামূলক, ধর্মমূলক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে এফসিআরএ-র ছাড়পত্র দেওয়া হয়ে থাকে। কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তা পায়। আবেদনের পর আইবি-র মাধ্যমে আবেদনকারীর কাজকর্ম খতিয়ে দেখা হয়। কোনও ভুয়ো বা বেনামি সংস্থার আবেদন যাতে গ্রাহ্য না হয়ে যায়, সে দিকে প্রখর নজর রাখা হয়। আবেদনকারী কোনও ভাবেই প্রত্যক্ষ বা পারোক্ষে ধর্মান্তরণে অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত হতে পারবে না। যদি আবেদনকারী সাম্প্রদায়িক অশান্তিতে অভিযুক্ত বা দোষী হয়ে থাকে, তা হলেও আবেদন অগ্রাহ্য হবে। কিংবা দেশদ্রোহ সংক্রান্ত কিছু করলেও একই হাল হবে। যদি দেখা যায় আবেদনকারী আবাঞ্ছিত উপায়ে তহবিলের অর্থ খরচ করেছে, তবেও পত্রপাঠ খিড়কি দেখানো হয়ে থাকে তাকে। 

৯০ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ওই আবেদন গ্রহণ করে বা বাতিল করে দেয়। যদি দেখা যায় এই সময়সীমার মধ্যে তা হচ্ছে না, তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে তার কারণ সংশ্লিষ্ট এনজিও-কে জানিয়ে দিতে হয়।

কত সময়ের জন্য ছাড়পত্র মেলে?

এফআরসিএ-র এই ছাড়পত্র মেলে পাঁচ বছরের জন্য। সময়সীমা শেষ হওয়ার পর ছ'মাসের মধ্যে এনজিওগুলি আবেদন করতে পারে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। আবেদন না করতে পারলে স্বাভাবিক ভাবেই ছাড়পত্রটি সংস্থাটিকে ছেড়ে চলে যায়। ফলে কোনও রকম বিদেশি অনুদান আর পেতে পারে না।

যে ৫,৯০০টি এনজিও-র রেজিস্ট্রেশন পুনর্নবীকরণ হয়নি, তাদের মধ্যে রয়েছে অক্সফাম ইন্ডিয়া ট্রাস্ট এবং ইন্ডিয়ান মেডিকাল অ্যাসোসিয়েশন। মানে, এদের এই সংক্রান্ত লাইসেন্স ল্যাপস হয়ে গিয়েছে গত বছরের শেষ দিনে। সূত্রের খবর, ৫,৭৮৯টি এনজিও রেজিস্ট্রেশন তামাদি হয়ে যায়, কারণ তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন করতে পারেনি। বাকিদের ছাড়পত্র বাতিল হওয়ার কারণ হল, তারা এফআরসিএ-র নিয়ম লঙ্ঘন করেছে।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, যে সব এনজিও সময়সীমার মধ্যে দরখাস্ত করতে পারেনি, তারা উপযুক্ত কারণ দর্শিয়ে চার মাসের মধ্যে আবেদন করতে পারবে। কিন্তু কেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এতগুলো এনজিও আবেদন করতে পারল না। জানা যাচ্ছে, এর কারণ নানাবিধ। একটি হল, যে প্রকল্পের জন্য বিদেশি অর্থ আনা, তা শেষ না হওয়া।

কী প্রেক্ষিতে আবেদন বাতিল হয়েছে?

কেন্দ্রীয় সরকার যদি দেখে কোনও একটি এনজিও আইন ভঙ্গ করেছে, তা হলে আবেদন অগ্রাহ্য করার অধিকার দিয়েছে আইনই। আবেদনের পর যে খোঁজখবর নেওয়া হয়, তাতে লুকিয়ে রয়েছে বাতিল করার কারণ। কোনও এনজিও টার্ম অ্যান্ড কন্ডিশন্স বা নির্ধারিত নিয়মাবলির কোনওটি ভঙ্গ করলেই পুনর্নবীকরণের আবেদন মানবে না কেন্দ্র। তবে আবেদন-বিদায়ের আগে সংশ্লিষ্ট এনজিও-র থেকে বক্তব্য শোনার কথাও বলেছে এফসিআরএ। বাতিল এক বার হয়ে গেলে, তিন বছরের জন্য কেস পুরো গল্প। মানে তিনটি বছর রি-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ মিলবে না। এ ছাড়াও কেন্দ্র তদন্তের প্রয়োজনে রেজিস্ট্রেশন ১৮০ দিনের জন্য সাসপেন্ড করে দিতে পারে, এবং তাদের তহবিল ফ্রিজ করে দিতে পারে। তবে সরকারের নির্দেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে আইন।

এফসিআরএ লঙ্ঘনের অভিযোগ কাদের বিরুদ্ধে?

বহু আন্তর্জাতিক এবং নামী এনজিও-র বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। কমপ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল, গ্রিনপিস ইন্ডিয়া, সবরং ট্রাস্ট, লইয়ার্স কালেক্টিভ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশন রয়েছে এই তালিকায়। আর্থিক অনিয়ম বা রাজনৈতিক কাজকর্মের অভিযোগ উঠেছে এদের অনেকেরই বিরুদ্ধে। ২০২০ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সব অফিস এ দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৮ সাল থেকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-র তদন্তের নিরিখে এই কাজটি করা হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল স্বাভাবিক ভাবেই এর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। মানবাধিকার কর্মীদের শেষ করছে সরকার, প্রতিবাদের স্বরকে দমন করছে, বলে অ্যামনেস্টি। ২০১৫-তে এফসিআরএ বাতিল হয়ে যাওয়ার পর গ্রিনপিস ইন্ডিয়া তাদের কাজকর্ম কমিয়ে দেয়। 

আইনজীবী ইন্দিয়া জয়সিংয়ের এনজিও লইয়ার্স কালেক্টিভের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত হচ্ছে। ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সক্রিয়তার অভিযোগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তাদের এফআরসিএ লাইলেন্স বাতিল করে দেয়।

মানবাধিকার কর্মী তিস্তা তলোয়ারের এনজিও সবরং ট্রাস্টের এফসিআরএ রেজিস্ট্রেশন বাতিলের কারণ হল, বিদেশি ও দেশি তহবিল মিশিয়ে ফেলা। এবং সেই অর্থ তাদের কমিউনালিজম কমব্যাট পত্রিকা প্রকাশে খরচ করারও অভিযোগ রয়েছে।

২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে মুঠো শক্ত করে। তারা এ দেশের যে সব সংস্থাকে অর্থ পাঠাতে চাইছে, তাদের সম্পর্কে মানে তাদের নাম-ধাম আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে জানাতে হবে, জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এবং মন্ত্রক গ্রিন সিগনাল দিলেই ওই অর্থ পাঠানো সম্ভব হবে যথা জায়গায়। জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে এই সংস্থাটিকে কিছু সময়ের জন্য ওয়াচ লিস্টেও রাখে কেন্দ্রীয় সরকার। আর ২০১৬ সালে ধর্মান্তরণের অভিযোগে কমপ্যাশন ইন্টারন্যাশনালকে ঘাড় ধাক্কা দেয় তারা।

এফসিআরএ-র মাধ্যমে কি এনজিওগুলিকে টার্গেট করা হচ্ছে?

২০১১ সাল পর্যন্ত এফসিআরএ-তে রেজিস্ট্রেশন ছিল ৪০ হাজার এনজিও-র। যা কমে হয়েছে ১৬ হাজার। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই আইন ব্যবহার করে এনজিওগুলির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত, এমন অভিযোগ উঠেছে কয়েক বছর ধরেই। গত সাত বছরে নরেন্দ্র মোদীরা খারিজ করে দিয়েছেন ১৬, ৭০০ এনজিও-র এ সংক্রান্ত রেজিস্ট্রেশন। শুধু ২০১৫ সালেই সংখ্যাটি ছিল ১০ হাজার। ইউপিএ জমানাতেও এনজিএ-র বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হয়েছে। তামিলনাড়ুর কুদানকুলাম পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জেরে এমনটা হয়েছে। ২০১২ সালে মনমোহন সিং সরকার অন্তত ৪ হাজার এনজিও-র রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছিল। ইউপিএ সরকারের সময়তেই প্রথম গ্রিনপিস ইন্ডিয়া আতসকাচের নীচে আসে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ করেছিল তারা।

FCRA works
Advertisment