Advertisment

Explained: মাত্র দুই সপ্তাহেই আত্মসমর্পণ, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের বিজয়, রূপকথার ইতিহাস

১৬ ডিসেম্বর, ঢাকা ঘেরাওয়ের আধঘণ্টার মধ্যে মাথানত করে পাক বাহিনী।

IE Bangla Web Desk এবং Chinmoy Bhattacharjee
New Update
1971-Surrender

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সামনে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজি। (এক্সপ্রেস আর্কাইভ)

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজি, ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি-ইন-সি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএস অরোরার উপস্থিতিতে ঢাকায় আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর করেন। এটি একটি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়।

Advertisment

মাত্র ১৩ দিন স্থায়ী হয়েছিল

এই লড়াই আনুষ্ঠানিকভাবে মাত্র ১৩ দিন স্থায়ী হয়েছিল। পাকিস্তান দুই ভাগ হয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আনুমানিক ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সেনাকে যুদ্ধবন্দি করেছিল। যা ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনও বাহিনীর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ। এই বিজয়ের সঙ্গেই উপমহাদেশে শক্তির ভারসাম্য দৃঢ়ভাবে এবং চিরতরে ভারতে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ভারতের সশস্ত্র বাহিনী কীভাবে দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে এমন অপ্রতিরোধ্য বিজয় নিশ্চিত করল?

ব্যাপক অত্যাচার

যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে। কিন্তু, ১৯৪৭ সাল থেকেই পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। আর, ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২৫ মার্চ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। যার লক্ষ্য ছিল পূর্বের সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধিতাকে দমন করা। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের পাশাপাশি, অভিযানটি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ এবং বাঙালি হিন্দুদেরও লক্ষ্যবস্তু করেছিল। ব্যাপকহারে, নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। যে কোনও জায়গায় ৩০০,০০০ (তিন লক্ষ) থেকে ৩০ লক্ষ বাঙালি নিহত হন। প্রায় এক কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু ভারতে পালিয়ে আসেন।

বাঙালির বিদ্রোহ

এই বেপরোয়া হিংসা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে আরও উসকে দিয়েছিল। বাঙ্গালি সাধারণ নাগরিক ও সামরিক লোকেরা পালটা লড়াই শুরু করে। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করে। সাধারণ নাগরিকরা পাক সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে অস্ত্রের ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এইভাবে মুক্তিবাহিনী নামে গড়ে ওঠে একটি গেরিলা যোদ্ধা বাহিনী। যা, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মধ্যে মোটামুটিভাবে সংগঠিত হয়েছিল। যার মধ্যে সাধারণ নাগরিকের পাশাপাশি, পাক সেনার বিদ্রোহীরাও ছিলেন।

মুক্তিবাহিনীর লড়াই

১৯৭১ সালের মধ্যে, মুক্তিবাহিনী গ্রামাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নেয়। সফলভাবে হামলা চালায়। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তিক্ততায় ঠেকে। কারণ, সংকটের কারণে বাংলা ও অসমে উদ্বাস্তু সমস্যা বেড়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়। এই প্রতিরোধ আন্দোলনকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। এইভাবে, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধ চলতে থাকে। এতে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা, ১৯৭১ সালের আনুষ্ঠানিক ভারত-পাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ছিল।

দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল

যদিও ভারত সরকারের কিছু পরিসংখ্যান দাবি করে যে এপ্রিলের প্রথম দিকেই তাৎক্ষণিক সামরিক হস্তক্ষেপ চেয়েছিল সরকার। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে ভারতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বিলম্বিত হয়। চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত ভারত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ (২০২১)-এ লিখেছেন, 'পূর্ব বাংলায় ভারতের দ্রুত অগ্রসর হওয়া বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের উচ্চতর রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করত না।' ভারতে অনেকেই আশঙ্কা করেছিল যে তাড়াহুড়ো করে ভারতীয় হস্তক্ষেপ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিনে বাংলাদেশের মধ্যে যে সহানুভূতি জাগিয়েছিল, তা নষ্ট করে দেবে। এইভাবে, ভারত প্রথমে বাঙালি প্রতিরোধের বৈধতা এবং অস্থায়ী বাংলাদেশি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, যা কলকাতা থেকে পরিচালিত হয়েছিল।

দেরিতে অভিযান কাজে দিয়েছিল

পাশাপাশি, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা কৌশল পাকিস্তানকে চূড়ান্ত আক্রমণের আগে বিধ্বস্ত করার জন্য ছিল নিখুঁত পরিকল্পনা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এপ্রিলের দিকে ভারত তার পূর্ব ফ্রন্টে পাকিস্তানের সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। বদলে, পশ্চিমে পাকিস্তানের মোকাবিলা, উত্তরে চিনা আগ্রাসন রোখা আর উত্তর-পূর্বে বিদ্রোহ মোকাবিলাই ছিল ভারতের প্রথম লক্ষ্য। চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের জন্য ভারতের অপ্রস্তুত থাকা আরও স্পষ্ট করেছিল একটি ঘটনা। তা হল, ইস্টার্ন কমান্ড যখন এপ্রিল মাসে তার অভিযানের পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করতে শুরু করে, তখন দেখে যে পূর্ব পাকিস্তানের যে মানচিত্রগুলো তাদের কাছে আছে, তা পঞ্চাশ বছরেরও বেশি পুরোনো। যা পাকিস্তান তৈরির আগেকার।' বলা ভালো ব্রিটিশ রাজত্বের সময়ের। এইভাবে, ভারত বাস্তবে যুদ্ধে প্রবেশের আগে পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতিতে কয়েক মাস ব্যয় করেছিল। এই সময় ব্যয় অবশেষে কাজে দেয়। যুদ্ধ শুরু হলে, ভারতের সামরিক পরিকল্পনা প্রায় নিখুঁতভাবে কাজে লাগানো হয়।

সীমান্তে গোলাবর্ষণ বেড়েছিল

যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৩ ডিসেম্বর। সেই সময় পাকিস্তান আটটি ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে অগ্রিম বিমান হামলা চালায়। সেই সন্ধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রেডিওয় যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। পাকিস্তানিরা খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি বন্দরে আকস্মিক হামলা চালিয়ে গুরুতর প্রভাব ফেলে। পূর্ব পাকিস্তানে নৌপথে সরবরাহ এবং শক্তিবৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়। পাক বিমানবাহিনী যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ভারতীয় বায়ুসেনার কাছে পরাজিত হয়। স্থলভাগে, ভারতীয় সেনা পূর্বে ব্লিটজক্রেগ কৌশল অবলম্বন করে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একইসঙ্গে, পশ্চিমে পাকিস্তানকে আক্রমণ বন্ধ করতে বাধ্য করে।

আরও পড়ুন- মথুরার শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস! জানলে গায়ে কাঁটা দেবে

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ

রিচার্ড সিসন এবং লিও ই রোজ তাঁদের ক্লাসিক যুদ্ধ এবং বিচ্ছিন্নতা: পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ সৃষ্টি (১৯৯০)-তে লিখেছেন, ভারত আঞ্চলিকভাবে লাভবান হয়েছিল। বিশেষ করে, 'পূর্ব ফ্রন্টে ভারতীয় সেনা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। ভারতের বাহিনী ছিল যথেষ্ট বড়। নয়াদিল্লির কাছে ছিল উন্নত অস্ত্র। আকাশ এবং সমুদ্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও ছিল ভারতের হাতে। বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে থাকা পাকিস্তানি বাহিনী বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাদের সরবরাহ পর্যাপ্ত ছিল না। উলটে জনগণ তাদের বিরুদ্ধে ছিল। মুক্তিবাহিনী এবং আওয়ামি লিগের মাধ্যমে ভারত অনেক সুবিধা পেয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা ঘেরাও করার পর, ভারতীয় সেনাবাহিনী আধঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে হবে বলে চূড়ান্ত সময়সীমা দিয়েছিল। জয়ের আশা দেখতে না-পেয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি সেই শর্ত মানতে বাধ্য হন।'

India army pakistan
Advertisment