Advertisment

কীভাবে করোনাভাইরাসের অকুস্থল থেকে ফেরানো হল ভারতীয়দের?

য়ুহান থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। করোনাভাইরাস প্রকোপের কেন্দ্র থেকে এই ফিরিয়ে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া ছিল জটিল, সব দিক থেকেই। কীভাবে সম্ভব হল সে দুঃসাধ্য ব্যাপার?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Coronavirus Airlift

দিল্লি বিমানবন্দরে তৈরি মেডিক্যাল টিম

গত সপ্তাহের শেষে ৬৪৭ জন ভারতীয় ও ৭ জন মালদ্বীপের নাগরিক, মোট ৬৫৪ জনকে দুটি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে করে নভেল করোনাভাইরাস প্রকোপের অকুস্থল য়ুহান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। ৯৬ ঘণ্টার জটিল এই অপারেশনের জন্য নয়া দিল্লির সঙ্গে বেজিংয়ের বহু পর্যায়ে কথা বার্তা বলতে হয়েছে। নিশ্চিত কিছু স্বাস্থ্যসম্পর্কিত ঝুঁকি ছিল গোটা বিষয়টিতে, তা ছাড়াও অতিক্রম করতে হয়েছে লজিস্টিক সমস্যা এবং কূটনৈতিক বিষয় যা অতীব সংবেদনশীল।

Advertisment

 প্রাথমিক উদ্বেগ

বেজিংয়ের দূতাবাস এই সংক্রমণ বিষয়ে প্রাথমিক রিপোর্ট পায় ২-৩ জানুয়ারি নাগাদ। কিন্তু তখনই ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝা যায়নি। ২০ জানুয়ারি, চিনা সংবাদমাধ্যমে যখন বিষয়টি জাতীয় সংবাদ হয়ে উঠল, তখন বোঝা গেল এর প্রকোপের পরিমাণ কীরকম।

২২ জানুয়ারি, যখন ৫৭১ জনের সংক্রমণ ও ১৭ জনের মৃত্যুর নিশ্চয়তা মিলল, সে সময়ে চিনে ভারতীয় দূতাবাসের বিক্রম মিস্ত্রি তাঁর সঙ্গীদের বলেন, হুবেই প্রদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে প্রস্তুত থাকতে হবে। এর পরদিন সাধারণতন্ত্র দিবস পালনের উদ্দেশ্যে দূতাবাসে আয়োজিত একটি কর্মসূচিতে সহ বিদেশমন্ত্রী লুয়ো জাওহুয়ি যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন চিনের অন্যরাও। ওই সম্মিলনে কিছু উদ্বিগ্ন কথোপকথন হয়েছিল বলে জানিয়েছেন সেখানে উপস্থিত কিছু সূত্র।

ভারতীয়দের চিহ্নিতকরণ

সবচয়ে বড় সমস্যা ছিল হুবেই প্রদেশে কতজন ভারতীয় রয়েছেন এবং কোথায় রয়েছেন তা খুঁজে বের করা। ওই প্রদেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষের বাস, এবং চিনে ভারতীয়দের দূতাবাসে নথিভুক্তির প্রয়োজন হয় না।

এর পর কয়েক দিন সোশাল মিডিয়ায় ভারতীয় দূতাবাসের পক্ষ থেকে হেল্পলাইন নম্বর ঘোষণা করা হতে থাকে। কিন্তু চিনে ফেসবুক ও টুইটার ব্লকড, ফলে সে নম্বর বেশিজনের কাছে পৌঁছতে পারেনি বলেই ধরে নেওয়া হয়। কয়েকজন অল্পবয়সী কূটনীতিবিদ চিনের জনপ্রিয় মেসেজিং ও সোশাল মিডিয়া অ্যাপের মাধ্যমে হুবেইয়ে বসবাসকারী ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। একটি উইচ্যাট গ্রুপে দূতাবাসের পক্ষ থেকে দ্রুত সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়।

অনেক ভারতীয়ই অল্পবয়সী, উত্তেজিত এবং কখনও কখনও ক্রুদ্ধও হয়ে পড়েছিলেন। এক ভারতীয় কূটনীতিবিদের কথায়, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কিছুটা মানসিকভাবে পাশে দাঁড়ানো, এ ছাড়া খাবার, জল ও ওষুধ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া।

২৬ জানুয়ারির মধ্যে সারা দুনিয়ায় ২০০০-এরও বেশি সংক্রমণের কথা জানা যায়। এর পর বেশ কয়েকদফা আলোচনা হয় নয়া দিল্লি ও দূতাবাসের মধ্যে, এর পরেই সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

তত দিনে দূতাবাসের কন্ট্রোল রুম হুবেইয়ের মানচিত্রে ভারতীয়দের খুঁজে পাবার মত তথ্য পেয়ে গিয়েছে। তাঁরা জেনে গিয়েছেন হুবেইতে ৭৫০ জনের মত ভারতীয় রয়েছেন- তাঁদের অর্ধেক য়ুহান ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস করেন, বাকিদের বাস প্রদেশের আরও ভিতর দিকে, য়ুহান বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৪৫০-৫০০ মাইল দূরে।

বিমানবন্দরে আনা

সংক্রমিত এলাকা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, কোনও গাড়ি বা মানুষের যাতায়াত ছিল নিষিদ্ধ। এবার আধিকারিকদের কাছে সমস্যা ছিল, কীভাবে এঁদের নিয়ে আসা হবে বিমানবন্দরে! স্বাধীনভাবে যাতায়াত না করতে পারার ফলেস যুহান শহরের কোনও এক জায়গায় জমায়েত হতেও বলা যাচ্ছিল না, বা বিমানবন্দরে চলে আসতেও বলা যাচ্ছিল না তাঁদের। দূতাবাসের তরফ থেকে তখন যোগাযোগ করা হয় বেসরকারি পরিবহণ সংস্থার সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এই ভারতীয়দের বিমানবন্দরে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন।

চিনের সঙ্গে কথাবার্তা

চিন কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে এই সরিয়ে নিয়ে যাবার অনুমতি দিতে নারাজ ছিল। ফলে এই অনুমতি পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। মিশ্রি নিজে এবং ডেপুটি চিফ অফ দ্য মিশন অ্যাকুইনো বিমল এই ছাড়পত্রের ব্যাপারে উদ্যোগী হলেও, ২৮ জানুয়ারি চিন ইঙ্গিত দেয় যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং আতঙ্কের কোনও কারণ নেই, ফলে সরিয়ে নিয়ে যাবারও কোনও দরকার নেই। ভারতে চিনের রাষ্ট্রদূত সান ওয়েইডং টুইটারে লেখেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরিয়ে নিয়ে যাবার পরামর্শ দিচ্ছে না এবং সমস্ত দেশগুলিকে শান্ত থাকতে ও অতিপ্রতিক্রিয়া না দেখানোর পরামর্শ দেন।

করোনাভাইরাস: পাকিস্তান রোগ নিয়েও বন্ধুকৃত্য করছে

এদিকে দেশে বিদায়ী বিদেশ সচিব বিজয় গোখেল এবং তাঁর উত্তরসূরী হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা অসামরিক বিমানপরিবহণ দফতর, এয়ার ইন্ডিয়া এবং ব্যুরো অফ ইমিগ্রেশনের মত এজেন্সিগুলির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকেন। এয়ার ইন্ডিয়াকে বলা হয় স্বল্প সময়ের নোটিশে এক দল চিকিৎসক, বিমানকর্মীসহ দুটি বিমান ওড়ার জন্য প্রস্তুত রাখতে।

২৯ জানুয়ারির সকালে, যেদিন শ্রিংলা দায়িত্ব নিলেন, সেদিন চিন সরকার সরিয়ে নেবার নীতিগত অনুমতি দেন। কিন্তু তারপরেও সমস্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির কাছে সে অনুমতির কথা পোঁছনোর বিষয়টি জরুরি ছিল।

ভারতের এক দূতাবাস কর্মী বলেন, চিনা বিদেশ মন্ত্রককে বিষয়টা প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষকে জানাতে হত, যারা শহর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানাবে, আবার আলাদা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এবং বেসরকারি পরিবহণ সংস্থাদেরও জানাতে হত। এই জটিল, আমলাতান্ত্রিক, এথচ অতীব দরকারি তথ্য পৌঁছনোর মধ্যেই ছিল সাফল্যের চাবিকাঠি।

চূড়ান্ত প্রস্তুতি

দুই ভাগে এয়ারলিফট করার ব্যাপারে সকলে সম্মত হন, কিন্তু চিনারা বলেন যাদের জ্বরের সংক্রমণের চিহ্ন রয়েছে তাদের ছাড়ার অনুমতি দেওয়া যাবে না। প্রথম দলে ছিলেন যাঁরা য়ুহানের কাছা কাছি এলাকায় বাস করেন বা কাজ করেন। ৪০টি জায়গা থেকে লোকদের তুলে এনে য়ুহান বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয় ১৮-২০টি গাড়ি।

পরিকল্পনার চূড়ান্ত কয়েক ঘণ্টায় স্থানীয় চিনা কর্মী, যাঁরা নববর্ষ উপলক্ষে ছুটি নিয়েছিলেন, তাঁদের ভারতীয় সহকর্মীদের সাহায্য করার জন্য দূতাবাসের কন্ট্রোল রুমে যোগ দিতে বলা হয়। প্রতিটি গাড়িতে একজন করে ভারতীয় দূতাবাস কর্মী ও একজন করে চিনা কর্মী রাখা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত এক দূতাবাসকর্মী বলেন, চালকের সঙ্গে একজন চিনাভাষী কর্মীকে রাখা প্রয়োজন ছিল।

করোনাভাইরাস কি ‘SARS’-এর চেয়েও মারাত্মক? না, বলছেন বিশেষজ্ঞরা

৪০ জনের মত ভারতীয় দূতাবাসকর্মী এবং চিনা কর্মীরা টানা ৯৬ ঘণ্টা কাজ করেছিলেন। কন্ট্রোলরুমেই কেক কেটে ৩০ তম জন্মদিন পালন করেন এক মহিলা দূতাবাসকর্মী।

বাড়ি ফেরা

প্রথম এয়ারলিফটের আনুষ্ঠানিক অনুমতি মেলে ৩১ জানুয়ারি বেলা সাড়ে তিনটের সময়ে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান য়ুহানে নামে রাত ৮টায়। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর চিনা বিদেশ মন্ত্রী ওয়াং হিকে আনুষ্ঠানিক অনুমতি দেবার জন্য ধন্যবাদ জানান। ৩২৪ জন ভারতীয় যাত্রী নিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি ভোর চারটেয় বিমান রওনা দেয়।

দ্বিতীয় দলকে য়ুহাংয়ের ১৫টি জায়গা থেকে ১২টি গাড়ি করে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে বহু দূরবর্তী জায়গাও ছিল। আগের বারের মতই দুজন করে কর্মী রাখা ছিল বিমানে।

এক কূটনীতিবিদের কথানুসারে,  "যাতে কোনও মানুষ বা গাড়ি বেরোতে না পারে সে কারণে স্থানীয় লোকজন রাস্তা খুঁড়ে দিয়েছিলেন। আমরা কন্ট্রোল রুমে বসে ম্যাপে বাসের অবস্থান দেখে এয়ারপোর্টে আসার অন্য রাস্তার হদিশ দিচ্ছিলাম।" দলের দুই সদস্য, সেকেন্ড সেক্রেটারি দীপক পদ্মকুমার এবং দূতাবাসকর্মী এম বালাকৃষ্ণন বেজিং থেকে য়ুহান উড়ে গিয়েছিলেন যাতে বিমানবন্দরে শেষ মুহূর্তে কোনও সমস্যা না হয়।

দ্বিতীয় বিমান ছাড়ার সরকারি অনুমতি মেলে ১ ফেব্রুয়ারি। বিমান য়ুহান পৌছয় ওই দিন রাত ৮টায়। ৩২৩ জন ভারতীয় ও সাত মালদ্বীপের নাগরিককে নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি সকাল ৬টায় বিমান রওনা দেয়।

যেহেতু এই সরিয়ে আনার ব্যাপারে এক এক জায়গায় এক একরকম সমস্যা তৈরি হয়, সে কথা মাথায় রেখে বেজিংয়ের ভারতীয় দূতাবাস এ ব্যাপারের শিক্ষণীয় বিষয়গুলি নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করছে সাউথ ব্লকের জন্য।

coronavirus
Advertisment