গত বছরের শেষ এবং চলতি বছরের শুরু মিলিয়ে অভূতপূর্ব এবং বিধ্বংসী দাবানলের সাক্ষী থেকেছে অস্ট্রেলিয়া। আধুনিকতম প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপ্রাণ লড়েও এই ভয়াবহ আগুন নেভাতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে সেদেশের সরকার। এবার উঠে আসছে দাবানল প্রতিরোধে দেশজ পদ্ধতির কার্যকারিতা, যা প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
অস্ট্রেলিয়ার এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন অ্যান্ড বায়োডাইভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯৯০-এ দাবানল মোকাবিলায় দুটি ধাপের কথা বলা হয়েছে। এক, আগুন নেভানো, দুই, আগুন প্রতিরোধ। কিন্তু চলতি মরসুমের দাবানলের প্রকোপের বিরোধিতায় ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে দেশজ পদ্ধতিই।
অস্ট্রেলিয়ার আদি বাসিন্দা, যাঁদের বলা হয় 'অ্যাবরিজিনি', শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আগুনকে ব্যবহার করে এসেছেন ভূমি ব্যবস্থাপনার বা ল্যান্ড ম্যানেজমেন্টের উপায় হিসেবে। আজও তাঁরা আগুন ব্যবহার করেই চাষের জমি সাফ করেন, এমনকি আগুন ব্যবহার করেন আরও তীব্র, অনিয়ন্ত্রিত আগুনের কবল থেকে নিজেদের জমি বাঁচাতেও।
অস্ট্রেলিয়ার দাবানল: এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আগুনে মৃত্যু হয়েছে আন্দাজ ২৪ জন মানুষ এবং ৫০ কোটি জীবজন্তুর, বিনষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি, এবং পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছে দেশের ১.২ কোটি হেক্টর জমি। চলতি মাসের শুরুতে ভিক্টোরিয়া প্রদেশের একটি সমুদ্রতটে আটকে পড়েন দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার কয়েক হাজার বাসিন্দা, এবং তাঁদের কাছে খাদ্য ও পানীয় পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হয় বিমান এবং যুদ্ধজাহাজ।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দাবানল অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেদেশের সরকারি ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের বিবর্তন ঘটেছে আগুনের দৌলতে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক মানচিত্র ও জীব বৈচিত্র্য গড়েই উঠেছে সাম্প্রতিক এবং ঐতিহাসিক আগুনকে কেন্দ্র করে। এও বলা হয়েছে ওই ওয়েবসাইটে যে, অস্ট্রেলিয়ার কিছু দেশজ গাছপালা যেমন অত্যন্ত দাহ্য, এবং দ্রুত পুড়ে যায়, তেমনই এমন বহু প্রজাতির গাছ আছে যেগুলি তাদের পুনর্জীবনের জন্য আগুনের ওপর নির্ভরশীল।
সমস্যা হলো, দাবানল রুটিনমাফিক লাগলেও, এই মরসুমের মতো ভয়াবহ দাবানল স্মরণকালে কখনও দেখেনি অস্ট্রেলিয়া, সঙ্গে রয়েছে আসন্ন খরা এবং রেকর্ড উচ্চ তাপমাত্রা। এতটাই, যে এবার আগুন লাগা শুরু হয় ২০১৯-এর অগাস্ট মাস থেকেই, যেখানে দক্ষিণ গোলার্ধে সাধারণভাবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি হলো গ্রীষ্মকাল।
আবহাওয়ার বদলের সঙ্গে যোগ রয়েছে দাবানলের তীব্রতার, এই তত্ত্বের সমর্থনে কিছু প্রমাণ পাওয়া গেলেও অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এখনও দাবানলের সঙ্গে পরিবর্তিত আবহাওয়ার সরাসরি যোগস্থাপন করতে চাইছেন না। এদিকে অস্ট্রেলিয়ার ব্যুরো অফ মিটিওরলজি জানিয়েছে, ১৯০০ সালের পর ২০১৯-ই ছিল দেশের শুষ্কতম এবং উষ্ণতম বছর। গত বছর দিনের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে দুই ডিগ্রি বেশি, এবং বৃষ্টি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম।
অস্ট্রেলিয়ার দাবানল নেভাতে কী কী প্রয়োজন?
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস জানিয়েছে, বড় দাবানল নেভানোর এবং নিয়ন্ত্রণ করার একাধিক প্রক্রিয়া রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বড় আগুনের পথ আটকে ছোট ছোট আগুন ধরিয়ে দেওয়া, যাতে বড় আগুন আর জ্বালানি না পায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় 'ব্যাকবার্নিং'। এছাড়াও অবশ্যই রয়েছে জলের ব্যবহার, এবং 'ওয়াটার বম্বিং', অর্থাৎ হেলিকপ্টার থেকে আগুনের ওপর বিপুল পরিমাণ জল ফেলা।
এতসব সত্ত্বেও মাঝেমাঝে এত বড় আকার ধারণ করে আগুন, যে কোনও প্রক্রিয়াই কাজে লাগে না। এমনটাই ঘটেছে এই মরসুমে, যখন কয়েকটি আগুনের আয়তনের তুলনা করা হচ্ছে সিডনি অথবা ম্যানহ্যাটানের মতো বড় শহরের আয়তনের সঙ্গে।
দেশজ পদ্ধতিগুলি কী?
উত্তর-পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার জনবিরল কিম্বারলি অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার আদি বাসিন্দারা হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহার করে আসছেন আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রথাগত কিছু প্রক্রিয়া। কিম্বারলি ল্যান্ড কাউন্সিল জানাচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় ঔপনিবেশিকদের আগমন এবং আদিবাসীদের তাঁদের জমি থেকে উৎখাত করার হার যত বাড়তে থাকে, তত কমতে থাকে দেশজ পদ্ধতির ব্যবহার।
শেষমেশ বিংশ শতাব্দীতে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয় আগুন নেভানোর দেশজ পদ্ধতির ব্যবহার, যার ফলে সৃষ্টি হতে শুরু করে "বড়, অনিয়ন্ত্রিত দাবানল, সাধারণত সুখা মরসুমের শেষদিকে, যা ধ্বংস করতে থাকে গুরুত্বপূর্ণ বনভূমি ও বিচরণ ক্ষেত্র"। গত ২৫ বছরে ধীরে ধীরে এই উপলব্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে প্রথাগত প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন, কারণ পশ্চিমী অগ্নি নির্বাপণ প্রক্রিয়া "কার্যকরী হয় নি"।
দেশজ অগ্নি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াগুলির একটি হলো কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় মার্চ থেকে জুলাই মাসের সুখা মরসুমের শুরুতেই 'ঠাণ্ডা' আগুন জ্বালানো। এর ফলে মরসুমের শেষের দিকে, যখন তাপমাত্রা তুঙ্গে ওঠে, তখন বড় আগুনের জ্বালানি আর অবশিষ্ট থাকে না। পাশাপাশি সুরক্ষিত থাকে জীবজন্তু এবং পাখিদের বিচরণ ক্ষেত্র।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে গত এক দশক ধরে প্রধানত উত্তর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী অঞ্চলে অগ্নি-প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেখা গেছে যে "বিধ্বংসী দাবানলের সংখ্যা অর্ধেক কমে গেছে"। অবশ্যই প্রথাগত প্রক্রিয়ার সঙ্গেই বজায় থাকবে আধুনিক প্রক্রিয়ারও ব্যবহার। যৌথভাবে কাজ করবে দুটি।.