গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা। কবির মেঘ, এবং তা থেকে কবিত্ব-গর্জন নয়, এক ভয়ঙ্কর অভিঘাত, বজ্রপাত যে কী ভয়ঙ্কর! ঘনিয়ে তুলতে পারে বিপদ, তারই জীবন্ত-কথা বলব। অনেকের হয়তো শোনা, তবুও আরেক বার শোনায় কোনও ক্ষতি নেই। অধিকন্তু ন দোষায়, শাস্ত্রেই তো আছে! মহাপৃথিবী মেঘ-বিদ্যুতে এখন তিতিবিরক্ত। বজ্রাঘাতে মৃত্যুমিছিল দেখছি আমরা, বার বার।
গত ২৪ ঘণ্টায় বাজ পড়ে মারা গিয়েছেন অন্তত ৩০ জন। এর মধ্যে রাজস্থানে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের, উত্তরপ্রদেশে মৃত ১২। মৃত্যুর খবর এসেছে মধ্যপ্রদেশ থেকেও। এর আগে জুনের শুরুতে দক্ষিণবঙ্গে বজ্রাঘাতে মারা গিয়েছিলেন জনা বিশ। দক্ষিণবঙ্গের চারটি জেলা থেকে বাজে মৃত্যুর এই খবর হয়েছে। আর গত বছরের জুলাইতে দুটি বজ্রপাতের ঘটনায় বিহারে ৪০ জনের মৃত্যু। আমরা বাকরহিত হয়ে যাই।
পিনাকেতে লাগে টঙ্কার
পিনাক মানে শিবের ধনুক। বজ্রনির্ঘোষের সঙ্গে সেই পিনাকের টঙ্কারের তুলনা টানা হয়। বসুন্ধরার পঞ্জর বা পাঁজর কেঁপে ওঠে সেই আওয়াজে। গ্রাম-শহরে প্রতি বছর বজ্রাঘাতে বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। প্রতি বছর এই মৃত্যুসংখ্যাটা দু'হাজার থেকে আড়াই হাজার। ফলে বোঝাই যাচ্ছে দেশে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে সংখ্যা, তাতে একটা বড় অবদান বজ্রের। কয়েক বছর আগে তিন দিনে বাজ পড়ে ৩০০ জনের মৃত্যু বিজ্ঞানী ও সরকারি আধিকারিকদের চমকে দিয়েছিল। কিন্তু এতই যখন বজ্রপাত প্রাণহানিকর, তখন তো এর জন্য কোমর আরও শক্ত করে বাঁধা উচিত সরকারের। তা তো হচ্ছে না।
বজ্রপাত নিয়ে এ দেশে সবচেয়ে কম গবেষণা হয়েছে এ পর্যন্ত। পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল ম্যানেজমেন্টের একদল বিজ্ঞানী অবশ্য এ সংক্রান্ত বড় একটি কাজ করেছেন। তবে বাজ পড়া নিয়ে সরকারের হিসেবের অস্বচ্ছতা তাঁদের সমস্যায় ফেলেছে। এবং বিজ্ঞানীদেরও বক্তব্য, সরকারি তরফে বজ্রপাত নিয়ে সচেতনতা প্রচারে যতটা কাজ করার কথা ছিল, আর চেয়ে হয়েছে অনেকটাই কম। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানও বজ্র-পথে একটু পিছিয়ে আছে, তাও বিজ্ঞানীদের অনেকে স্বীকার করে নিচ্ছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বজ্রবিদ্যুতের সংখ্যাটা বেড়ে গিয়েছে অনেক। বিশেষ করে শেষ ২০ বছরে। হিমালয়ের পাদদেশে বাজ পড়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
কী করে বজ্রপাত হয়?
ঘন মেঘের গর্জনে প্রবল বিদ্যুতের জন্ম হয়। তা-ই অনেক সময় পৃথিবীতে ছিটকে চলে আসে। বিপদ ঘনিয়ে তোলে, মৃত্যু মিছিলের জন্ম দেয়। কিন্তু কী ভাবে? একটু বিশ্লেষণ হোক না: যে ধরনের মেঘ বজ্রগর্ভ হয়, তার আকার হয় বিশাল। ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার লম্বা। পৃথিবী থেকে দু' কিলোমিটার নীচে থাকতে পারে সেই মেঘের নিম্ন ভাগ, আর শীর্ষ ভাগ থাকে ওই ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার উপরে। শীর্ষদেশের তাপমাত্রা মাইনাস ৩৫ থেকে মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জলীয় বাষ্প যখন নীচ থেকে উপরে উঠতে থাকে তখন প্রবল ঠান্ডায় তা ঘনীভূত হয়। এর ফলে তাপের জন্ম হয়, যা জলের অণুগুলিকে আরও উপর দিকে ঠেলে দেয়।
তাপমাত্রা যখন শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়, তখন জল ছোট ছোট স্ফটিক বা ক্রিস্টালে পরিণত হয়। উপরের দিকে তারা উঠতে থাকে এবং আকারে বড় হতে থাকে, তার পর বৃহত্তর স্ফটিকাকার সেই বরফ নীচে হাজির হয়। ছোট ক্রিস্টালগুলি উপরের দিকে উঠছে, আর বড় ক্রিস্টালগুলি নীচের দিকে নামছে-- এই যে প্রক্রিয়া, তাতেই সংঘর্ষ হয়, যা এই বিদ্যুৎ তৈরির মূলে। আসলে ইলেকট্রগুলির মধ্যে সংঘর্ষ হয়, এবং তাতে আরও ইলেকট্রনের জন্ম হয়, সংঘর্ষের সংখ্যাও বাড়ে। চেন রিয়্যাকশন শুরু হয়। ।
মেঘের শীর্ষ ভাগ পজিটিভ চার্জ বা ধনাত্মক আধান, মধ্য ভাগ নেগেটিভ চার্জ বা ঋণাত্মক আধান যুক্ত। দুইয়ের মধ্যে চার্জের যে পার্থক্য থাকে, তা বিপুল। ১০০ কোটি থেকে হাজার কোটির এই ফারাক। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল বিদ্যুতের জন্ম হয়। যা এক লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ অ্যাম্পেয়ারের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। দুটি মেঘের স্তরের মধ্যে বায়ুর স্তম্ভ থাকে, এর ফলে তা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎ চমকের সময় সেই বায়ুর স্তম্ভ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। তাপ বাড়লে বায়ু প্রসারিত হতে থাকে, এর ফলে শক ওয়েভ তৈরি হয় বজ্রপাতের সময়।
মেঘের বিদ্যুৎ কী করে পৃথিবীতে
পৃথিবী বিদ্যুতের সুপরিবাহী, বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ। মেঘগর্জনের সময় পজিটিভ চার্জ যুক্ত হয়ে ওঠে পৃথিবী। এর ফলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। উঁচু গাছ, টাওয়ার কিংবা বাড়িতে বিদ্যুৎ ধাক্কা মারে। ৮০ থেকে ১০০ মিটার উঁচু কিছুর উপর আছড়ে পড়ে বহু সময়। কেন এমন হয়? বিদ্যুতের দুর্বল পরিবাহী বায়ু, বায়ুর মধ্যে থাকা ইলেকট্রনগুলি সুপরিবাহী কিছুর খোঁজ করতে থাকে। তাই পজিটিভ চার্জ-যুক্ত পৃথিবীতে পৌঁছতে যায় দ্রুত। কোনও গাছ, কিংবা টাওয়ার সেই সুযোগটিই করে দেয়।
সরাসরি মানুষকে আঘাত করে, এমন বজ্রপাত খুবই সামান্য। পৃথিবীর উপর বিদ্যুৎ ঝাঁপ কেটে পড়লে তার প্রভাব বেশ খানিকটা ছড়িয়ে পড়ে, সেই এলাকায় থাকা মানুষজন বিদ্যুতের শক অনুভব করেন। মাটি ভিজে থাকলে মারাত্মক হয়ে ওঠে তা। যা স্বাভাবিক ভাবেই হয়ে থাকে বৃষ্টিবাদলায়। বজ্রঘাতে চাষজমিতে কাজে ব্যস্ত থাকা অনেকে তাই মারা যান বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে।
আবহাওয়া দফতর নিয়ম করে বজ্রপাতের সর্তকতা জারি করে, কিন্তু তা খুবই সাদামাটা ধরনের। এবং বৃহত্তর এলাকার ক্ষেত্রে সেই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়ে থাকে। একটি ছোট জায়গায় বজ্রপাত নিয়ে এখনও সতর্কবার্তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বৃষ্টিতে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে যখন বর্ষামঙ্গলের গল্প করছেন কেউ বা কয়েক জন, কিংবা রাস্তার ধারে কোনও ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে যখন বৃষ্টির দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে রয়েছেন, বজ্রপাতে আসতে পারে মৃত্যু, হঠাৎই।