ফতোয়া, খুনের হুমকি, নির্বাসন। একটা বই বদলে দিল সলমন রুশদির জীবন। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে দ্য স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশের পর থেকে এই নতুন ধরনের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে হয় রুশদিকে। তার আগে ব্রিটিশ-ভারতীয় লেখক তাঁর মিডনাইটস চিলড্রেন (১৯৮১)-এর জন্য বুকার পুরস্কার জিতেছিলেন। সেই সময়টার পর থেকে তাঁর জীবন ছিল খুশিতে ভরা।
শুক্রবার, তিনি পশ্চিম নিউইয়র্কের চৌতাকুয়া ইনস্টিটিউশনে একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নির্বাসনে থাকা শিল্পীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের ব্যাপারে ছিল তাঁর বক্তব্য। সেই সময় ৭৫ বছরের এই লেখককে মঞ্চে ছুরি নিয়ে এক ব্যক্তি আক্রমণ করেন। ছুরির আঘাতে রুশদি মেঝেতে পড়ে গেলে আততায়ীকে গ্রেফতার করা হয়।
ফতোয়া এবং খুনের হুমকি
১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে দ্য স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশের পর ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯ সালে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনি উপন্যাসের মাধ্যমে 'ইসলামকে অপমান করার' জন্য রুশদির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছিলেন। এর জেরে রুশদি আত্মগোপন করেন। তবে, তাঁর বই নিষিদ্ধকরণ, বই পোড়ানো, মৃত্যুর হুমকি, কুশপুতুল দাহর মত ঘটনা চলতেই থাকে। যা বিশ্বের শিল্পকলায় এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর প্রশ্নচিহ্ন উত্থাপন করেছিল।
স্যাটানিক ভার্সেসের বিতর্ক
দ্য স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশের পরপরই ১৯৮৯ সালে চ্যানেল ৪-এ একটি সাক্ষাত্কারে, রুশদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইস্যুতে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'আপনি যদি একটি বই পড়তে না-চান, তবে আপনাকে এটি পড়তে হবে না। স্যাটানিক ভার্সেসের জন্য ক্ষুব্ধ হওয়া খুব কঠিন। এজন্য দীর্ঘ সময় ধরে পাঠ করা প্রয়োজন। এটিতে ১০ লক্ষের এক চতুর্থাংশ শব্দ রয়েছে।'
কিন্তু লেখক তাঁর উপন্যাসের হয়ে ভালো প্রতিক্রিয়াই দিতে হবে, এমন কোনও দাবি করেননি। স্যাটানিক ভার্সেস ভারতীয় মুসলিম বংশোদ্ভূত অভিনেতা জিবরিল ফারিশতা ও সালাদিন চামচার গল্প বলে, যাদের পালিয়ে যাওয়া এবং একটি বিমান দুর্ঘটনার ওপর ভিত্তি করে এই উপন্যাস। প্রকাশের পর, বইটি ইউরোপে যথেষ্ট আলোচিত হয়। বছরের সেরা উপন্যাস হিসেবে ১৯৮৮ সালের হুইটব্রেড পুরস্কারও জেতে। ১৯৮৮ সালের বুকার পুরস্কারের তালিকাতেও স্থান পেয়েছিল।
তবে ভারতে প্রকাশের নয় দিন পরে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে। ব্রিটেনেও প্রতিবাদ শুরু হয়। বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুদান, কেনিয়া-সহ বেশ কয়েকটি দেশেও বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। অন্যান্য দেশগুলোও সেই পথ নেয়। ইরানে প্রাথমিকভাবে বইটির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ হয়নি। কিন্তু গন্ডগোল বাড়তেই একদল আলেম খোমেইনির কাছে বইটির কিছু অংশ পড়ে শোনান। যার মধ্যে নির্বাসনে থাকা একজন ইমামের একটি অংশ ছিল। যা অনেকটা ব্যঙ্গ করে লেখা।
আড়ালে জীবন কাটানো
লেখককে হত্যার জন্য ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলারের বেশিমূল্যের পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়েছিল। পরবর্তী নয় বছর রুশদি আত্মগোপনে ছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন। দেহরক্ষী এবং নিরাপত্তার মধ্যে কাটিয়েছেন। এরপর ইরান সরকার ১৯৯৮ সালে ফতোয়া প্রত্যাহার করে। ২০১২ সালে তাঁর মর্মস্পর্শী স্মৃতিকথা জোসেফ আন্টন-এ, রুশদি ছদ্মনাম (জোসেফ কনরাড এবং অ্যান্টন চেখভের প্রথম নাম থেকে নেওয়া) ছদ্মনাম গ্রহণের বিষয়ে লিখেছিলেন। যাতে যাচাই-বাছাই এড়ানো যায় এবং 'সাদা মুখোশের একজন অদৃশ্য মানুষ' হিসেবে থাকতে পারেন। তিনি তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে স্পষ্টীকরণ করেছিলেন। তাঁর বই বহু দেশেই বেস্ট সেলার হয়। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিভিন্ন দেশে একদল লোকের তাণ্ডবের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দোকান থেকে বইটি প্রত্যাহার করে নিতে হয়।
আরও পড়ুন- জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের নিয়মগুলো কী কী?
জনজীবনে ফিরে আসা
ফতোয়া প্রত্যাহারের পরই ১৯৯৮ সালে রুশদি জনজীবনে ফিরে এসেছিলেন। বাকস্বাধীনতা, শৈল্পিক স্বাধীনতার ব্যাপারে সোচ্চার হন। বেস্টসেলিং উপন্যাস লেখা অব্যাহত রাখেন। কমনওয়েলথ সেরা বইয়ের ঘোষণার জন্য ছেলে জাফরের সঙ্গে ফতোয়ার পর ২০০০ সালে প্রথমবার ভারতে আসেন। গত বছর দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে, যিনি হেলেন অফ ট্রয়ের ওপর ভিত্তি করে তাঁর প্রথম নাটকে কাজ করা এই লেখক বলেন, 'ভারতের সঙ্গে আমার সৃজনশীল সম্পর্ক কেবলমাত্র আমার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। আমি আশা করি, আমি ভারতে ফিরে আসব।'
Read full story in English