শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) কংগ্রেস প্রধান মল্লিকার্জুন খাড়গে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাওকে তাঁর 19তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়া X-এর এক পোস্টে খাড়গে বলেছেন, রাও-এর সরকারের সময় ভারত একাধিক অর্থনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে একটি রূপান্তরমূলক যাত্রা শুরু করেছে। এই ব্যাপারে খাড়গে বলেন, 'তিনি ভারতের পরমাণু কর্মসূচিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। লুক ইস্ট-সহ তাঁর সময়ে বেশ কিছু বিদেশনীতি কৃতিত্বের দাবিদার।' প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঠিক একবছর আগে, রাও ভেবেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার প্রায় শেষ। ব্যাগ, বই আর প্রিয় কমপিউটার প্যাক করে তিনি হায়দরাবাদে তাঁর দ্বিতীয় ছেলের বাড়িতে পাঠান। তিনি তামিলনাড়ুর একটি মঠকে লিখেছিলেন, ওই মঠের প্রধান সন্ন্যাসী হওয়ার কথা ভাবছেন। সেই পদটি তাঁকে আগে দেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু, সেই সময় তিনি তা নিতে চাননি।
বিনয় সীতাপতির লেখা 'দ্য ম্যান হু রিমেড ইন্ডিয়া: এ বায়োগ্রাফি অফ পিভি নরসিমহা রাও' অনুসারে, রাজনৈতিক প্রস্থানের মুখে ১৯৯০ সালে নরসিমহা রাও শুনেছিলেন যে তৎকালীন কংগ্রেস প্রধান রাজীব গান্ধী পরের বছরের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হলে মন্ত্রিসভায় তরুণদের নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। সীতাপতি লিখেছেন, 'এই সব জল্পনায় রাওয়ের রাজনৈতিক ক্লান্তি বেড়ে গিয়েছিল। তিনি টানা আটটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন।' রাজীব গান্ধীর পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে, কংগ্রেস নেতা অবসর-পরবর্তী জীবনের পরিকল্পনাও শুরু করেন। কিন্তু, ১৯৯১ সালের ২১মে, রাজীব গান্ধীকে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে প্রচারাভিযানের সময় হত্যা করা হয়। রাজীবের জীবনের এই ট্র্যাজেডিই রাওয়ের রাজনৈতিক যাত্রার গতিপথ বদলে দেয়।
রাজীব হত্যার খবর পাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর শেষকৃত্যের জন্য ১০ জনপথে পৌঁছন রাও। সেখানে, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জি তাঁকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন যে রাওকে পরবর্তী কংগ্রেস সভাপতি করা হবে। এমনটা আগেই ঠিক ছিল বলে প্রচার করা হবে। আর, দলের অভ্যন্তরীণ লড়াই এবং গুজব প্রতিরোধে তা সেদিনই করা হবে। এই কথাগুলো রাও তাঁর ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন। এই খবর শুনে রাও খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু, কোনও উত্তেজনা প্রকাশ করেননি। সীতাপতি তাঁর বইতে লিখেছেন, 'রাও বুদ্ধিমানের মত সতর্ক থাকতে চেয়েছিলেন। কারণ, এই ঘটনার সাত বছর আগে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যার সময় প্রণব মুখার্জি বিদ্রোহ করেছিলেন। নিজেকে উত্তরাধিকারী বলে দাবি করেছিলেন। সাজা হিসেবে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দলের পিছনের সারিতে পাঠানো হয়েছিল। তাঁকে (প্রণব মুখোপাধ্যায়কে) এখনও কেবল পুনর্বাসন দেওয়া হচ্ছে।'
শুধু তাই নয়, রাও ছাড়াও দলের সভাপতি পদের জন্য আরও বেশ কয়েকজন প্রার্থী ছিলেন। তাঁরা হলেন অর্জুন সিং, এনডি তিওয়ারি, শরদ পাওয়ার এবং মাধব রাও সিন্ধিয়া। সোনিয়া গান্ধী, যাঁকে উত্তরসূরি বাছাই করতে বলা হয়েছিল, তিনি প্রত্যেক প্রার্থীকেই ভালো করেই জানতেন। সীতাপতির মতে, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী শরদ পাওয়ার ছিলেন 'তরুণ এবং চাপা' স্বভাবের। কিন্তু, ১৯৭৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য তিনি প্রদেশ কংগ্রেসকে বিভক্ত করে কংগ্রেস দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং ও মাধব রাও সিন্ধিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতা করেছিলেন। দলের মধ্যে সবচেয়ে সুস্পষ্ট পছন্দ ছিলেন উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এনডি তিওয়ারি। যাইহোক, রাও তাঁর ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন, তিওয়ারি এর আগে রাজীব গান্ধীর নির্দেশ অমান্য করেছিলেন এবং লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। যদিও সেই নির্বাচনে তিওয়ারি হেরে গিয়েছিলেন।
তাই, রাও পরবর্তী কংগ্রেস সভাপতির বিকল্প হয়ে উঠলেন। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের জন্য লেখায় , সঞ্জয় বারু উল্লেখ করেছেন, 'রাও রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটারমনের থেকেও দৃঢ় সমর্থন পেয়েছিলেন। কারণ, আর ভেঙ্কটারমন সংখ্যার প্রমাণ না-চেয়েই বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতাকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর নতুন নীতি নিয়েছিলেন। এটি নিশ্চিত করতে অবশ্য কেরলের কে করুণাকরণ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। পাশাপাশি, ভারতের দ্বীপপুঞ্জ থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সাংসদরা দেশের প্রথম দক্ষিণ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।'
আরও পড়ুন- গ্রিনিচ নয়, কয়েকশো বছর ধরে বিশ্বে সময় নির্ধারণের কেন্দ্রস্থল উজ্জয়িনীই, দাবি মুখ্যমন্ত্রীর
বারু যোগ করেছেন যে সেই সময়ে রাও সবচেয়ে অভিজ্ঞ কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, দলের সাধারণ সম্পাদক এবং বিদেশ, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব সামলেছেন। কংগ্রেস সভাপতি পদে রাও-এর নাম প্রস্তাব করেছিলেন পিএন হাকসার। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর প্রধান সচিব ছিলেন। সীতাপতির বই অনুসারে, হাকসার যুক্তি ছিল যে, রাও এমন একজন বুদ্ধিজীবী, যাঁর শত্রু ছিল না। আর, তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেন। অন্য প্রার্থীরা দলকে বিভক্ত করতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন হাকসার। ১৯৯১ সালের ২৯ মে, রাও কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের মাসে, যখন কংগ্রেস জাতীয় নির্বাচনে ৪৮৭ আসনের মধ্যে ২৩২টিতে জয়ী হয়, রাও প্রধানমন্ত্রী হন।