বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর: বিজ্ঞান তাই বলল যা ইতিহাস বলে এসেছে

পঞ্চাশের মন্বন্তরের শিকার হন ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরেই ঐতিহাসিক গবেষণা, সাহিত্য, এমনকী সিনেমাও, এর জন্য ব্রিটিশ শাসনকে দায়ী করে এসেছে।

পঞ্চাশের মন্বন্তরের শিকার হন ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরেই ঐতিহাসিক গবেষণা, সাহিত্য, এমনকী সিনেমাও, এর জন্য ব্রিটিশ শাসনকে দায়ী করে এসেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
bengal famine 1943 causes

ইতিহাস যা বলে এসেছে, আজ তাই বলছে বিজ্ঞানও

ঐতিহাসিকরা বহুদিন ধরেই যা বলে আসছেন, তা এবার প্রমাণ করল বিজ্ঞান। পুরোনো আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যের ওপর আধুনিক প্রযুক্তির প্রলেপ দিয়ে একদল ভারতীয় গবেষক প্রামাণ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, যে ১৯৪৩-৪৪ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ (বা 'পঞ্চাশের মন্বন্তর', যেহেতু ১৩৫০ বঙ্গাব্দ) আদৌ কৃৃৃৃষির ব্যর্থতা জনিত খরা ছিল না, ছিল মনুষ্যসৃষ্ট আকাল। গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন আইআইটি গান্ধীনগরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক বিমল মিশ্র, এবং ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে 'জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস'-এ।

Advertisment

মাটির আর্দ্রতা ও দুর্ভিক্ষ 

আবহাওয়া স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং মাটির আনুমানিক আর্দ্রতা মাপতে জলচক্রের অনুকরণে নির্মিত একটি মডেল ব্যবহার করে গবেষকরা ১৮৭০ থেকে ২০১৬ সাল, এই দেড়শো বছরের সময়কালে কৃষিজাত খরার পুনর্বিশ্লেষণ করে ভারতে দুর্ভিক্ষ ও কৃষিজাত খরার একটি যোগসূত্র স্থাপন করেন।

Advertisment

ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের কাছ ১৯০১ সালের আগের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য না থাকায় গবেষকরা ১৮৭০ থেকে ১৯০০ - এই ত্রিশ বছরের জন্য একটি অনুরূপ তথ্যপঞ্জি তৈরি করেন, যার ভিত্তি ছিল দেশে ছড়িয়ে থাকা ১,৬৯০ টি আবহাওয়া স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্য। এর মাধ্যমে তাঁরা উদ্ভাবন করেন মাটির আর্দ্রতার পার্সেন্টাইল (সয়েল ময়শ্চার পার্সেন্টাইল) বা এসএমপি-র। এই এসএমপি ২০-র নীচে হলে তা খরা পরিস্থিতি হিসেবে গণ্য হয়েছে।

মডেলের সাহায্যে দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ দুর্ভিক্ষের কারণই ছিল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মাটির আর্দ্রতার প্রবল খরা, যার ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। উপরোক্ত দেড়শো বছরের মধ্যে যে ছটি বড় দুর্ভিক্ষের কথা জানা যায় (১৮৭৩-৭৪, ১৮৭৬, ১৮৭৭, ১৮৯৬-৯৭, ১৮৯৯, ১৯৪৩-৪৪), সেগুলির বিশ্লেষণ করে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে প্রথম পাঁচটি কৃষি ব্যর্থতার পরিণাম। কিন্তু ১৯৪৩-এর বাংলার মন্বন্তরের জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী ব্রিটিশ সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা, বলছেন অধ্যাপক মিশ্র, যিনি তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীদের গবেষণাকে "আংশিক ইতিহাস, আংশিক বিজ্ঞান" বলে বর্ণনা করেছেন।

bengal famine 1943 causes ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান পঞ্চাশের মন্বন্তরে

গবেষণায় নির্ধারিত খরা পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে ছটির মধ্যে চারটি দুর্ভিক্ষের। কিন্তু দুটির নেই - ১৮৭৩-৭৪ এবং ১৯৪৩-৪৪। গবেষণা অনুযায়ী যা বোঝা যাচ্ছে, এই দুই দুর্ভিক্ষের যে খরা পরিস্থিতির সঙ্গে কোনো যোগ নেই, তার সম্ভাব্য কারণ দুটি - হয় সেগুলি একেবারেই স্থান ভিত্তিক, নয় সেগুলি মাটিতে আর্দ্রতার অভাবের ফলে সৃষ্ট হয় নি। যেহেতু ১৮৭৩-৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বিহার ও বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, এক্ষেত্রে প্রথম কারণটিই প্রযোজ্য। গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, "যেহেতু ১৮৭৩-এ মাটির আর্দ্রতার খরা একটি সীমিত পরিসরে আবদ্ধ ছিল, বিশ্লেষনে তা ধরা পড়ে নি।"

অন্যদিকে, অধ্যাপক মিশ্র বলছেন, "বাংলায় ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ খরার কারণে নয়, বরং সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ সরকারের নীতিগত ব্যর্থতার পরিণাম।"

জানা, আবার জানা

পঞ্চাশের মন্বন্তরের শিকার হন ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরেই ঐতিহাসিক গবেষণা, সাহিত্য, এমনকী সিনেমাও (উদাহরণ, সত্যজিৎ রায়ের ১৯৭৩ সালের ছবি 'অশনি সংকেত') এর জন্য ব্রিটিশ শাসনকে দায়ী করে এসেছে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, পরিবহণ এবং বাজার ব্যবস্থার অতি করুণ দশা। যার প্রধান কারণ ব্রিটিশ সরকারের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে খাদ্য এবং পণ্য সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত।

নতুন এই গবেষণায় ১৯৩৭-৪৫ সালের সময়কালকে চিহ্নিত করা হয়েছে "প্রকোপ, এলাকা এবং মেয়াদের ভিত্তিতে খরা কবলিত সময়" হিসেবে। অধ্যাপক মিশ্রের কথায়, "আমরা দেখি, ১৯৪১-এর অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে, অর্থাৎ মন্বন্তরের আগে, খরার প্রকোপ সবচেয়ে বিস্তৃত ছিল। কাজেই এটি সম্ভবত একমাত্র দুর্ভিক্ষ যার সঙ্গে মাটিতে আর্দ্রতার অভাব বা কৃষি উৎপাদনের ব্যর্থতার কোনো যোগ নেই।"

ঐতিহাসিকদের পথে হেঁটেই মিশ্র বলেছেন, "আমরা যা পেয়েছি, তাতে এটাই মনে হয় যে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণ অনেকটাই এশিয়ার ওপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, যার জেরে দেখা দেয় ম্যালেরিয়া, অনাহার, এবং অপুষ্টি। ১৯৪৩-এর গোড়ার দিকে সামরিক এবং রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কুপ্রভাব বেশ ভালভাবেই বোঝা যাচ্ছিল বাংলার অর্থনীতিতে, যার ওপর আরও চাপ সৃষ্টি হয়েছিল বর্মা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কারণে। এছাড়াও, যুদ্ধকালীন শস্য আমদানির ওপর নানারকম বিধিনিষেধ জারি করেছিল ব্রিটিশ সরকার, যা দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছিল।"

West Bengal