Advertisment

তাপবিদ্যুতে লোডশেডিংয়ের ছায়া, কী করছে সরকার?

কতটা কঠিন ভারতের কয়লা সঙ্কট, সরকার কী করছে?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Coal Shortage

দোষ কারো নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা। দুর্গাপুজোর শেষের বাদ্যি বাজল, কালীপুজো-দীপাবলির কাউন্টডাউন শুরু হল বলে। দীপ নিভে গেছে মম, এই গানটা দীপাবলির আগে ভারতের রিংটোন না হয়ে যায়! কয়লা-সঙ্কট যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তাতে সেই আশঙ্কাটা মামদোর মতো ঘাড়ে চেপে বসছে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার অভয় দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে হাল ধরেছেন। মাঠে নেমে পড়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। বৃহস্পতিবার কয়লামন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী গিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ডের চাতরার পিপারওয়ারে। সেন্ট্রাল কোলফিল্ড লিমিটেডের অশোক খনি অঞ্চল ঘুরে দেখেন তিনি। আশ্বাস-ভরা তাঁর বাণী, পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে।

Advertisment

কতটা কঠিন ভারতের কয়লা সঙ্কট, সরকার কী করছে?

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে এখন গড়ে চার দিনের কয়লা মজুত রয়েছে। যদিও কয়লা থাকার কথা নিয়ম অনুযায়ী ১৫ থেকে ৩০ দিনের। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি রাজ্যে কয়লা-সঙ্কটের জেরে বিপর্যয়ের প্রাকপর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে রাজস্থান, পঞ্জাব এবং বিহার। লোডশেডিং হচ্ছে সেখানে। কেন এই সঙ্কট, তা ইতিমধ্যেই বহুচর্চিত, তবুও আরেক বার বলছি। কোভিড পেরিয়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে, এখন বিদ্যুতের চাহিদা দ্রুত লয়ে বাড়ছে। সেই তুলনায় কয়লার জোগান কম। তাতেই এই সঙ্কট। কয়লামন্ত্রী বৃহস্পতিবার বলেছেন, কিছু খনি বন্ধ হয়ে যাওয়া, তার উপর কিছু খনিতে প্রবল বৃষ্টিতে কয়লা উত্তোলনে ব্যাঘাতে এই অবস্থা।

তবে এতে আতঙ্কের কোনও কারণ নেই। প্যানিক করবেন না। মন্ত্রীর এমন আবেদন, যা আকুতিই হয়তো। হালহকিকতে আরও একটু গভীর নজর দেওয়া যেতে পারে। ২০১৯-এর অগস্টে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১০৬ বিলিয়ন ইউনিট, যা এ বছরের অগস্টে ১২৪ ইউনিটে এসে পৌঁছে গিয়ে চাপ তৈরি করেছে। তার উপর রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দামে ঊর্ধ্বগতি। ফলে এপ্রিল-জুনে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি কয়লা মজুত কমে যায় বেশ কিছুটা। সেই ধাক্কাটা দাঁতনখ বার করে ফেলে বেলাগাম বৃষ্টিতে। ভারতের বিদ্যুতের সিংহভাগ কয়লার উপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭০ শতাংশই এই কালো খনিজ পদার্থ থেকে তৈরি হয়। ফলে তলানিতে থাকা কয়লা-মজুতে দেশ জোড়া অন্ধকারের এই আতঙ্ক তৈরি হওয়াটা মোটেই অমূলক নয়। বিশেষ করে উৎসবের এই মরসুমে মেরুদণ্ডে ভয়টা বিদ্যুতের ঝকটা দেবেই।

বিদ্যুৎ ও বিজ্ঞানী

এই প্রসঙ্গে একটু পিছনে ফিরে দেখা যেতে পারে। বিরাট বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা ব্যাপক ভাবে পরমাণু বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য সওয়াল করেছিলেন বারবার। মেঘনাথ সাংসদও ছিলেন। সংসদেও এই বিষয়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে। তাঁর যুক্তি ছিল, বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ কয়লা আমরা ব্যবহার করছি, তাতে ৫০-৬০ বছরে ভূগর্ভস্থ কয়লা শেষ হয়ে যেতে পারে। মেঘনাথ সাহা উদ্বাস্তুদের হয়েও আন্দোলন করেছিলেন, আর তাতে তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিরাগভাজন হয়ে পড়েন বলে জানা যায়। দু'জনের মধ্যে টানাপোড়েন লেগে থাকত। সংসদে মেঘনাথ সাহার বক্তব্য ছিল, ভারত সরকার পরমাণু বিদ্যুৎ প্রসারের বিষয়টিতে মোটেই নজর দিচ্ছে না। পারমাণবিক শক্তি সংক্রান্ত মন্ত্রক প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অধীনে, তাই মেঘনাথের আক্রমণ তো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ছিল। ডক্টর সাহার উদ্বাস্তু আন্দোলন নিয়ে যে ক্ষোভানল জমা ছিল নেহরুর মধ্যে, সেই আগুনে যেন ওই পরমাণু-মন্তব্য ঘি ঢেলে দিয়েছিল।

লোকসভায় নেহরু নাকি বলেছিলেন, ডক্টর সাহা এ সম্পর্কে কোনও খবর রাখেন না, কারণ তাঁর সঙ্গে এখন বিজ্ঞান ও গবেষণার কোনও যোগই নেই। যদিও মেঘনাথ সাহাকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী যে রীতিমতো ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন, তার অনেক উহারণ ইতিহাসের ঘরে মজুত রয়েছে। হয়তো এই আকচাআকচি তা নিষ্প্রভ করবে না। তবে মেঘনাথ সাহার মতো দূরদর্শী বিজ্ঞানীর পথে যে ভারত চলেনি, সেটা স্পষ্ট যে কয়লায় আমাদের বিদ্যুৎ নির্ভরশীলতার এই ছবিতে, এবং এমন অকূল পাথারে পড়ার চিত্রে। আগের চেয়ে কয়লা-ব্যতীত পথটা অনেক বেড়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু যতটা বাড়ার কথা ছিল তার চেয়ে এই এত বড় দেশ শত যোজন পিছিয়ে।

সঙ্কটমোচনে সরকারের কী পদক্ষেপ?

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে কয়লা পৌঁছে দেওয়ার পরিমাণ বাড়াতে সরকার এখন উঠেপড়ে লেগেছে। বুধবার কয়লামন্ত্রী যোশীর টুইট, ১১ অক্টোবরের হিসেবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে ২০ লক্ষ টন কয়লা পাঠানো হয়েছে, ১৮ লক্ষ ৭০ হাজার টন প্রয়োজন এখন। বিদ্যুৎমন্ত্রকের তরফে স্থানীয় কয়লার সঙ্গে ১০ শতাংশ আমদানিকৃত কয়লা মেশানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিকে। এর ফলে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০-২২ পয়সা বেশি খরচ হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সেই বাড়তি খরচ তারা বিদ্যুৎবণ্টন সংস্থাগুলির থেকে নিতে পারবে।

আরও পড়ুন কয়লা-ঘাটতি, তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে নাভিশ্বাস, কেন?

এদিকে ইন্ডিয়া এনার্জি এক্সচেঞ্জের (IEX) ডে অ্যাহেড মার্কেটেও (DAM) দাম নিয়ে তুলকালাম চলছে। অ্যাভারেজ ক্লিয়ারিং প্রাইজ বা গড় নির্ধারিত দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। আমদানিকৃত কয়লায় বিদ্য়ুৎ উৎপাদনের প্রেক্ষিতে বেসরকারি উৎপাদক সংস্থাগুলিকে কড়া বার্তা দিয়েছে সরকার। গুজরাটের মুন্দ্রায় টাটা পাওয়ার এবং আদানি পাওয়ার তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে রেখেছে। আমদানির কয়লায় চলে বলে এই সব কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য হয়ে যাচ্ছে মাত্রা ছাড়া, পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী নির্ধারিত দামে তাদের পক্ষে বিদ্যুৎ বিক্রি সম্ভব হচ্ছে না। এটাই এই সব সংস্থার পক্ষে উৎপাদন বন্ধের যুক্তি। সরকারের ডাকা বৈঠকেও তারা এ সওয়াল করেছে। বলেছে, প্রতি ইউনিটে আড়াই টাকা ক্ষতি হচ্ছে তাদের।

কিন্তু সরকারের স্পষ্ট কথা, কোনও ভাবে পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ রাখা যাবে না। টাটা ও আদানি পাওয়ারের মুন্দ্রার দুটি প্রকল্প ৪ হাজার করে ৮ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন। গত সপ্তাহে সরকারের ওই বৈঠকে এসার এনার্জিও ছিল। ছিল গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্রের আধিকারিকরা। রাজ্যগুলিকে কেন্দ্র সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ইচ্ছাকৃত ভাবে যারা উৎপাদন বন্ধ করে রেখেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যেন তারা পিছপা না হয়।

যা হোক, দীপাবলির দিনগুলি আলোয় কাটাবে ভারত। আকাশ ঘিরে যতই মেঘ করুক না কেন, দুর্যোগ কেটে যাবে, বিদ্যুৎ দুর্বল হবে না মোটেই, এই আশায় সরকার থেকে আম জনতা।

Coal Shortage
Advertisment