Subhas Bose: মঙ্গলবার ছিল ২৩ জানুয়ারি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী। যা দেশে 'পরাক্রম দিবস' (শৌর্য দিবস) হিসেবে পালিত হয়। ভারতের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বাহিনীতে, সুভাষ বোস একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার লক্ষ্যে একটি সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে সামরিকভাবে পরাজিত করতে ব্রিটেনের শত্রুদের সাহায্য চেয়েছিলেন। সুভাষ বোসের নানা গুণাবলির অন্যতম হল, তাঁর সাহস, ভারতের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ লড়াই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে কলকাতায় গৃহবন্দি হওয়া। সেখান থেকে জার্মানিতে পালিয়ে যাওয়া- সুভাষচন্দ্রের জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়। কলকাতা থেকে গোমো হয়ে পেশোয়ারের পথে কাবুল, সেখান থেকে রাশিয়া। বোস কীভাবে বার্লিনে পৌঁছেন, সে এক বিরাট অধ্যায়। পথে তিনবার তিনি পরিচয় বদল করেছিলেন।
- শহিদ মিনার অপসারণের দাবিতে সুভাষচন্দ্র আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
- গোমো থেকে পেশোয়ারের পথে তাঁর নাম ছিল মহম্মদ জিয়াউদ্দিন। সেখান থেকে কাবুল অবধি নাম ছিল রহমত।
- বার্লিন পর্যন্ত তাঁর নাম ছিল অরল্যান্ডো মাজোট্টা।
জুলাই ১৯৪০: বসুকে গ্রেফতার করা হয়
১৯৪০ সালের জুলাইয়ের মধ্যে, সুভাষ বসু কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। গড়ে তোলেন তাঁর নিজস্ব দল ফরওয়ার্ড ব্লক। ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাঁর প্রতিশ্রুতি ছাড়াও, বসু হিন্দু-মুসলিম ঐক্যেরও একজন কট্টর সমর্থক ছিলেন। তিনি কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের দাবিতে একটি আন্দোলনে যোগ দেন। এই স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি হয় ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দিদের স্মরণে। সেই সব ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দি, যাঁরা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ির কারণে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। জন জেফানিয়া হলওয়েল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারী ছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে ১৭৫৬ সালের জুন মাসে নবাবের বাহিনী ব্রিটিশদের পরাজিত করার পর, ফোর্ট উইলিয়ামের একটি ছোট কক্ষে ('ব্ল্যাক হোল') প্রচুর সংখ্যক যুদ্ধবন্দিকে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেখানে ১০০ জনেরও বেশি বন্দি দমবন্ধ হয়ে মারা যান। বোস এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদীরা এই অভিযোগকে অতিরঞ্জিত বলে বিশ্বাস করতেন। আর, স্মৃতিস্তম্ভটিকে নবাবের স্মৃতির অপমান বলে মনে করেছিলেন। শহিদ মিনার অপসারণের জন্য আন্দোলন শুরু হলে, ব্রিটিশরা কড়াকড়ি শুরু করে। তারা একে ভারতের প্রতিরক্ষা বিধি এবং রাষ্ট্রদ্রোহের বিরুদ্ধে সুভাষ বোসের লড়াই বলে মনে করেন। আর, সুভাষ বোসকে গ্রেফতার করেন। বোসের অবশ্য জেলে থাকার কোনও ইচ্ছা ছিল না। কারণ, সেই সময় বিশ্বে বহু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছিল। যাকে ভারতের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে চাইছিলেন নেতাজি। সেই লক্ষ্যে তিনি নিজের মুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। জনপ্রিয় নেতার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় ব্রিটিশরা তাঁকে ছেড়ে দেন। তিনি সুস্থ হয়ে গেলে ফের তাঁকে গ্রেফতার করার ইচ্ছা ছিল ব্রিটিশদের।
আরও পড়ুন- স্বাধীনতা যুদ্ধের উপেক্ষিত মহানায়ক, যিনি না থাকলে আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি হত না
শুরু হয় পালানোর পরিকল্পনা
১৯৪০ সালের ৬ ডিসেম্বর, ব্রিটিশ গুপ্তচরদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র তাঁর কলকাতার বাড়িতে ফেরেন। বাড়ির চারপাশে পাহারা দিতে শুরু করে ব্রিটিশ পুলিশ। বাড়ির যাবতীয় চিঠিপত্রেও পুলিশ সমানে নজরদারি চালাচ্ছিল। যাইহোক, বোস তাঁর ভাগ্নে শিশিরের সঙ্গে, পালানোর উপায় পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে, আরও কিছু লোক এই পরিকল্পনায় জড়িত হন। যার মধ্যে ছিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রাদেশিক প্রধান মিয়া আকবর শাহ। তিনি তাঁর যৌবনে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভ্রমণ করেছিলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে বসু উত্তর ভারতীয় মুসলিম ভদ্রলোক মহম্মদ জিয়াউদ্দিন সেজে পেশোয়ারে যাবেন। সেখান থেকে যাবেন কাবুল। সন্দেহ দূর করার জন্য, বোস তাঁর সমস্ত চিঠিতে ভবিষ্যতে জেলে প্রত্যাবর্তনের কথা বলেছিলেন। এমনকী, তিনি কিছু পোস্ট-ডেটেড চিঠিও লিখেছিলেন। যা তাঁর পালানোর পরে পোস্ট করা যেতে পারে। তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করার জন্য হাতে আরও সময় চাইছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি মধ্যরাতের পরপরই, সুভাষ বোস ও শিশির বোস, গাড়ি চেপে বাড়ি ছাড়েন। ইতিহাসবিদ সুগত বসু তাঁর 'His Majesty’s Opponen', গ্রন্থে লিখেছেন, 'সুভাষচন্দ্র মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের বেশ ধরেছিলেন। একটি লম্বা, বাদামি, বন্ধ কলারের কোট, ব্যাগি শালওয়ার এবং একটি কালো ফেজ টুপি পরেছিলেন। চোখে ছিল সোনার তারের-রিমযুক্ত চশমা। যা তিনি এক দশকেরও বেশি আগে ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।' শিশির বসু ধানবাদের কাছে তাঁর ভাই অশোকের বাড়িতে গাড়ি চালিয়ে যান। সেখান থেকে অশোক, তাঁর স্ত্রী, শিশির বসু ও মহম্মদ জিয়াউদ্দিন গোমো স্টেশনে যান। সেখানে জিয়াউদ্দিন পেশোয়ারের ট্রেন ধরেন।
আরও পড়ুন- বাংলার পথেই পঞ্জাব! জোট নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেই বিরাট ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী মানের
সীমান্ত পেরিয়ে
সীমান্ত পেরিয়ে সুভাষ বোস মিয়া আকবর খানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আকবর খান, একটি গাড়ি এবং একটি উপজাতীয় গাইডের সাহায্যে পায়ে হেঁটে সুভাষ বোসকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে আফগানিস্তানে পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বোস সেখানে একজন মূক-বধির পাঠানের ছদ্মবেশ ধরেছিলেন। বোস স্থানীয় ভাষা পশতু বলতে না-পারায় মূক-বধির সাজার দরকার হয়ে পড়েছিল। সুগত বোস লিখেছেন, সুভাষ বোস সেখানে নাম নিয়েছিলেন রহমত খান। তাঁকে শেখানো হয়েছিল কীভাবে একটি কান্দোলি থেকে জল পান করতে হয়। একটি সাধারণ প্লেট থেকে সকলের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করতে হয়। সীমান্ত অতিক্রম করার পর, বোস এবং তাঁর সাহায্যকারীরা পৌঁছন কাবুলে। সেই সময় ব্রিটিশরা জানতে পেরেছিল যে সুভাষ বোস পালিয়েছেন। তারা তাঁকে খুঁজতে শুরু করে। ইতালি, রাশিয়া এবং জার্মানি সুভাষ বোসকে রাশিয়া হয়ে বার্লিনে যেতে সাহায্য করেছিল। সুভাষ বোস জার্মান দূতাবাসে গিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন। ইতালীয় কূটনৈতিক অরল্যান্ডো মাজোট্টার আসল পাসপোর্ট সুভাষ বোস কাবুল থেকে পালাতে ব্যবহার করেছিলেন। অবশেষে, ১৯৪১ সালের ২ এপ্রিল, বোস চারটি দেশ অতিক্রম করে বার্লিনে পৌঁছন। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে যান।
আরও পড়ুন- কানাডায় বিদেশি ছাত্রদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, কতটা প্রভাব পড়বে ভারতীয়দের ওপর?