/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2021/07/drone-1.jpg)
সীমান্তে ড্রোন হানা ঘিরে আতঙ্ক।
রবিবার ভোররাত। জম্মু বিমানবন্দর। আচমকাই প্রবল শব্দে চারদিক খানখান। শব্দের তীব্রতা এত যে, দু'কিলোমিটার দূরেও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন লোকজন ঝটকায় উঠে বসলেন। কী হয়েছে? কিছুক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্রে হয়ে গেল, জঙ্গি হানা। না, সশরীরে আসেনি কোনও জঙ্গি। দুটি ড্রোন থেকে দুটি বোমা ফেলা হয়েছে। আইইডি-র সঙ্গে অন্য বিস্ফোরক ঠাসা। একটি পড়েছে এক বাড়ির মাথায়, আরেকটি তার থেকে অল্প দূরে। এয়ার ফোর্সের দু'জন জওয়ান এই বিস্ফোরণে আহত। এই ভাবে হামলা এ দেশে প্রথমবার হল। বৃহস্পতিবার সেনা প্রধান এম এম নরাভনে বলেন, 'ডু ইট ইয়োরসেলফ বা ডিআইওয়াই ড্রোনের সাহায্যে এমন হামলা রুখতে সব রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে ভারত।' ব্যবস্থা নেওয়ার আগে, আর যেন হামলা না হয়, আশায় রয়েছে দেশ।
কবে থেকে সেনা ও জঙ্গিরা ড্রোন ব্যবহার শুরু করল?
এক দশক ধরে ড্রোন অথবা আনম্যানড এরিয়াল ভেইক্যল (UAV) ব্যবহার বাড়ছে আইন-শৃঙ্খলা, কুরিয়ার সার্ভিস এবং নজরদারি ও হামলায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় যুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহার করেছিল, ১৯৯০ থেকে ভারতেও আধুনিক ড্রোনের ব্যবহার শুরু হল প্রতিরক্ষায়। আনম্যানড এরিয়াল ভেইক্যল বা ইউএভি ২৫০ গ্রাম (উড়তে পারে ২ হাজার ফুট এবং পরিসর ২ কিলোমিটার ) থেকে ১৫০ কিলোগ্রাম (উড়তে পারে ৩ হাজার ফুট এবং অনির্দিষ্ট পরিসর) কাজে লাগে বেশি। ভারতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় কোয়াড এবং হেক্সাকপ্টার্স। অসামরিক এবং ব্যবসায়িক কাজে লাগে এই ড্রোন। এবং হেরন ড্রোন ব্যবহার করা হয় সামরিক নজরদারিতে। নানা ধরনের ড্রোন নানা ধরনের প্রযুক্তিতে চালানো হয়ে থাকে। রিমোট কন্ট্রোল, জিপিএস এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি, অটোপাইলট অ্যাসিস্ট্যান্স ইত্যাদি রয়েছে প্রযুক্তির তালিকায়। অ্যাসোসিয়েশন অফ ইউএস আর্মি বলছে, প্রথম ড্রোন হামলা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে, হামলা চালায় জাপানি জঙ্গি সংগঠন আম শিনরিকিও, তারা রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টারের সাহায্যে কাজটি করে, উদ্দেশ্য ভয়ঙ্কর সারিন গ্যাস স্প্রে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টারটি ক্র্যাশ করে যায়। ২০১৩ সালে আল-কায়দা পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি ড্রোনের সাহায্যে পাকিস্তানে হামলার চেষ্টা করে, তা-ও ব্যর্থ হয়। ইসলামিক স্টেট বা আইএস বার বার ড্রোন অ্যাটাক করেছে সিরিয়া এবং ইরাকে। তালিবানের দল আফগানিস্তানে প্রবল নজরদারি চালাত ড্রোনের সাহায্যে। হেজবুল্লা, মুথি জঙ্গিরাও মানুষ-শূন্য এই যান কাজে লাগিয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সিরিয়ায় রুশ সেনা শিবিরে ১৩টি ড্রোনের একটি ঝাঁক হানা দেয়। ২০১৮ সালের অগস্টে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোও ড্রোন হামলার টার্গেট হলেন। সেনার অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন, তখনই তাঁকে লক্ষ্য করে উড়ে এল বোমারু ড্রোন। আইইডি বহন করে নিয়ে যাওয়া, এবং জিপিএসের মাধ্যমে চালানো অ্যাটাক। একটুর জন্য রক্ষা পান মাদুরো। অ্যাসোসিয়েশন অফ ইউএস আর্মি বলছে, ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১৪টিরও বেশি জঙ্গি হামলা হয় ড্রোনের সাহায্যে।
গত বছরে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধে সাঁজোয়াগাড়ির মতো চালু অস্ত্রের বিরুদ্ধে ড্রোনকে কাজে লাগানো হয়েছে। আমাদের সেনাপ্রধান এই প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স এবং কল্পনাশক্তি কাজে লাগিয়ে ড্রোনের হামলা প্রথম হয়েছিল ইদলিবে। তার পর আর্মেনিয়া-আজারবাইজানে। যুদ্ধের প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্রকে ড্রোন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।
ভারতের কী অভিজ্ঞতা?
গত তিন বছরে ড্রোন থেকে অস্ত্রশস্ত্র ফেলা, নেশার রসদ ফেলা হয়েছে। ১৪ মে জম্মুতে ড্রোনের মাধ্যমে ফেলা অস্ত্র উদ্ধার করে বিএসএফ। পাকিস্তানের এই ড্রোন নিয়ে এসেছিল একটি এ কে ফোর্টিসেভেন, অ্যাসল্ট রাইফেল, পিস্তল ইত্যাদি। ভারতের সীমা পেরিয়ে কী করে এত কিছু নিয়ে ড্রোনের প্রবেশ ঘটল, হইচই হয়েছিল বিস্তর। গত বছরের ২০ জুন, জম্মুর হিরানগরে বিএসএফ গুলি করে নামায় একটি মানুষশূন্য যান। সেটি ছিল হেক্সাকপ্টার, ড্রোন থেকে পাওয়া গিয়েছিল M4 সেমিঅটোমেটিক কার্বাইন, সাতটা চিনা গ্রেনেড এবং গুলি। সূত্র বলছে, কয়েক বছরে ১০০-১৫০টি ড্রোন দেখা গিয়েছে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে। বেশির ভাগেরই লক্ষ্য ছিল গোপন নজরদারি।
কী করে লাগাম দেওয়া যাবে?
ড্রোন হামলা নিয়ে চিন্তা বাড়ছে। অনেক সময়ই রেডারে ড্রোন ধরা পড়ছে না। পাখি না অন্য কিছু, রেডার বুঝে উঠতে পারছে না। ছোট ছোট ড্রোন চোখকে ফাঁকি দিয়ে যায়, হঠাৎ দেখা যায় কাজের কাজটি হয়ে গিয়েছে। তবে দেখতে পেলে জওয়ানরা যেমন ড্রোন গুলি করে নামাচ্ছেন, তেমনই এতে লাগাম দিতে প্রযুক্তিরও এসেছে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি কিংবা হাই এনার্জি বিমের মাধ্যমে ড্রোন ধরার কাজ করে সেনা। এ সব যে একশো শতাংশ ড্রোনকেই টুঁটি টিপে ধরবে, তা বলা যাচ্ছে না।
অ্যান্টি-ড্রোন প্রযুক্তি আছে কি?
অবশ্য ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (DRDO) 'ড্রোন পাও, মেরে দাও' প্রযুক্তি তৈরি করে ফেলেছে। কিন্তু তা এখনও প্রতিরক্ষায় যথেষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে না। কারণ, এর প্রোডাকশনের খামতি। ডিআরডিও-র এই কাউন্টার ড্রোন প্রযুক্তি ভিভিআইপিদের নিরাপত্তার কাজে লাগানো হয় প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে, ২০২০ ও ২১-তে। এই টেকনোলজি দু'জাতীয়, হার্ডকিল: লেজার রশ্মি দিয়ে ড্রোন ধরো এবং ধ্বংস করে দাও। অন্যটি সফট-কিল: ড্রোনের সিগন্যাল জ্যাম করে তার টুঁ-ফাঁ বন্ধ করে দাও। এই অ্যান্টি-ড্রোন যন্ত্রে রয়েছে ৩৬০ ডিগ্রির রেডার-নজর, চতুর্দিকের নজরে ধরা পড়ে ৪ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ড্রোনের গতিবিধি। সফট স্কিলের ক্ষেত্রে তিন কিলোমিটার রেঞ্জ এবং হার্ড স্কিলে রেঞ্জ ১৫০ মিটার থেকে ১ কিলোমিটার। দেশের বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা সংস্থা এই দুই প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে। হিন্ডন এয়ার ফোর্স স্টেশনে গত বছরের জানুয়ারিতে এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার হয়েছে। গত অগস্ট ও এই জানুয়ারিতে মানেসরে ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের ক্যাম্পাসে এর পরীক্ষা হয়েছে।
এক ঝাঁক ড্রোন যদি লক্ষ্যের দিকে উড়ে আসে, তা হলে কি তার মোকাবিলা সম্ভব? ১৫ জানুয়ারি, সেনা দিবসের কুচকাওয়াজে স্যোয়ার্ম টেকনোলজি মানে ঝাঁকে এসে ড্রোনের হামলার কৌশল দেখানো হয়েছে হাতে-কলমে, দেখে তারিফের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল। হামলার ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু এমন প্রত্যাঘাতের কৌশলে কি তৈরি ভারত? সেনাপ্রধান যেন বলতে চাইছেন, পিকচার বাকি আছে, গবেষণা চলছে।
Read in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন