Advertisment

সুপ্রিম কোর্ট কি সত্যিই আঞ্চলিক ভিত্তিতে ভাগ হতে পারে?

বিপুল কাজের চাপের ফলে বিচারপতিরা বেশিরভাগই দুই বা তিন-সদস্যের বেঞ্চ গঠন করে সবরকম মামলার নিষ্পত্তি করেন - যাদের মধ্যে রয়েছে বহু সংখ্যক মামলা যেগুলি সাংবিধানিক নয় এমন, বা অপেক্ষাকৃত নগণ্য কিছু ঘটনা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Supreme Court bifurcation

সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল ছবি

উপ-রাষ্ট্রপতি এম বেঙ্কইয়া নাইডু পরামর্শ দিয়েছেন যে পাহাড়প্রমাণ কাজের চাপ কমাতে এবং জমে থাকা অসংখ্য মামলার নিষ্পত্তির স্বার্থে চারটি আঞ্চলিক বেঞ্চে বিভক্ত হয়ে যাক ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্টকে দুটি ডিভিশনে ভাগ করার জাতীয় আইন কমিশনের সুপারিশকেও সমর্থন করেছেন নাইডু। এই বিষয়টি নতুন কিছু নয়; আইন কমিশন ছাড়াও এবছরের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারেও এই দুই সুপারিশের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলিকে নিয়ে সেই অর্থে আলোচনা হয় নি, এবং স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টের তরফে এই সুপারিশের বিরোধিতা করা হয়েছে। শুক্রবার একাধিক বর্তমান এবং প্রাক্তন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের উপস্থিতিতে তাঁর বক্তব্য রাখেন নাইডু।

Advertisment

জমে থাকা মামলার সমস্যা

বিশ্বের প্রথম সাংবিধানিক আদালত চালু হয় ইউরোপে - ১৯২০ সালে অস্ট্রিয়ায়, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানিতে। আজ পৃথিবীর ৫৫ টি দেশে রয়েছে সাংবিধানিক আদালত, এবং এই তালিকায় রয়েছে ইউরোপের বা দেওয়ানি এক্তিয়ারের অধিকাংশ। স্বাধীন ভারতে শুরুর দিকে কয়েক বছর সুপ্রিম কোর্টও ছিল মূলত সাংবিধানিক আদালতই। বছরে গড়ে ৭০-৮০ টি রায় দেওয়া হতো পাঁচ বা তার বেশি সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের তরফে। এই সব বিচারপতিরা মূলত রায় দিতেন সংবিধানের ১৪৫ (৩) ধারার ভিত্তিতে, "সংবিধানের ব্যাখ্যার প্রয়োজনে আইনের সারগর্ভ প্রশ্নের" ক্ষেত্রে।

সেই সংখ্যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১০-১২ তে। বিপুল কাজের চাপের ফলে বিচারপতিরা বেশিরভাগই দুই বা তিন-সদস্যের বেঞ্চ গঠন করে সবরকম মামলার নিষ্পত্তি করেন - যাদের মধ্যে রয়েছে বহু সংখ্যক মামলা যেগুলি সাংবিধানিক নয় এমন, বা অপেক্ষাকৃত নগণ্য কিছু ঘটনা, যেমন কোনও চলচ্চিত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা (অথবা তুলে নেওয়া), বা কোনও পুলিশ কমিশনারের ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। এমনকি 'সর্দার জোকস'-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আবেদন, অথবা মুসলমানদের দেশছাড়া করার আবেদন নিয়েও জনস্বার্থ মামলার নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হয় সুপ্রিম কোর্ট।

এই প্রবল কাজের চাপের একটা বড় কারণ এই যে সুপ্রিম কোর্ট সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন আদালত, এবং তার এক্তিয়ার সুদূরপ্রসারী। এখানে শুনানি হয় কেন্দ্র বনাম রাজ্য, অথবা দুই বা তার অধিক রাজ্যের মধ্যে বিবাদ সংক্রান্ত মামলার, দেওয়ানি এবং ফৌজদারি আপিলের ক্ষেত্রে রায় দেওয়া হয়, এবং আইন ও তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টার কাজও করে সুপ্রিম কোর্ট। মৌলিক অধিকার (fundamental rights) ভঙ্গের প্রশ্নে যে কোনও নাগরিক সরাসরি দ্বারস্থ হতে পারেন দেশের শীর্ষ আদালতের। পরিণাম: সুপ্রিম কোর্টের কাছে জমা রয়েছে ৬৫ হাজারেরও বেশি মামলা, এবং আপিলের নিষ্পত্তি হতে লেগে যায় বছরের পর বছর। পাঁচ বা সাতজন বিচারপতির অধীনে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বেশ কিছু মামলা ঝুলে রয়েছে আজ বহু বছর।

কী বলেছিল আইন কমিশন

১৯৮৪ সালের মার্চ মাসে বিচারপতি কে কে ম্যাথুর অধীনে ভারতের দশম আইন কমিশন (৯৫ তম রিপোর্ট) সুপারিশ করে যে "ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দুটি ভাগ থাকা উচিত, যথা (ক) সাংবিধানিক ডিভিশন এবং (খ) আইনি ডিভিশন", এবং "প্রস্তাবিত সাংবিধানিক ডিভিশনের কাছে শুধুমাত্র সাংবিধানিক আইন সংক্রান্ত বিষয়ই পেশ করা হোক"।

বিচারপতি ডি এ দেশাইয়ের অধীনে একাদশ আইন কমিশন (১২৫ তম রিপোর্ট, ১৯৮৮) ফের সুপ্রিম কোর্টকে দুভাগে বিভাজিত করার সুপারিশ করে। এরপর বিচারপতি এ আর লক্ষণনের অধীনে অষ্টাদশ আইন কমিশন (২২৯ তম রিপোর্ট, ২০০৯) পরামর্শ দেয় যে "দিল্লিতে সাংবিধানিক এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মামলার জন্য একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠিত হোক", এবং "উত্তরাঞ্চলে দিল্লি, দক্ষিণাঞ্চলে চেন্নাই/হায়দরাবাদ, পূর্বাঞ্চলে কলকাতা এবং পশ্চিমাঞ্চলে মুম্বইয়ে গঠিত হোক চারটি বাতিলকরণ (Cassation) বেঞ্চ, যাদের কাজ হবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের হাইকোর্ট থেকে উৎপন্ন হওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের নিষ্পত্তি"।

পৃথিবীর বহু দেশে এই ধরনের বাতিলকরণ আদালত রয়েছে, যেখানে সাংবিধানিক নয় এমন মামলা বা নিম্নতর আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের নিষ্পত্তি হয়। সাধারণভাবে এই আদালতগুলির হাতে নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়, যার ফলে এগুলি হয় 'courts of last resort' অথবা শেষ অবলম্বন।

একাধিক বেঞ্চের স্বপক্ষে যুক্তি

সংবিধানের ৩৯ ক ধারা অনুযায়ী, জাতি ধর্ম বা শ্রেণী নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে, এবং তাঁরা যেন তা পান, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একথা সহজেই অনুমেয় যে নয়া দিল্লি পর্যন্ত সফর করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া, অথবা তা নাহলে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে সুপ্রিম কোর্টের উকিল নিযুক্ত করা, দেশের অধিকাংশ নাগরিকের সাধ্যের বাইরে।

এর আগে ২০০৪, ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে সংসদের স্থায়ী কমিটি প্রস্তাব দেয় যে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ অন্যত্র গঠিত হোক। ২০০৮ সালে কমিটি সুপারিশ করে যে পরীক্ষামূলক ভাবে চেন্নাইয়ে অন্তত একটি বেঞ্চ গঠিত হোক। কিন্তু এতে আদালতের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে পারে, এই কারণ দেখিয়ে এই সুপারিশের বিরোধিতা করেছে সুপ্রিম কোর্ট।

সংবিধানের ১৩০ ধারা বলে যে সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি ছাড়াও ভারতের প্রধান বিচারপতি অনুমোদিত অন্য কোনও জায়গায় কখনও কখনও বসতে পারে, যদি রাষ্ট্রপতি অনুমতি দেন। সুপ্রিম কোর্ট রুলস প্রধান বিচারপতিকে বেঞ্চ গঠনের ক্ষমতা প্রদান করে। এর ফলে প্রয়োজনে তিনি নয়া দিল্লিতে একটি সাত-সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ যেমন গঠন করতে পারেন, তেমনই দেশের চার থেকে ছ'টি জায়গায় আরও ছোট বেঞ্চ গঠন করতে পারেন।

supreme court
Advertisment