উনিশ শতকের মাঝামাঝি কিন্তু এই বীজাণু ছড়ানোর বিষয়টি এত বোঝা যেতে না, সে সময়ে এই গাত ধোয়ার পরামর্শকে আদৌ ভাল চোখে নেওয়া হয়নি। হাঙ্গেরির চিকিৎসক ইগনাজ সেমেলউয়িজ এই অভ্যাসের উপর জোর দিয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনি পেয়েছিলেন তখনকার অন্য চিকিৎসকদের উপহাস। বড় দুর্ভোগের মৃত্যু হয়েছিল তাঁর।
Advertisment
সেমেলউয়িজ ও হাত ধোয়া
১৮৪০-এর সেমেলউয়িজ যখন ভিয়েনা সাধারণ হাসপাতালে কাজ করছেন, সে সময়ে বহু মহিলারা বাড়িতে প্রসব করতেন। যাঁরা হতদরিদ্র ছিলেন বা যাঁদের শারীরিক জটিলতা ছিল, তাঁরাই হাসপাতালে প্রসব করতেন। হাসপাতালকে প্রসবের জন্য কোউই পছন্দ করতেন না, তার অন্যতম কারণ ছিল, হাসপাতালে সূতিকাজ্বরে মৃত্যু হত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে।
তখন অনেকেই মনে করতেন, হাওয়াবাতাসের চলাচলের অভাব ও ভিড়ের কারণেই এ ভাবে মৃত্যু ঘটে। সেমেলউয়জ নিজে গবেষণা শুরু করলেন।
ভিয়েনা হাসপাতালে দুটি পৃথক প্রসূতিবিভাগ ছিল। প্রথমটিতে থাকতেন পুরুষ চিকিৎসকরা, দ্বিতীয়টিকে থাকতেন মহিলা চিকিৎসকরা। সেমেলউয়িজ দেখলেন, পুরুষ ডাক্তাররা যে বিভাগে কাজ করেন, সেখানে সূতিকাজ্বরে মহিলাদের মৃত্যুর হার দু থেকে তিনগুণ বেশি।
তিনি প্রথমে বেশ কিছু পূর্বানুমান করলেন- শিশুর জন্ম দেবার সময়ে মহিলার শারীরিক অবস্থান, পুরুষ চিকিৎসকদের দ্বারা পরীক্ষা, ওয়ার্ডে ঘিরে বেড়ানো যাজকের ভয়- এবং এসব সম্ভাবনাকে নিজেই উড়িয়ে দিলেন।
এরপর তিনি আরেকটি পর্যবেক্ষণ করলেন এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। প্রথম বিভাগে পুরুষ ডাক্তার ও ছাত্ররা সকালে অটোপ্সি করবার পর এই বিভাগে এসে রোগী পরীক্ষা করেন ও সন্তান প্রসব করান। দ্বিতীয় বিভাগে কেবল ধাত্রীরাই কাজ করেন এবং তাঁদের সঙ্গে অন্য কারও সংস্পর্শ ঘটে না।
হাসপাতালের প্যাথোলজিস্টের মৃ্ত্যুর পর আরও নিশ্চিত হলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর আগে ওই প্যাথোলজিস্ট এক মহিলার অটোপ্সি করেছিলেন, যাঁর মৃত্যু হয়েছিল সূতিকাজ্বরে। অটোপ্সির সময়ে সময়ে তাঁর আঙুল কেটে যায়। প্যাথোলজিস্টের মৃত্যুর আগে তাঁর শরীরে সূতিকাজ্বরের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল, তা থেকে স্পষ্ট হল অন্যরাও এই রোগে পড়তে পারে।
সেমেলউয়িজ সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, যেসব ডাক্তাররা ডিসেক্টিং রুম থেকে সরাসরি প্রসূতিবিভাগে আসেন, তাঁরা সূতিকাজ্বরে মৃত মহিলাদের থেকে ভয়ংকর পার্টিকল নিয়ে আসেন, তা থেকেই সুস্থ মহিলারা সংক্রমিত হন এবং তাঁদের অপমৃত্যু ঘটে।
১৮৪৭ সালে সেমেলউয়িজ পুরুষ ডাক্তারদের নির্দেশ দেন প্রসূতি বিভাগে স্বাস্থ্যবতী মায়েদের পরীক্ষা করবার আগে হাত ধুতে গবে এবং তাঁদের ইনস্ট্রুমেন্টগুলি ক্লোরিনেটেড লাইম দিয়ে ধুতে হবে।
এর ফল হল অবিশ্বাস্য। ওই বিভাগে মৃত্যু হার ১৮.২৭ শতাংশ থেকে নেমে এল ১.২৭ শতাংশে। শুধু তাই নয়, ১৮৪৮-এর মার্চ থেকে অগাস্টের মধ্যে একজন মহিলারও মৃত্যু হল না।
প্রত্যাখ্যান ও মৃত্যু
সেমেলউয়িজ হাত ধোয়ার উপকারিতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর এই নতুন পদ্ধতি সে সময়ের অনুমোদিত চিকিৎসাজ্ঞানের কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁর সহকারীরা তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করলেন, কারণ তাঁদের মনে হল সেমেলউয়িজের তত্ত্ব বলতে চায় তাঁরাই রোগীমৃত্যুর জন্য দায়ী। ভিয়েনা হাসপাতালে মৃত্যুহার কমলেও, হাসপাতাল হাত ধোয়ার তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করল।
ইগনাজ সেমেলউয়িজ (ছবি- উইকিমিডিয়া কমন্স)
উদ্বিগ্ন সেমেলউয়িজ খোলা চিঠি লিখলেন চিকিৎসকদের কাছে, হাঙ্গেরিতে ফিরে ১৮৬১ সালে নিজের কাজ প্রকাশ করলেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। ১৮৬৫ সালে নার্ভাস ব্রেকডাউনের পর সেমেলউয়িজকে মানিক হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
হাত ধোয়ার তত্ত্ব অবশেষে গৃহীত
সেমেলউয়িজের মৃত্যুর মাত্র দু বছর পর, বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক জোসেফ লিসার সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে হাত ধোয়া ও ইন্স্ট্রুমেন্ট জীবাণুমুক্ত করার উপর জোর দিলেন।
১৮৭০ থেকে চিকিৎসকরা এ পদ্ধতি গ্রহণ করলেন।
সেমেলউয়িজের কাজ সুই পাস্তুরের জীবাণু তত্ত্বের অন্যতম ভিত্তি। পাস্তুরের জীবাণু তত্ত্ব বহু রোগের ক্ষেত্রে বর্তমানে গৃহীত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।