Advertisment

কীভাবে ছ'বছর আগে মিটেছিল আরেক ভারত-চিন সংঘাত

এদিকে দুই নেতা সাবরমতী নদীতীরে দোলনায় বসে দোল খাচ্ছেন, ওদিকে এক হাজারেরও বেশি চিনা সৈনিক লাদাখ ও তিব্বতের দক্ষিণ সীমান্তে চুমার নামক একটি জায়গা দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
narendra modi jinping

সাবরমতী আশ্রমে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী এবং শি জিনপিং

আজ থেকে প্রায় ছ'বছর আগে লাদাখে শেষবার বড় রকমের সংঘাত এড়ায় ভারত ও চিন। সামরিক এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে শেষমেশ শান্তিপূর্ণভাবেই মিটে যায় মামলা। যেমন বর্তমানে হচ্ছে, তেমনই সামরিক আলোচনা হয় লাদাখে, কূটনৈতিক বার্তা বিনিময় বেইজিংয়ে।

Advertisment

সংঘাতের শুরুটা ছিল অতিমাত্রায় নাটকীয়। সেপ্টেম্বর ২০১৪, চিনের রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিং এসেছেন আহমেদাবাদ সফরে, সঙ্গে আছেন সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এদিকে দুই নেতা সাবরমতী নদীতীরে দোলনায় বসে দোল খাচ্ছেন, ওদিকে এক হাজারেরও বেশি চিনা সৈনিক লাদাখ ও তিব্বতের দক্ষিণ সীমান্তে চুমার নামক একটি জায়গা দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করছে।

লাদাখে স্বাভাবিকভাবেই ভারত-চিনের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (Line of Actual Control বা LAC) বরাবর দাঁড়িয়ে রয়েছে ১৬ থেকে ১৮ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের সারি, চুমারও ব্যতিক্রম নয়। তাপমাত্রা কম, সঙ্গে হিমশীতল, তীব্র হাওয়া। এমন একটি এলাকা, যেখানে একেবারে LAC পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে নিয়েছে ভারত, তারপরেই ঝপ করে রাস্তা শেষ, কারণ পথ আটকে রয়েছে একটি বড় নালা, এবং অকস্মাৎ প্রায় ৩০ মিটারের খাড়াই, যাকে ম্যাপে চিহ্নিত করা হয় 30R নামে।

নালার ওপারে চিনাদের রাস্তা, কিন্তু ওই অকস্মাৎ খাড়াইয়ের ফলে তাদের সেনাবাহিনী গাড়ি নিয়ে তাদের "হিসেবমতো" LAC পর্যন্ত আসতে পারে না। বলে রাখা ভালো, চিন যে রেখাটিকে LAC বলে, তা ভারতের হিসেবমতো গঠিত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে আরও বেশ কিছুটা উত্তরে।

তা এই 30R পর্যন্ত সাধারণত গাড়িতে চড়ে আসে চিনা সৈনিকরা, তারপর নেমে হয় পায়ে হেঁটে নাহয় ঘোড়ার পিঠে টহল দিতে থাকে, যার জবাবে তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে 'ব্যানার ড্রিল'-এর পর ফেরত যেতে বাধ্য করে ভারতীয় সেনা। এইভাবে ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে এই এলাকায় ক্রমশ বাড়তে থাকে চিনাদের অতিক্রমণ।

তৎকালীন নর্দার্ন আর্মি কম্যান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডিএস হুডা (অবসরপ্রাপ্ত) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, "আর্মি কম্যান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবার যখন লাদাখ যাই, তখন দেখি আমাদের সৈন্যরা যে ম্যাপ নিয়ে ঘোরে, তাতে আমাদের LAC স্পষ্টভাবে আঁকা রয়েছে, কিন্তু সেইসঙ্গে চিনাদের 'হিসেবমতো' LAC-ও আঁকা রয়েছে, 'ডটেড লাইন' দিয়ে। আমি নির্দেশ জারি করি যে ম্যাপে স্রেফ একটাই LAC আঁকা থাকবে, আমাদের LAC, এবং আমাদের হেডকোয়ার্টারে যে রেকর্ড ম্যাপ থাকে, চিনাদের লাইন তাতে আঁকা থাকলেই চলবে।"

ফিরে আসা যাক ২০১৪-র সেপ্টেম্বরে। একদিকে উত্তেজনার পারদ চড়ছে, অন্যদিকে চিনারা কিছু বুলডোজার এবং অন্যান্য নির্মাণ সরঞ্জাম নিয়ে পৌঁছে গেছে 30R এলাকায়। উদ্দেশ্য, নতুন রাস্তা তৈরি।

publive-image সীমান্তে ভারতীয় সেনা, ফাইল ছবি

স্থানীয় ভারতীয় কোম্পানি কম্যান্ডার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে বাধা দেন চিনাদের কাজে, যার ফলে আরও বৃদ্ধি পায় উত্তেজনা। চুমারের পশ্চিমে ভারী সংখ্যায় জড়ো হয় চিনা পক্ষ, এবং শি জিনপিং যতক্ষণে ভারতে পৌঁছেছেন, ততক্ষণে LAC ধরে প্রায় ১০ কিমি এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে সংঘাতের সম্ভাবনা। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুডার কথায়, "সে বছর আমরা ঠিক করেছিলাম, লাদাখের রিজার্ভ ডিভিশন থেকে একটি ব্রিগেডকে গ্রীষ্মকালে পরীক্ষামূলক ভাবে এখানে নিয়ে আসব, এবং যখন সীমান্তে উত্তেজনা শুরু হলো, আমরা সেই ব্রিগেড থেকেই দ্রুত সৈন্য মোতায়েন করতে পেরেছিলাম চুমারে।"

উত্তেজনার তুঙ্গে ১,৫০০ চিনা সৈনিকের মোকাবিলায় মোতায়েন ছিলেন প্রায় ২,৫০০ ভারতীয় সৈনিক, এবং উভয় পক্ষেরই আন্দাজ ৮০০ জন করে সৈন্য তৈরি ছিলেন সম্মুখ সমরের জন্য।

চিনারা বুঝতে পারে যে আর রাস্তা তৈরি করা যাবে না, এবং ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেড কম্যান্ডারদের স্তরে শুরু হয় আলোচনা। চিনারা দাবি জানায় যে চুমারে সৈন্যদের থাকার জন্য যে শেল্টার নির্মাণ করছিল ভারত, তা বন্ধ করে দেওয়া হোক, এবং দেমচোক নামক জায়গায় জলের প্রণালী তৈরির কাজও বন্ধ হোক।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুডা বলছেন এগুলি "ওদের অজুহাত ছিল, মূল উদ্দেশ্য ছিল গাড়ি নিয়ে ভারতীয় এলাকায় আরও গভীরে আসার পথে যে বাধা, তা সরানো"। স্থানীয় সামরিক কম্যান্ডারদের মধ্যে কিছুদিন আলোচনা চলার পর ভারতীয় সেনা সিদ্ধান্ত নেয় যে এই সমস্যার নিষ্পত্তি হতে হবে কূটনৈতিক স্তরেই।

publive-image মূলত স্থলের ওপর দিয়েই আঁকা হয়েছে নিয়ন্ত্রণরেখা, তবে প্যাঙ্গং সো-এর ক্ষেত্রে জলের মধ্যে দিয়েই যেতে হয় সেটিকে

লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুডা আরও বলেন, "স্থানীয় মিলিটারি কম্যান্ডাররা টহলদার বাহিনীর যাতায়াত বা ব্যানার ড্রিল-এর মতো ছোটখাটো সমস্যার সমাধান করতে পারেন। বড় রকমের ইস্যু হলে কূটনৈতিক স্তরেই সমাধান হতে পারে। আমরা এটা দেখেছি ২০১৩ সালে দেমচোকে, বা ২০১৭-য় দোকলামে।"

বেইজিংয়ে কূটনৈতিক আলোচনার নেতৃত্ব দেন ভারতের রাষ্ট্রদূত অশোক কানথা, এবং ভারতীয় পক্ষ জোর দেয় এলাকায় পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনার ওপর। অন্যদিকে 30R এলাকায় রাস্তা তৈরির কাজ বন্ধ করতে রাজি হয় চিন, এবং স্থানীয় সামরিক কম্যান্ডাররা বিতর্কিত এলাকায় কয়েক সপ্তাহ উভয়পক্ষেরই টহলদারি বন্ধ করতে রাজি হন।

পরবর্তী দু'সপ্তাহে উভয়পক্ষই ক্রমশ সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। চুমারে ভারতীয় সেনার শেল্টার বহাল তবিয়তেই থাকে, তবে চুমারে দুই পক্ষের টহলদারির ওপর 'বেসরকারি' স্থগিতাদেশ জারি থাকে প্রায় বছর দুয়েক।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment