Advertisment

ভারত-নেপাল বন্ধুত্ব চিড় খেল কেন?

২০ শতকের গোড়ার দিকে ভারতের মাটিতে তৈরি হয় নেপালি কংগ্রেস এবং এর শুরুর দিকের অনেক নেতাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Indo Nepal Relation

নরেন্দ্র মোদী ও কে পি ওলি, ২০১৬ সালে

গত সপ্তাহে নেপালের সংসদ সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করেছে, যাতে দেশের নতুন মানচিত্র গৃহীত হয়েছে এই মানচিত্রে ভারতের তিনটি অঞ্চল, লিম্পিয়াধুরা, লিপুলেক ও কালাপানিকে নেপালের অন্তর্ভুক্ত বলে দেখানো হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে নেপালের প্রধান মন্ত্রী কে পি ওলি এক ভাষণে বলেছিলেন এই এলাকাগুলি নেপালের মানচিত্রে ও অধিকারে নিয়ে আসা হবে। যে নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিভিন্ন কেতাবি ভাষায়, সময়ের দ্বারা পরীক্ষিত, অনন্য, সাধারণ উত্তরাধিকার, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ইতিহাস ও ভূগোলের মাধ্যমে প্রোথিত বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, তা এখন চাপের মুখে।

Advertisment

ভারতকে সুবিধা

আগের বারের সংকট কার্যকরী ভাবে মিটেছিল সরাসরি আলাপ-আলোচনা, পিছনের দরজার দৌত্য এবং দু পক্ষের ইতিবাচক মনোভাবের জন্য। ১৯৬০-এ রাজা মহেন্দ্র বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ভারতকে আশ্বাস দিয়েছিলেন নেপাল ও তিব্বতের মধ্যে যে সড়ক তৈরি হচ্ছে তা কেবলমাত্র উন্নয়নমূলক কাজের জন্য, এর মধ্যে কৌশলগত ব্যাপার আদৌ নেই।

৮-এর দশকে রাজা বীরেন্দ্র ভারতের সীমান্তের নিকটে ২১০ কিলোমিটার কোহলপুর বনবাসা রোড তৈরির জন্য চিনের সঙ্গে করা আন্তর্জাতিক টেন্ডার বাতিল করে দেন রাজীব গান্ধীর উদ্বেগ প্রকাশের ভিত্তিতে। সে কাজ বীরেন্দ্র ভারতের হাতে তুলে দেন।

১৯৬২ সালের নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ববন্ধু থাপার বক্তব্য অনুসারে রাজা মহেন্দ্র কালাপানি এলাকা সীমিত সময়ের জন্য ভারতের হাতে তুলে দেন, তার কারণ ছিল চিনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর জওহরলাল নেহরুর অনুরোধ। তবে ভারতের দিক থেকে সরকারি হিসেবে এটি রেখা নয়। গত ১৩ জুন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে বিদেশ সচিব শ্যাম সারণ লিখেছেন মহেন্দ্র ও বীরেন্দ্র এই দুই রাজাই ভারত বিরোধী জাতীয়তাকে কাজে লাগিয়েছেন।

নেপালের সর্বেক্ষণ দফতরের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল পুণ্যপ্রসাদ ওলির বক্তব্য অনুসারে ১৯৭০ সালে রাজা বীরেন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন কালাপানি সমস্যাকে ইস্যু না করতে।

এ সব কিছুকেই দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার পদ্ধতি বলে মনে করা হয় তবে ভারত ও চিনের মধ্যে সংঘর্ষ পরিস্থিতিতে তারা দক্ষিণেই থেকেছে।

 টার্নিং পয়েন্ট

২০০৫ সালে নেপালের মাওবাদী সহ ৮টি রাজনৈতিক দল দিল্লিতে একটি বারো দফার সমঝোতায় স্বাক্ষর করে, যা রাজতন্ত্রের উৎখাতের জন্য তৈরি।

নেপালের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত দীর্ঘকাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে এবং তারাই একমাত্র বহির্শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল থেকেছে। কিন্তু নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র থেকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করার জন্য ভারত অগ্রণী ভূমিকা নেবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের সঙ্গে নেপালের দীর্ঘকালীন সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার প্রেক্ষিত তৈরি হয়।

রাজতন্ত্রের মুলতুবি এবং ২০০৮ সালে তার অবসানের পর নেপাল নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে, নেপালের যাত্রা শুরু হয় ফেডারেলিজমের দিকে। এসব কোনও কিছু নিয়েই নেপালের সংসদে দীর্ঘ আলোচনা হয়নি।

ইউরোপিয় ইউনিয়ন স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যতক্ষণ না ধর্মান্তরের অধিকার সংবিধানে না দেওয়া হচ্ছে, এই ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থহীন।

নেপালে ভারত, আমেরিকা ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের যৌথ হাজিরা এবং নেপালের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের প্রভাব দেখে উদ্বিগ্ন চিন নেপালে তাদের উপস্থিতি ও লগ্নি বাড়াতে শুরু করে, তাদের লক্ষ্য ছিল পর্যটন, ভূমিকম্প পরবর্তী পুনর্নির্মাণ, বাণিজ্য ও শক্তিতে, তাদের বার্তা ছিল নেপাল নিয়ে তাদের আগ্রহ ভারত ও তাদের মিত্রদের চেয়ে কিছু কম নয়।

যদিও ভারত সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলি ২০০৫-০৬ সালে আন্দোলন শুরু করে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় আসে, কিন্তু তারা দৃশ্যতই নয়া দিল্লি থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। মাওবাদীরা, য়ারা বর্তমানে ওলি ও প্রচন্ড নেতৃত্বাধীন এনসিপি-র অংশ, তারাও এখন আর ভারতের প্রভাবে রইল না।

সম্পর্কের এখন তখন

ভারত যখন হিসেব কষে দেখেছিল রাজতন্ত্রের অবসানের পর নেপালে তাদের প্রভাব বাড়বে, থখন চিনের প্রভাব এই মাত্রায় কীভাবে বাড়ল এবং নেপালে ২০০৫-এর আগে নেপালি কংগ্রেস বা তারও আগে রাজতন্ত্রের সঙ্গে ভারতের যেরকম সুসম্পর্ক ছিল, তেমন সম্পর্ক কি ভারতের কারও সঙ্গে বর্তমানে রয়েছে? এই দুটি প্রশ্নের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

২০ শতকের গোড়ার দিকে ভারতের মাটিতে তৈরি হয় নেপালি কংগ্রেস এবং এর শুরুর দিকের অনেক নেতাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ভারত তাঁদের দেশে গণতন্ত্র স্থাপনের সহায়ক হবে। সাংবিধানিক ক্ষমতা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা নেওয়া সত্ত্বেও সে দেশের কমিউনিস্টরা নেপালি কংগ্রেসকে ভারতপন্থী বলে আখ্যা দিয়ে এসেছিল।

তবে ১২ দফা সমঝোতার পর নেপালি কংগ্রেসকে সে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে মাওবাদীদের অগ্রণী ভূমিকা মেনে নিতে হয়।

ভারতের পুরনো বন্ধুরা, বর্তমানে

মাওবাদীদের সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য কপাল চাপড়াচ্ছে ভারতের পুরনো বন্ধুরা।

নেপালি কংগ্রেসের এক বরিষ্ঠ নেতার কথায়, ২০০৬ সালে মাওবাদীরা যে মানুষের উঠে আসা শক্তি ফলে তাদের নেপালি রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রে আনতে হবে, ভারতের এই বিবেচনার মত ভুল আরকিছু হয় না। ১২ দফা সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরকারী আট নেতার অন্যতম গোপাল মান শ্রেষ্ঠর বক্তব্য অনুসারে, আমার মনে হয় ১২ দফা সমঝোতা ফের খতিয়ে দেখার সময় এসেছে এবং নেপালি রাজনীতিতে মাওবাদীদের পিছনে হাঁটার বদলে আমাদের মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে।

রাজপরিবার ছাড়া নেপালে ভারতের মিত্রশক্তি বলতে নেপালি কংগ্রেস ও সাম্প্রতিক অতীতে কিছুটা মদহেস পার্টি এবং নেপাল সেনা। দুই দেশের জাতীয় সেনাপ্রধান ১০৫০ থেকে অন্য দেশের কাছে অনারারি জেনারেলের মর্যাদা পেয়ে আসছেন। একটি অবরোধ চলাকালীন এলি ২০০৬ সালের এপ্রিলে ভারতের আমন্ত্রণ অস্বীকার ককরলে দু দেশের সেনাবাহিনী, বিশেষ করে প্রধানপর্যায়ে আলোচনা সে অবরোধ প্রত্যাহারের রাস্তা করে দেয়।

ওই অবরোধের জেরেই ওলি হয়ে ওঠেন জাতীয়তাবাদী এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে সীমান্ত বিবাদের জেরে ভাবাবেগ যখন ফের চাগাড় দিয়ে উঠেছে, সে সময়ে জাতীয়তার ধারণাকে ফের একবার আত্মসাৎ করেছেন এক কমিউনিস্ট নেতা, যিনি পুরো সময় জুড়ে রাষ্ট্রশক্তি নিজের কুক্ষিগত করায় মনোযোগ দিয়েছেন। নেপাল-ভারত সম্পর্ক এখন ওলির নিয়ন্ত্রণে।

Nepal
Advertisment