Advertisment

ভারত-পাক উত্তেজনা প্রশমনে আন্তর্জাতিক কূটনীতি

৯-১১ হামলার পর রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সহযোগিতায় সারা বিশ্ব সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
india pak deescalation

কার্গিল যুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাজপেয়ী

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে কোনও অন্তরালবর্তী কূটনীতি ছিল কি?

Advertisment

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ধরনের দাবি করেছেন। বৃহস্পতিবার তিনি ঘোষণা করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে চেষ্টা করছে। ভিয়েতনামে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জংয়ের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় সম্মেলনের পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ”আমরা ওদের (ভারত ও পাকিস্তান) থামাতে চেষ্টা করছি এবং আমাদের কাছে বেশ কিছু সুসংবাদ এসেছে।” তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কী চেষ্টা করছে, সে ব্যাপারে বিশদে কিছু বলতে চাননি তিনি। ভারতীয় আধিকারিকরা ট্রাম্প প্রশানের এ ধরনের কোনও অন্তরালবর্তী ভূমিকার কথা অবশ্য অস্বীকার করেছেন।

ট্রাম্প যেদিন এ কথা বলেন, সেদিনই পাকিস্তান, পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ধৃত অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তির সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে, এবং এ ঘটনা উত্তেজনা প্রশমনের পথ খুলে দেয়। পর্দার পিছনের কূটনীতি আগামী কয়েকদিনের আগে পরিষ্কার হওয়ার নয়। তবে এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সংকট কমাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াস দীরঘদিনের, বিশেষ করে ১৯৯৮ সাল পরবর্তীতে, যে বছর থেকে দু দেশই পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠে।

পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ভাবে সব সমস্যার সমাধান সংক্রান্ত ভারতের যে অবস্থান, এবার তার কী হবে?

ভারত সর্বদাই বলে এসেছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে কোনও তৃতীয় পক্ষের কথা বলার অবকাশ নেই। কাশ্মীর সমস্যা আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রচেষ্টা সর্বদাই প্রতিরোধ করে এসেছে ভারত। এবং এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা যে মেনে নেওয়া হবে না, সে কথা প্রায় সারা দুনিয়ার কাছেই স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

৯-১১ হামলার পর রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সহযোগিতায় সারা বিশ্ব সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময় থেকেই ভারত চেয়েছে যে পাকিস্তানের মাটিতে বেড়ে ওঠা জঙ্গি গোষ্ঠী গুলিকে শেষ করা, পাকিস্তানের সেনা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভারত বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠী গুলিকে নিজেদের দেশের মাটিতে ছত্রছায়া দেওয়া থেকে নিরস্ত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল সক্রিয় হোক, এবং তেমন কোনও ঘটনা ঘটলে পাকিস্তানকে তিরস্কার করা হোক। এ ব্যাপারে নিজেদের অর্থনৈতিক অগ্রসরতা এবং কৌশলগত আধিপত্য়ের উপর নির্ভর করেছে ভারত।

আরও পড়ুন, ভারতের আমন্ত্রণ বাতিল না হওয়ায় ওআইসি সম্মেলন বয়কটের পথে পাকিস্তান

ভারত পাকিস্তানের পারমাণবিকীকরণ, এবং আফপাক সন্ত্রাস বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার একটি কারণ এই এলাকা নিয়ে তাদের নিজেদের আগ্রহ রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সুগভীর সম্পর্ক, উল্টোদিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং সৌদি আরবের মত ওআইসি-র মূল শক্তিধর দেশগুলির উপর দিল্লির প্রভাব, এসব ভারত পাকিস্তান সংকটকে নতুন মাত্রা জুগিয়েছে এবং সংকট মোচনে নতুন নতুন কূটনৈতিক প্রচেষ্টারও জন্ম দিয়েছে।

এর আগে ভারত-পাক সংকটের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে হস্তক্ষেপ করেছে?

১৯৯৯ সালে কার্গিল সংকট শেষ হয়েছিল ভারতের হস্তক্ষেপের পর। বাজপেয়ী সরকার ক্লিন্টন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিল। তারা মার্কিন প্রশাসনকে দিয়ে কার্গিল থেকে পাক বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলায়। ৩ জুলাই নওয়াজ শরিফ ওয়াশিংটনে এসে মুখরক্ষা করে ভারতের সঙ্গে কীভাবে যুদ্ধবিরতিতে আসা যায়, সে নিয়ে বিল ক্লিন্টনের সহায়তা চান।  নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল নিজের লেখায় এ কথা জানিয়েছেন।

অনেকে আবার লিখেছেন, যে পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মুশারফ মার্কিন সহায়তা চাওয়ার ব্যাপারে নওয়াজ শরিফকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত শরিফের পক্ষে কার্গিল থেকে বিনা শর্তে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।

২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর সামরিক প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত থেকে নিরস্ত করে। ২০০১ সালে জৈশ এ মহম্মদের সংসদ হামলার পর ভারত সীমান্তে ৫ লক্ষ সেনা মজুত করেছিল এবং মিসাইল ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সাজিয়ে ফেলেছিল। পাকিস্তানও সেনা মজুত করেছিল।

এর ফলে পাকিস্তানের নজর আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে পারে এবং দু দেশ পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করতে পারে, এমন আশঙ্কা করেছিল বুশ প্রশাসন। এর ফলে তালিবান এবং আল কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও ভেবেছিল তারা। ফলে বুশ প্রশাসন এ ব্যাপারে উঠে পড়ে লাগে। বাজপেয়ী সরকারের সঙ্গে তড়িঘড়ি কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা শুরু করেন সচিব কলিন পাওয়েল, ভারতের মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ব্ল্যাকউইল, এবং সহসচিব রিচার্ড আর্মিটেজ।

আরও পড়ুন, ‘মারাত্মক অসুস্থ’ মাসুদ আজহার, দাবি পাক বিদেশমন্ত্রীর

মার্কিন চাপের মুখে পড়ে তৎকালীন পাক রাষ্ট্রপ্রধান মুশারফ ১২ জানুয়ারি, ২০০২ -এ ভারতের সংসদ হামলাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ আখ্যা দেন এবং তার সঙ্গে ৯-১১ হামলার তুলনা করেন। একই সঙ্গে লশকর এ তৈবা ও জৈশ কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। পাঁচ মাস পর জম্মুর কালুচক সেনা সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হামলায় ৩৫ জনের মৃত্যুর পর ফের হামলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল ভারত। সেবারও মার্কিন উদ্যোগে নিরস্ত হন বাজপেয়ী। আর্মিটেজ তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে মুশারফ জিহাদি গোষ্ঠীগুলি নিয়ে নিজের অবস্থানের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

২৬-১১ মুম্বই হামলার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল?

সে সময়েও দু দেশেই বেশ কিছু ফোন গিয়েছিল আমেরিকা থেকে। মনমোহন সিং সরকারকে ধৈর্য্য ধরতে বলা হয়েছিল। সেসময়ে ভারতের বিদেশমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে একটি ভুয়ো ফোন করা হয়েছিল পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিকে। ফোনে পাকিস্তানকে আক্রমণের হুমকি দেওয়া হয়। এর পর মার্কিন সচিব কন্ডোলিজা রাইস ভারত ও পাকিস্তান দু দেশ সফর করে উত্তেজনা প্রশমন করেন। পরে জানা যায়, করাচির এক জেল থেকে ওই ভুয়ো ফোনটি করেছিল মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার মূল চক্রী ওমর শেখ।

ট্রাম্পের কথা মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বর্তমান সমস্যার সমাধানে কোনও ভূমিকা পালন করেই থাকে, তাহলে এখন তারা হাত গোটাবে কী ভাবে!

এখন আমেরিকা চেষ্টা করছে তালিবানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসতে। পাকিস্তান এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সাম্প্রতিক কালে কিছু ভাঙাগড়া হলেও তালিবানরা শেষ পর্যন্ত আইএসআইয়ের-ই মুখোশ। ফলে ট্রাম্প প্রশাসন ভারত-পাক সংঘর্ষ কখনওই চাইবে না। বর্তমান সংকট বৃদ্ধি এমন একটা সময়ে ঘটেছে যখন ট্রাম্প প্রশাসনে বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ দক্ষিণ এশিয় রয়েছেন।

পুলওয়ামার ঘটনার পর দু পক্ষের উত্তেজনা কমানোর ব্যাপারে ওয়াশিংটনের তেমন কোনও আগ্রহ দেখা যায়নি। কিন্তু এ ব্যাপারে খোঁজ রাখছিলেন দক্ষিণ এশিয়রা। মঙ্গলবার পাকিস্তানে জঙ্গি ঘাঁটির উপর ভারতের হামলার পর চমক ভাঙে। এর পর আমেরিকা কীভাবে সংকট নিরসনে উদ্যোগী হয়, তা ক্রমশ জানা যাবে।

তবে এ ব্যাপারে আরও সক্রিয়তা ছিল। চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর তৈরি হওয়ার পর এ অঞ্চলের শান্তি চিনের কাছেও বড় বাজি। ভারত ও পাকিস্তান উভয় পক্ষই আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে নিজেদের বক্তব্য গত দু দিন ধরে তুলে ধরেছে। তার মধ্যে চিন যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ওআইসি-ও। পরিস্থিতি সামাল দিতে এই দু পক্ষই অন্তরালে সক্রিয় হয়েছে, এ সম্ভাবনাও যথেষ্ট।

Read the Full Story in English

Explained
Advertisment