Advertisment

বিশ্লেষণ: কীভাবে পাকিস্তানের হাত এড়িয়ে ভারতের কাছে এল সাড়ে তিন কোটি পাউন্ড

২০০৮ সালের ১১ এপ্রিল প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো এক বিবৃতিতে জানায় ভারত সরকার পাকিস্তান ও নিজামের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আদালতের বাইরে সমঝোতা করার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Nizam of Hyderabad

সপ্তম নিজাম

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এক আইনি জটিলতার সমাধান হল। লন্ডনের ন্যাটওয়েস্ট ব্যাঙ্কে জমা থাকা ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড নিয়ে যে সমস্যা চলছিল, বুধবার তার রায় দিয়েছে ব্রিটিশ হাইকোর্ট। আদালতের রায় গিয়েছে ভারত এবং হায়দরাবাদের সপ্তম নিজামের উত্তরাধিকারীদের পক্ষে। বুধবার আদালত জানিয়ে দিয়েছে এই অর্থ কোনওভাবেই পাকিস্তানের নয়।

Advertisment

কীভাবে ব্যাঙ্কে পৌঁছেছিল অর্থ

এ কাহিনি মোটামুটি সকলেরই জানা। অর্থমন্ত্রী নিজাম ওসমান আলি খানের নির্দেশে ১,০০৭,৪৯০ পাউন্ড ৯ শিলিং ১৯৪৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের হাই কমিশনার হাবিব ইব্রাহিম রহিমতুলার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়। ঠিক তার আগের দিনই নিজামের বাহিনী ভারতীয় সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করে। দীর্ঘদিন পরে এই রাজন্যশাসিত রাজ্য ভারতের আওতায় আসে সেইদিনে। ১৯৫৪ সালে ভারত এই অর্থ ফেরতের দাবিতে মামলা করে। নিজামও ওই অর্থ ফেরত চেয়েছিলেন। কিন্তু সে মামলা যায় হাউস অফ লর্ডসের কাছে। হাউস ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দেয় এবং পাকিস্তানকে সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ দান করে, যার অর্থ তাদের বিরুদ্ধে কোনও রকম আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। ব্যাঙ্ক জানিয়ে দেয়, তারা ভারত সরকার, পাকিস্তান সরকার এবং নিজাম- এই তিন পক্ষের সহমত না হওয়া পর্যন্ত এই অর্থ তাদের কাছে গচ্ছিত রাখবে।

এই অবস্থা চলে ৬০ বছরেরও বেশি। ২০১৩ সালে পাকিস্তান ফের আদালতে যাওয়ার মনস্থ করে, যার জেরেই এই সাম্প্রতিক রায়। এই সময়ে অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫ গুণ, কিন্তু সে অর্থ কোনও দেশের সরকারের কাছেই বৃহৎ পরিমাণ নয়।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: তফশিলি জাতি উপজাতি আইন, সুপ্রিম কোর্টের পর্যালোচনা

সমঝোতার প্রচেষ্টা

এত বছরে বেশ কয়েকবার আদালতের বাইরে বোঝাপড়ার চেষ্টা হলেও পাকিস্তান তাতে রাজি হয়নি। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানে ১০ বছরের সামরিক শাসন শেষ হবার পর ভারত সরকার ঘোষণা করে এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করা হবে।

২০০৮ সালের ১১ এপ্রিল প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো এক বিবৃতিতে জানায় ভারত সরকার পাকিস্তান ও নিজামের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আদালতের বাইরে সমঝোতা করার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। সেখানে ওই অর্থ তিনভাগে ভাগ করার কথাও বলা হয়েছিল। এ জন্য ১৮ মাস সময় দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু সে বছরের জুলাই মাসে কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসে বোমা হামলার পর ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সংকট তৈরি হয়। সে বছর মুম্বইয়ে ২৬-১১ হামলার পর এ পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটে। তার পর থেকে ভারত-পাক সম্পর্কের অবনতিই হয়েছে।

মামলার পুনর্জাগরণ এবং অবসান

এই পরিস্থিততেই ২০১৩ সালে নির্বাচনের ঠিক আগে ব্রিটেনের পিপিপিপন্থী পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত, তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি ঘনিষ্ঠ ওয়াজিদ সামসুল হাসান পাকিস্তানকে দেওয়া সুরক্ষাকবচ সরিয়ে ফের ওই অর্থের দাবি করেন।

২০১৬ সালের জুন মাসে পাকিস্তান টু ডে-কে হাসান বলেন, "২০১৩ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমি ১৯৪৮ সাল থেকে পাকিস্তান হাই কমিশনারের অ্যাকাউন্টে পড়ে থাকা অর্থ ফেরতের জন্য আবেদন জানিয়ে মামলা করি। মামলা করার আগে পাকিস্তান হাই কমিশনার হিসেবে আমার সঙ্গে অর্থমন্ত্রকের প্রচুর চিঠি চালাচালি হয়। অর্থমন্ত্রকে লাল ফিতের বাঁধন দেরির জন্য দায়ী।"

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: ত্রিপুরায় মন্দিরে বলি নিষিদ্ধ, কী যুক্তি আদালতের

কয়েক মাস পর পাকিস্তান মামলা তুলে নিতে চাইলেও আদালত তাতে কর্ণপাত করেনি। হাসান বলেছিলেন "নওয়াজ শরিফ নেতৃত্বাধীন পিএমল(এন) সরকার মামলা প্রত্যাহার করার ব্যাপারে তাঁর উপর চাপ দিয়েছিল।"

২০১৬ সালে আদালত ভারতের বিরুদ্ধে রায় দেবার পর পাকিস্তানের আশা বাড়তে থাকে। এর পর পাকিস্তানের তরফে আদালতে বলা হয় তাদের কাছে এমন নথি রয়েছে যা থেকে প্রমাণ করা যাবে যে নিজাম ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্নাকে অর্থ সংগ্রহ করে দিতে বলেছিলেন এবং ফ্রেডরিক সিডনি কটন নামে একজন ব্রিটিশ পাইলট করাচি থেকে হায়দরাবাদ পর্যন্ত ৩৫বার যাতায়াত করে সে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তানের দাবি এই অর্থ সেই অস্ত্রশস্ত্রেরই দাম।

২০১৮ সালে ভারত সরকার এবং নিজামের পৌত্ররা সমঝোতায় পৌঁছন যে এ মামলা তাঁরা একত্রে লড়বেন। বুধবারে রায়ে বলে দেওয়া হয়েছে নিজাম এবং ভারত সরকার একযোগে এই অর্থ পাবে। এর ফলে ৭০ বছর ধরে চলা এক ভারত-পাক কাহিনির পরিসমাপ্তি হল।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: পাকিস্তানি মডেল কান্দিল বালোচের হত্যা ও সাজা

এতদিন কেন লাগল

দুবার ইসলামাবাদ দূতাবাসে পোস্টেড ছিলেন টিসিএ রাঘবন। প্রথমবার ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে, পরের বার হাইকমিশনার হিসেবে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত 'পিপল নেক্সট ডোর' বইতে তিনি লিখছেন, দুদেশের তরফ থেকেই বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও এ সমস্যা মেটেনি তার কারণ দু পক্ষের অনেকেই এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত বলে ভাবতেন।

"পাকিস্তানের কাছে বিষয়টি ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে অধিকতর সুসম্পর্ক থাকা, মুসলিম ধর্মাবলম্বী রাজপুত্র শাসিত হায়দরাবাদে সামরিক বাহিনী কর্তৃক ভারতের অধিকার গ্রহণ। এই অর্থ তাদের কাছে থাকার অর্থ সেই সম্পর্কের একটি প্রতীক। অন্যদিকে ভারতের কাছে এটা ছিল নীতির বিষয়... পুরনো হায়দরাবাদ রাজ্যের অর্থে পাকিস্তানের দাবি থাকবেই বা কেন?"

Read the Full Story in English

Advertisment