বৃহস্পতিবার (২ জুলাই), দিল্লির ইন্সটিটিউট অফ লিভার অ্যান্ড বিলিয়ারি সায়েন্সেস (ILBS) নামক প্রতিষ্ঠানে ভারতের প্রথম প্লাজমা ব্যাঙ্কের উদ্বোধন করলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এই ব্যাঙ্কের উদ্দেশ্য হলো Covid-19 রোগীদের চিকিৎসায় যে প্লাজমার পরীক্ষামূলক ব্যবহার হচ্ছে, সেই প্লাজমা যেন আরও সহজলভ্য হয়, তা নিশ্চিত করা। যে সমস্ত রোগী করোনা-মুক্ত এবং প্লাজমা দানের পক্ষে উপযুক্ত, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এই ব্যাঙ্ক।
প্লাজমা ব্যাঙ্ক কী? কেন প্রতিষ্ঠা করা হয়?
ব্লাড ব্যাঙ্কের নিয়মেই পরিচালিত হয় প্লাজমা ব্যাঙ্কও, তফাৎ শুধু এই যে প্লাজমা ব্যাঙ্ক গঠিত হয়েছে শুধুমাত্র সেইসব Covid-19 রোগীদের জন্য, যাঁদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তাররা। আপাতত এই ব্যাঙ্ক গঠিত হয়েছে ILBS-এ, যা প্লাজমা সংগ্রহ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।
দিল্লিতে বর্তমানে করোনা রোগীদের ওপর পরীক্ষামূলক ভাবে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করার অনুমোদন পেয়েছে সাতটি হাসপাতাল - অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (AIIMS), মৌলানা আজাদ মেডিক্যাল কলেজ (MAMC), ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হসপিটাল, বাটরা হসপিটাল, লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ, রাম মনোহর লোহিয়া হসপিটাল, এবং ম্যাক্স হসপিটাল সাকেত।
আরও পড়ুন: সত্যিই ১৫ অগাস্ট বাজারে আসবে কোভ্যাকসিন? কেন সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা?
ILBS-এর প্রধান ডাঃ এসকে সারিন বলেন, "রোগীদের মধ্যে বাড়তে থাকা প্লাজমার চাহিদার চাপেই প্লাজমা দাতাদের সুবিধার জন্য একটি নির্দিষ্ট প্লাজমা গ্রহণ কেন্দ্র খুলতে বাধ্য হয় সরকার। প্লাজমা সহজে পাওয়া যাচ্ছিল না, এবং রোগীর চিকিৎসায় যাঁরা নিযুক্ত, তাঁদেরকে দোরে দোরে ঘুরতে হচ্ছিল সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর প্লাজমা পেতে। এদিকে কোভিড হাসপাতালে প্লাজমা দিতে আসতেও ভয় পাচ্ছেন অনেকে, সুতরাং আমরা ঠিক করি, নন-কোভিড কোনও কেন্দ্র খুলতে হবে।"
প্লাজমা থেরাপির মূলে রয়েছে একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে করোনা-মুক্ত রোগীর দেহ থেকে অ্যান্টিবডি-সমৃদ্ধ প্লাজমা নিয়ে করোনা রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়। এই অ্যান্টিবডি রোগীকে সুস্থ হতে সাহায্য করে কিনা, তা নিশ্চিত করতেই বর্তমানে চলছে পরীক্ষানিরীক্ষা।
প্লাজমা দান করতে পারেন কারা?
করোনা কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, এবং তারপর ১৪ দিন কেটে গেছে, এমন রোগীদের দেহ থেকে প্লাজমা নেওয়া যায়, যদিও ডাক্তাররা করোনা থেকে মুক্তি এবং প্লাজমা দানের মধ্যে ২১ দিনের ব্যবধান রাখতে চাইছেন। প্লাজমা দাতাদের বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, এবং দেহের ওজন হবে ন্যূনতম ৫০ কেজি।
সদ্য সন্তান প্রসব করেছেন যেসব মহিলা, তাঁরা প্লাজমা দিতে পারবেন না, যেহেতু গর্ভধারণের সময় শরীরে যেসব অ্যান্টিবডির সৃষ্টি হয় (ভ্রূণের রক্তের ক্রিয়ার ফলে) সেগুলি ফুসফুসের স্বাভাবিক চলনে বাধা দিতে পারে। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ), অথবা ক্যানসারের মতো পার্শ্বরোগ থাকলেও প্লাজমা দেওয়া যাবে না। প্লাজমা গ্রহণ কেন্দ্রে ইচ্ছুক দাতাদের স্বাস্থ্য বিশদে পরীক্ষা করে নেবেন চিকিৎসকরা।
এই বিশদ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণেই উপযুক্ত প্লাজমা দাতা পেতে অনেকসময় অসুবিধা হয়। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লিতে করোনা-মুক্ত রোগীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৬৩ হাজার, যা সপ্তাহ দুয়েক আগে ছিল আন্দাজ ২১ হাজার। তিন সপ্তাহ আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩ হাজার। সুতরাং সম্ভাব্য দাতাদের তালিকা এমনিতেই বড় একটা দীর্ঘ নয়, এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধির কারণে তালিকা থেকে প্রথমেই বাদ পড়ে যাচ্ছেন অনেকে।
প্লাজমা দানের আগে কী কী পরীক্ষা হয়?
শরীরের বিভিন্ন অবস্থা নির্ধারণ করতে ল্যাবরেটরি পরীক্ষা হয় - সেরাম প্রোটিন এবং সিবিসি, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস, এইচআইভি, ম্যালেরিয়া, এবং সিফিলিসের জন্য টিটিআই টেস্ট - যেমন হয় ব্লাড গ্রুপ নিশ্চিত করতে এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতি নির্ধারণ করতেও। সেরাম কোভিড-১৯ বৈশিষ্ট্যসূচক আইজিজি অ্যান্টিবডির ঘনত্ব ৮০ বা তার বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
রোগীর পরিবার কি সরাসরি ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন?
না। প্রতিটি হাসপাতাল প্লাজমা থেরাপি হবে, এমন রোগীর বিশদ বিবরণ সমেত প্লাজমা ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
একজনের প্লাজমা থেকে কতজন উপকৃত হতে পারেন?
প্রত্যেক দাতার প্লাজমা দিয়ে দুজনের চিকিৎসা হবে। দেহের ওজনের ভিত্তিতে আন্দাজ ৫০০ মিলিলিটার প্লাজমা একজন দাতার কাছ থেকে সংগ্রহ করে ব্যাঙ্ক।
প্লাজমা ও রক্ত দানের মধ্যে তফাৎ কী?
প্লাজমা দানের ক্ষেত্রে রক্ত থেকে শুধুমাত্র প্লাজমা বের করে নিয়ে রক্তের অন্যান্য উপাদান দাতার শরীরে ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়।
ILBS-এর প্রধান ডাঃ সারিন জানাচ্ছেন, "রক্তের মধ্যে অনেকগুলি উপাদান থাকে, যেমন লোহিত কণিকা (রেড ব্লাড সেল), প্লেটলেট, শ্বেত কণিকা (হোয়াইট ব্লাড সেল), এবং প্লাজমা। রক্তদানের সময় সাধারণভাবে এক পাইন্ট (আন্দাজ আধ লিটার) রক্ত নেওয়া হয় দাতার শরীর থেকে। এই প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় হলে তাকে বলা হয় অ্যাফেরেসিস (apheresis), যার দরুন একটি অ্যাফেরেসিস মেশিনের সঙ্গে আপনাকে যুক্ত করে দেওয়া হবে, একটি অ্যাফেরেসিস কিট-এর মাধ্যমে, যা একবারই ব্যবহার্য। এই মেশিন স্রেফ প্লাজমাটা আলাদা করে নিয়ে সমস্ত লোহিত কণিকা এবং অন্যান্য উপাদান আপনার শরীরে ফেরত দিয়ে দেবে। প্লাজমা দানের ফলে যে যে প্লাজমা প্রোটিন আপনি হারাচ্ছেন, তার সবটাই ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শরীর ফের তৈরি করে ফেলে।"
একজন করোনা-মুক্ত রোগী কতবার প্লাজমা দান করতে পারেন?
প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর ৫০০ মিলি করে প্লাজমা দান করা যায়, যেখানে একবার রক্ত দান করলে ফের তিনমাসের আগে আর রক্ত দেওয়া যায় না। ডাঃ সারিন জানাচ্ছেন, "প্লাজমা দান অনেক বেশি নিরাপদ, শরীরের ওপর দিয়ে নামমাত্র ধকল যায়। প্লাজমা এক বছর পর্যন্ত জমা করে রাখা যায়, যেহেতু জমে থাকা প্লাজমার মধ্যেও রয়ে যায় অ্যান্টিবডি। মানুষের দেহে অ্যান্টিবডির মাত্রা কখনও কমে যায় না।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন