৩১ অগাস্ট আসামের এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হতে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের অন্যতম আলোচ্য বস্তু হয়ে উঠেছে নাগরিকত্ব। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছিল, যাঁরা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ভারতে জন্মেছেন কিন্তু যাঁদের পূর্বপুরুষের কোনও সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হোক। শীর্ষ আদালত এ আবেদন খারিজ করে দিয়িছে। ভারতের অন্য যে কোনও রাজ্যে ভারতে জন্মালে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য হওয়া যায়। আসামের ক্ষেত্রে আইন ভিন্ন।
নাগরিকত্ব কীভাবে স্থির হয়?
একজন ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণ করে নাগরিকত্ব। রাষ্ট্র ও আইন দিয়েই এর সূচনা এবং পরিসমাপ্তিও। এর গোটাটাই রাষ্ট্রকে ঘিরে, মানুষকে কেন্দ্র করে নয়। নাগরিকত্বের ধারণা আদতে বর্জনের, এক্ষেত্রে অনাগরিকদের বর্জন করা হয়।
নাগরিকত্ব স্বীকৃতির জন্য দুটি পরিচিত নীতি রয়েছে। একটি পদ্ধতিতে নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় জন্মস্থানের হিসেবে, অন্যটিতে রক্তসম্পর্কের চিহ্ন মোতাবেক। ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহরু কমিটির সময় থেকে ভারতীয় নেতৃত্ব জন্মস্থানের স্বীকৃতির আধুনিকমনস্ক ধারার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। অন্য ধারাটি খারিজ হয়ে গিয়েছে তা ভারতীয় ভাবধারার বিরোধী বলে।
আরও পড়ুন, ফাঁস হওয়া এনআরসি পরিসংখ্যানের তাৎপর্য কী?
নাগরিকত্ব সংবিধানের আওতাভুক্ত এবং কেবলমাত্র সংসদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। সংবিধানে নাগরিকত্ব-র কোনও কোনও সংজ্ঞা নেই, কিন্তু ৫ থেকে ১১ নং অনুচ্ছেদে কারা নাগরিকত্বের আওতায় পড়বেন তার বিভিন্ন ভাগ স্থির করা হয়েছে। সংবিধানের অন্য সংস্থানগুলি ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি কার্যকর হলেও এই ধারাগুলি লাগু হয়ে যায় সংবিধান গ্রহণের ক্ষণ থেকেই, অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে। তবে সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনও পরিস্থিতিই সংসদের নাগরিকত্ব দেওয়া বা তা বর্জন করার ক্ষমতা হ্রাস হবে না। অর্থাৎ সংবিধানে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত যেসব সংস্থান রয়েছে, প্রয়োজনে তার বিপরীতেও হাঁটতে পারে সংসদ।
১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার পর তা চারবার সংশোধিত হয়- ১৯৮৬, ২০০৩, ২০০৫ ও ২০১৫ সালে। যাদের ক্ষেত্রে সন্দেহ রয়েছে, তাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে দেওয়া হয়েছে এই আইনবলে। তবে, জন্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের যে ব্যাপ্ত নীতিমালা ছিল গত কয়েক দশকে তা অনেকটাই সংকীর্ণ করে আনা হয়েছে। এর উপর রয়েছে বিদেশি আইন, যার বলে কোনও ব্যক্তির উপর নিজেকে বিদেশি নয় প্রমাণ করার চাপ ব্যাপক পরিমাণে বেড়েছে।
তাহলে কে ভারতের নাগরিক, কে নয়?
৫ নং অনুচ্ছেদ:
ভারতে যাঁরা বাস ও ভারতে যাঁরা জন্মেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এমনকি, যাঁদের জন্ম ভারতে নয়, কিন্তু বসবাস ভারতে এবং যাঁদের বাবা-মায়ের মধ্যে যে কোনও একজন ভারতে জন্মেছেন, তাঁরাও নাগরিকত্ব পাবেন। যাঁরা এ দেশে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন, তাঁরাও নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
৬ নং অনুচ্ছেদ:
এ দেশের স্বাধীনতা যেহেতু এসেছিল দেশভাগ ও অভিবাসনের মধ্যে দিয়ে, সে জন্য ৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যাঁরা ১৯৪৯ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগে ভারতে এসেছেন তাঁদের বাবা-মা বা ঠাকুর্দা-ঠাকুমার কেউ যদি এ দেশে জন্মে থাকেন, তবে তাঁরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। কিন্তু ওই তারিখের পর এ দেশে প্রবেশ করলে তাঁদের নিজেদের নথিভুক্ত করতে হবে।
আরও পড়ুন, এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর ভারত কি সত্যিই কাউকে ফেরত পাঠাতে পারে
অনুচ্ছেদ ৭:
এমনকি ১৯৪৭ সালের ১ মার্চের পর যাঁরা পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন কিন্তু তারপর আবার পুন্রবাসনের সার্টিফিকেট নিয়ে ফেরৎ এসেছেন, তাঁরাও নাগরিক বলে গণ্য হবেন। যাঁরা পাকিস্তান থেকে এদেশে এসে উদ্বাস্তু বলে পরিচিত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি আইন বেশি সহানুভূতিশীল। তুলনায় দোলাচলে পড়ে পাকিস্তানে গিয়ে আটকে পড়েছিলেন বা দ্রুত সেখান থেকে এ দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের প্রতি আইনের সহানুভূতি কম।
৮ নং অনুচ্ছেদ:
ভারতীয় বংশোদ্ভূত কোনও ব্যক্তি যিনি ভারতের বাইরে বসবাস করেন, যাঁর বাবা-মা বা অথবা ঠাকুর্দা-ঠাকুমার কেউ ভারতে জন্মেছেন, তিনি দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নিজেকে নথিভুক্ত করতে পারেন।
১৯৮৬ সালের সংশোধনী:
ভারতে জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্বের যে ব্যাপকতার ধারণা তা ১৯৮৬ সালের সংশোধনীতে অনেকটাই খর্বিত হয়। এই সংশোধনীতে শর্ত আরোপ করে বলা হয় যাঁরা ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি বা তার পর থেকে ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে জন্মেছেন, তাঁরা ভারতীয় নাগরিক বলে গণ্য হবেন। যাঁরা ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বরের আগে জন্মেছেন তাঁরা ভারতে জন্মালেও, জন্মকালীন সময়ে তাঁদের বাবা বা মা-কে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।
আরও পড়ুন, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল কী ভাবে কাজ করে
২০০৩ সালের সংশোধনী:
তৎকালীন এনডিএ সরকার বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের কথা মাথায় রেখে এই আইনকে আরও কঠোর করে। এখনকার আইনে যঁরা ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বা তার পর জন্মেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য হয় তাঁদের বাবা-মা উভয়কেই ভারতের নাগরিক হতে হবে বা যে কোনও একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে এবং অন্যজন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না। এই কঠোর সংশোধনীগুলি আনার ফলে ক্রমশ ভারত রক্তসম্পর্কের মাধ্যমে নাগরিকত্বের নীতিসমূহের দিকে এগিয়ে গেল। এর ফলে কোনও বেআইনি অনুপ্রবেশকারী সাত বছর ধরে ভারতে বসবাস করলেও স্বাভাবিকতার সূত্রে বা নথিভুক্তির মাধ্যমে নাগরিকত্ব দাবি করতে পারবেন না।
নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল:
এই সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয়েছে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্থান থেকে ভারতে প্রবেশকারী হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং ক্রিশ্চানদের ভারতে বসবাস করতে পারবেন। এঁরা মাত্র ৬ বছর ভারতে থাকলেই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। এ ধরনের অভিবাসীদের জন্য পাসপোর্ট আইন ও বিদেশি আইনেও ছাড় দেওয়া হয়েছে দুটি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে। আসামের বেশ কিছু সংগঠন এ বিলের বিরোধিতা করেছে কারণ এই বিলের ফলে বাংলাদেশি হিন্দু বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা নাগরিকত্ব পেয়ে যেতে পারেন।
আসামে কী আলাদা?
বেআইনি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে চলা আসাম আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল আসাম চুক্তির, যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন আন্দোলনের নেতারা এবং রাজীব গান্ধীর সরকার। সে অনুসারে ১৯৮৬ সালে নাগরিকত্ব আইনে বদল এনে আসামের নাগরিকদের জন্য একটি বিশেষ বিভাগ তৈরি করা হয়। নতুন ৬এ ধারায় বলা হয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত যে কেউ যিনি ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন তাঁরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচ্য হবেন। যাঁরা ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে ভারতে এসে সাধারণ বাসিন্দা হিসেবে রয়ে গিয়েছেন, তাঁরা বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ১০ বছর পর ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন। অন্তর্বর্তী সময়ে তাঁদের ভোটাধিকার থাকবে না, কিন্তু তাঁরা সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন।
বিদেশি চিহ্নিত করা হবে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী আইন, ১৯৮৩ বলে, যা কেবল আসামের জন্য প্রযোজ্য। সারা দেশের জন্য এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইন। প্রথম আইনের সংস্থান অনুসারে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো দুষ্কর। সর্বানন্দ সোনওয়াল (বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী)-এর আবেদনের ভিত্তিতে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট এ আইনকে অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দিয়ে একে খারিজ করে দেয়।
আরও পড়ুন, এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিল: রাষ্ট্রনীতি বনাম শরণার্থী
এ মামলায় আদালত বলে ১৪ নং অনুচ্ছেদে যে সমতার অধিকার দেওয়া রয়েছে, ভৌগোলিক শ্রেণিবিন্যাস তার পরপন্থী। এরকম আরও একটি ভিন্নতা রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে নির্ধারিত তারিখ ১৯৪৯ সালের ১৯ জুলাই হলেও, নেহরু-লিয়াকত চুক্তির কারণে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ঠেলে দেওয়া হয়েছে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত।
৬এ ধারার সাংবিধানিকতা
৬এ ধারা, যার ভিত্তিতে সাম্প্রতিক এনআরসি প্রস্তুত করা হচ্ছে তার সাংবিধানকতা খতিয়ে দেখবে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ। বিচারপতি মদন বি লোকুরের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল এ মামলার শুনানি হয়েছিল, কিন্তু সে বছরের অগাস্টে বিচারপতি পি সি পন্তের অবসরের ফলে ওই বেঞ্চ অবলুপ্ত হয়ে যায়।
(লেখক সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ)
Read the Full Story in English