Advertisment

সানাউল হক: উত্তর প্রদেশের ছেলের আল কায়েদার উপমহাদেশীয় প্রধান হয়ে ওঠার কাহিনি

দেওবন্দ সেমিনারি থেকে ১৯৯১ সালে গ্র্যাজুয়েট হয় সানাউল হক। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর জেহাদি কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে সে। ১৯৯৫ সালে সম্ভল ছেড়ে উধাও হয়ে সানাউল, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Al Qaeda, AQIS

ছবি- টুইটার

আফগানিস্তান কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়েদা নেতা (একিউআইএস) আসিম ওমর গত ২৩ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের মাসা কালা জেলার তালিবানি এলাকায় মার্কিন-আফগান যৌথ হানায় নিহত হয়েছে।

Advertisment

আফগান নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে ওমর ছিল একজন পাকিস্তানি এবং পাকিস্তানের বেশ কিছু জঙ্গিরও ওই হানায় প্রাণ গিয়েছে।

আদতে ওমর ছিল একজন ভারতীয়, যার নিবাস ছিল দিল্লির ১৫০ কিলোমিটার পূর্বে, উত্তর প্রদেশের সম্ভলে।

সম্ভলের ছেলে সানাউল

বছর পাঁচেক আগে আল কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি আসিম ওমরকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব দিয়েছিল। ছেলেবেলায় আসিম ওমরের নাম ছিল সামসুল হক। গত শতকের ৬এর দশকের শেষে বা ৭-এর দশকের শুরুতে তার জন্ম। তার বাবার নাম ইরফান উল হক, মায়ের নাম রুকাইয়া। তাঁরা সম্ভলের মহল্লা দীপা সরাই গ্রামের বাসিন্দা।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধির সঙ্গে ২০১৫ সালে এই দম্পতির সাক্ষাৎ হয়েছিল। তখন ইরফানের বয়স ছিল ৮০, রুকাইয়ার ৭২। তার প্রায় দু দশক আগে থেকেই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি তাঁদের, সে বেঁচে আছে না মারা গিয়েছে, তাও ছিল অজানা।

২০১৫ সালের প্রথম দিতে কিছু অফিসার তাঁদের বাড়িতে যান। তখনই ইরফান ও রুকাইয়া জানতে পারেন তাঁদের ছোট ছেলে, যে ৯-এর দশকের গোড়ায় বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, সে এখন বিশ্বের অন্যতম কুখ্যাত জঙ্গি গোষ্ঠীর দক্ষিণ এশিয়ার সর্বেসর্বা।

তার আগেও অবশ্য সিবিআই ও গোয়েন্দা দফতরের তদন্তকারীরা তাঁদের বাড়ি গিয়েছিলেন, কিন্তু সে অনেক বছর আগের কথা।

রুকাইয়া জানিয়েছিলেন, টাকা পয়সা নিয়ে ঝগড়া হওয়ার পর বাড়ি ছাড়ে সানাউল হক।

Al Qaeda, AQIS সানাউলের বাবা ইরফান (ছবি- গজেন্দ্র যাদব)

তিনি বলেছিলেন, দেওবন্দের দার উল উলুমে পড়াশোনা শেষ করার পর আরও পড়াশুনো করতে সৌদি আরব যাবার জন্য বাবার কাছে ৮০ হাজার টাকা চায় সানাউল। বাবা টাকা দিতে না চাওয়ায় তা নিয়ে ঝগড়া হয়। বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করায় তার কাকা সানাউলকে থাপ্পড় মারে। রেগে গিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় সানাউল।

শুরুতে পরিবারের তরফ থেকে খোঁজাখুঁজি হয়েছিল। আমরা পুলিশের কাছে যাই। কিন্তু এখন আর চাই না যে ও ফিরে আসুক।

ইরফান জানিয়েছিলেন, তাঁদের পরিবার ওই অঞ্চলে বেশ পরিচিত, ইরফানের ঠাকুর্দা ছিলেন জেলাশাসক এবং তাঁর বাবা ছিলেন গ্রামের মুখিয়া।

ইরফানের কথায়, আমার ছেলেবেলায় পুলিশ প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত গ্রামের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবার জন্য। এখন তারা আসে আমার ছেলের খোঁজ নেবার জন্য। প্রথম ওরা এসেছিল ১৯৯৯ সালে, বলেছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার পর যে জঙ্গি কার্যকলাপ হয়ে, আমার ছেলে তার সঙ্গে যুক্ত।

২০১৫ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর যখন দেখা হয়, সে সময়ে ইরফান প্রায় হাঁটতেই পারেন না। তিনি বলেছিলেন, সানাউলকে ছেড়ে তিনি ভাল আছেন, তাঁর অন্য সন্তানাদিরা ভাল আছে। আমার তিন ছেলে দুই মেয়ে। সানাউল আমার চতুর্থ সন্তান। এক মেয়ে ও দুই ছেলের পর ওর জন্ম। এক ছেলে মোরাদাবাদে প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষক, অন্যজন দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়রের কাজ করে।

পাকিস্তান হয়ে সন্ত্রাসের পথে

দেওবন্দ সেমিনারি থেকে ১৯৯১ সালে গ্র্যাজুয়েট হয় সানাউল হক। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর জেহাদি কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে সে। ১৯৯৫ সালে সম্ভল ছেড়ে উধাও হয়ে সানাউল, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

সে বছরেরই শেষের দিকে পাকিস্তান পৌঁছয় সানাউল। সেখানে সে যোগ দেয় জামিয়া উলুম এ করাচি মাদ্রাসায়। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই উঠে এসেছে জৈশ এ মহম্মদ নেতা মৌলানা মাসুদ আজহার, হরকত উল জিহাদ আল ইসলামির মাথা কারি সাফিউল্লা আখতার, এবং হরকত উল মুজাহিদিনের নেতা ফজল উর রহমান খলিল।



খুব শীঘ্রই সানাউল যোগ দেয় হরকত উল মুজাহিদিন সংগঠনে। এ সংগঠন আইএসআইয়ের সবচেয়ে পুরনো অ্যাসেটগুলির অন্যতম। ১৯৮০ সালের সোভিয়েত সেনার সঙ্গে আফগানিস্তানে লড়াইয়ের সময়ে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংগঠন এই সংগঠন তৈরি করে। আফগানিস্তান যুদ্ধ শেষ হবার পর হরকত উল মুজাহিদিনকে কাজে লাগানো হয় জম্মু কাশ্মীরে সন্ত্রাস সৃষ্টির কাজে শক্তি ব্যয় করতে।

১৯৯০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সানাউল হক বাতরাসি, করাচি এবং পেশোয়ারে জিহাদিদের শিক্ষা দান করে এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে হরকতের ট্রেনিং ক্যাম্পেও কাজ করে।

আমেরিকায় ৯-১১ র আল কায়েদা হানার পর আফগানিস্তানে মার্কিনবাহিনীর প্রবেশ এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হবার পর সানাউল করাচিতে ফিরে আসে এবং ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত হারুনাবাদে হরকত উল মুজাহিদিনের অফিসে বাস করে।

আল কায়েদায় সানাউল্লা

২০০৭ সালের গ্রীষ্মে পাকিস্তানি একনায় জেনারেল পারভেজ মুশারফ ইসলামাবাদের লাল মসজিদে সেনাবাহিনী প্রবেশের আদেশ দেবার পর সানাউল আল কায়েদার প্রতি আকৃষ্ট হয়। লাল মসজিদে মাদ্রাসা চালাত দামিয়া উলুম এ ইসলামিয়ার প্রাক্তনী মৌলানা আব্দুল রশিদ গাজি।

সানাউল যোগাযোগ করে আল কায়েদার ঘনিষ্ঠ জিহাদি মহম্মদ ইলিয়াস কাশ্মীরির সঙ্গে। মনে করা হয়, এই সময়েই তালিবান ঘনিষ্ঠ মৌলবি নিজামুদ্দিন শামজাইয়ের কাছাকাছি আসে সে। মৌলানা শামজাইকে একসমেয় মোল্লা মহম্মদ ওমরের আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরশাহীর রাষ্ট্রীয় অতিথি বলে পরিচর্যা করা হত।

২০১৩ সালে সানাউল ভারতীয় মুসলিমদের টার্গেট করে প্রথম উপদেশ দেয়, যা সারা পৃথিবীর জিহাদি লেখালিখির মধ্যে প্রথম। ভারতে মুসলিম বিরোধী জেহাদি সাম্প্রদায়িক হিংসার সূচনা করে সানাউল্লা।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আল কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি ভারতীয় উপমহাদেশে আল কায়েদা (একিউআইএস) প্রতিষ্ঠা করে এবং মৌলানা আসিম ওমরকে সংগঠনের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করে।

ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ কিছু জঙ্গি হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে এই সংগঠন, এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সেকুলার ব্লগার হত্যা।

সানাউল ওরফে ওমরের সন্ধান

একিউআইএস প্রতিষ্ঠার পর তার প্রধান ওমরই যে সানাউল্লা তা স্পষ্ট হয়নি। সানাউলের কোনও ফোটো ছিল না, এবং প্রচারমূলক ভিডিওগুলিতে তাকে দেখা যেত ডিজিটাল মুখোশের আড়ালে।

যদিও একিউআইএস প্রধান পাকিস্তানের বাসিন্দা হলেও সে যে আদতে ভারতীয়, তেমন একটা সন্দেহ ছিলই।

উত্তর প্রদেশের মহম্মদ আসিফ এবং উত্তর প্রদেশের আদি বাসিন্দা কিন্তু ওড়িশার কটকে বর্তমান নিবাসী আবদুল রহমান এই দুজনকে গ্রেফতার করা হয় ২০১৫ সালের শরৎ থেকে শীতের মধ্যে। সে সময়েই সম্ভলের সানাউল হকের সঙ্গে ওমরের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

উত্তর প্রদেশ থেকে ধৃত আসিফ একিউআইএসের ভারতীয় প্রধান ছিল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। তারও বাড়ি সম্ভলে এবং সানাউলের সঙ্গেই তার বেড়ে ওঠা, এবং তারা দীর্ঘদিনের বন্ধুও বটে। ২০১২ সালে ইরান হয়ে পাকিস্তান গিয়েছিল আসিফ ও তার দুই সহযোগী এবং তিনজনেই মিরানশাহের ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণও নেয়।

কিন্তু আসিফের শরীর ভাল না থাকায়, আদর্শগত প্রশিক্ষণ শেষে সানাউল ২০১৪ সালে তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। আল কায়েদার হয়ে ভারতে কাজ করার জন্য অল্পবয়সীদের নিয়োগের দায়িত্বভার দেওয়া হয় আসিফের উপর।

পুলিশ জানিয়েছিল, অন্য ধৃত রহমান দেওবন্দ থেকে দুটি পিএইচডি করে, একটি আরবি ও অন্যটি ইসলামিক স্টাডিজে। গ্রেফতারের সময়ে রহমান কটক জেলার টাঙ্গি এলাকায় একটি মাদ্রাসা চালাত। গ্রেফতারি আগে সে অন্তত একজনকে একিউআইএসের প্রজেক্টের জন্য নিয়োগ করেছিল।

গ্রেফতারির পর পুলিশ জানায় রহমান পাকিস্তান, দুবাই, লন্ডন এবং সৌদি আরবে ভ্রমণ করেছিল। ভারতে সে কর্নাটক, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশে কাজকর্ম চালাত। ২০১৫ সালে ঝাড়খণ্ড পুলিশ হিংসাত্মক বক্তৃতা দেবার অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল।

Read the Full Story in English

Advertisment