শনিবার ৬ জুন লাদাখে ভারত ও চিনের শীর্ষ সামরিক কম্যান্ডারদের মধ্যে আলোচনার পর ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য দু পক্ষের মধ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক আলোচনা চলবে।
গত এক মাসের বেশি সময় ধরে লাদাখে ইন্দো-চিন সীমান্তে সমস্যা সমাধান হয়নি, উত্তেজনাও কমেনি।
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত ও চিনের মধ্যে উত্তেজনার কথা কবে প্রথম জানা গেল?
সরকারিভাবে বিষয়টির স্বীকৃতি দেওয়া হয় গত ১০ মে, যখন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয় ভারত ও চিনের পেট্রোলিং বাহিনীর মধ্যে দু জায়গায় সংঘর্ষ ঘটেছে।
কীভাবে ছ’বছর আগে মিটেছিল আরেক ভারত-চিন সংঘাত
সিকিমের নাকু লা-তে চিনের একটি পেট্রোলিং বাহিনী প্রকৃত নিয়ন্ত্রনরেখায় ভারতের দিকে এসে পড়লে তাদের সঙ্গে ভারতীয় পেট্রোলিং বাহিনীর সংঘর্ষ হয়।
সেনাবাহিনী এর চেয়েও একটি গুরুতর ঘটনার কথা জানায়, যা প্যাংগং সো হ্রদ এলাকায় ৫-৬ মে-র রাতে ঘটেছিল, এবং যে ঘটনার জেরে দু পক্ষের সেনাবাহিনী আহত হয়।
সংকট নিয়ে মূল যে বিষয়গুলি এখনও জানা গিয়েছে তা এখানে লিপিবদ্ধ থাকল।
কত পরিযায়ী শ্রমিক বাস্তুচ্যুত হলেন এই লকডাউনে?
১৪ মে সেনাবাহিনীর প্রধান এম এম নারায়ণে বলেন, এই দুটি ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বা স্থানীয় অন্য কোনও ঘটনার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
এই বিবৃতিগুলির পরেঅ বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্রের সাংবাদিক সম্মেলনে দুটি প্রশ্নের উত্তরে লাদাখের ঘটনার কথা স্বীকার করে নেওয়া হলেও সে সম্পর্কে বিশদে কিছু বলা হয়নি। চিনের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্রের সাংবাদিক সম্মেলনেও একই রকমের বিবৃতি দেওয়া হয়।
এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও কী একটা বলেছিলেন না?
হ্যাঁ, বলেছিলেন বৈকি।
২৯মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথা হয়েছে এবং ট্রাম্প দাবি করেন, সীমান্ত সমস্যা নিয়ে চিনের সঙ্গে যা চলছে তা নিয়ে মোদীর মন-মেজাজ ভাল নেই। ট্রাম্প এ বিষয়ে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও দেন।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় দুই নেতার মধ্যে ৪ এপ্রিলের পর থেকে আর কথা হয়নি। ভারত ও চিন দু পক্ষই ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবি উড়িয়ে দেয় এবং ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং আমেরিকার প্রতিরক্ষাসচিবকে জানিয়ে দেন বিষয়টি দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করা হবে।
তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মোদীর মধ্যে গত ২ জুন কথা হয়েছে। ভারতের তরফ থেকে জানানো হয়েছে ভারত-চিন সীমান্ত সমস্যা নিয়ে কথা হয়েছে দু পক্ষের।
পরিস্থিতির গুরুত্ব আমরা কেমন করে অনুধাবন করব?
নেটওয়ার্ক ১৮-এ গত ২ জুন এক সাক্ষাৎকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, সত্যিই সীমান্তে চিন লোকজন নিয়ে এসেছে। ওরা দাবি করছে এটা ওদের এলাকা। আমাদের দাবি এটা আমাদের এলাকা। এ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। চিনাদের একটা বড় অংশ চলে এসেছে। ভারতের যা করার তা ভারত করবে। ভারতীয় এলাকায় চিনের সেনা প্রবেশ করেছে কিনা সে নিয়ে তিনি কিছু বলেননি।
কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে ভারতের অর্থনীতি?
তাহলে লাদাখ সীমান্তের পরিস্থিতি এখন কী?
লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা জুড়ে চিন বড় সংখ্যক সৈন্য ও সমরসম্ভার একত্র করেছে। এর মধ্যে প্যাংগং সো এলাকায় এবং এর উত্তরদিকে চিনা সৈন্য তারা যাকে নিয়ন্ত্রণরেখা বলে মনে করে সেই বরাবর সেনা মজুত করেছে।
উপগ্রহচিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে যেসব এলাকা ভারতের বলে দাবি করা হয়, সেখানে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। হট স্প্রিং এলাকায় চিনারা পিপি১৪, পিপি১৫ ও গগরায় বিপুল সেনা ও ভারী সমরসম্ভার জড়ো করেছে।
চিনের নিজস্ব এলাকা গলওয়ান নদী উপত্যকাতেও বিপুল চিনাবাহিনী জড়ো করার খবর পাওয়া গিয়েছে।
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার এই সব জায়গাই কি বিতর্কিত?
সীমান্তের বেশ কিছু এলাকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে ভারত ও চিনের উপলব্ধি ভিন্ন। এই বিতর্কিত এলাকায় দুদেশের সেনাবাহিনীই পেট্রোলিং করে, যার জেরে সংঘর্ষ পরিস্থিতির সূচনা হয়। দুদেশের সীমান্তে এরকম মোট ২৩ টি এলাকা রয়েছে ভারতের তরফ থেকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
চিনের তরফ থেকে লঙ্ঘনের ঘটনাও ভারত নথিবদ্ধ করেছে, যা প্রায়শই ঘটেছে এই বিতর্কিত এলাকায়। গত পাঁচ বছরে এই লঙ্ঘনের যে ঘটনাগুলি ঘটেছে, সবই মোটামুটি সরকার চিহ্নিত এলাকাগুলিতেই ঘটেছে।
এই দুই ধরনের নথি থেকে দেখা যাচ্ছে প্যাংগং সো এলাকার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে ভারত ও চিনের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। গলওয়ান ও হট স্প্রিং এলাকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে আগে কখনও দুপক্ষের মধ্যে অসম্মতির ঘটনা ঘটেনি।
চিনের ভূমিকায় ভারত কি বিস্মিত?
হ্যাঁ, দুটি কারণে।
প্রথমত চিন দু জায়গায় সেনা জড়ো করেছে যেখানে আগে কোনও বিতর্ক ছিল না। দ্বিতীয়ত কোভিড ১৯ অতিমারীর জন্য ভারত লাদাখে তাদের বার্ষিক অনুশীলন বাতিল করেছে, যার জেরে তারা দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারত।
চিনারাও এই এলাকায় প্রতি গ্রীষ্মে অনুশীলন করে, এবং তারা তাদের বাহিনীকে ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় জড়ো করেছে, অন্যদিকে ভারতকে বিভিন্ন জায়গা থেকে সেনা জড়ো করতে হয়েছে।
তবে ভারতও এখনও চিনের সমান বাহিনী ও সম্ভার এই এলাকায় জড়ো করেছে।
এখনও পর্যন্ত দু পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়নি?
না। ১৯৬৭ সাল থেকে ভারত-চিন সীমান্তে কোনও গুলি বিনিময় হয়নি। তবে একাধিকবার হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে যাতে দুপক্ষের সেনারাই আহত হয়েছে বলে খবর। টুইটার ও উইবোতে বিভিন্ন ভিডিও ও ছবি প্রকাশিত হয়েছে যাতে বন্দি ও আহত সেনাদের দেখা যাচ্ছে, এর ফলে উত্তেজনা বেড়েছে।
দুপক্ষের মধ্যে কথা হচ্ছে?
স্থানীয় পর্যায়ে সামরিক স্তরে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে, ডিভিশন কমান্ডার পর্যায়ে তিন দফা আলোচনা হয়েছে।
এখান থেকে সমাধান না হওয়ায় কর্পস কমান্ডার পর্যায়ে শনিবার কথা হয়েছে। একই সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে বেজিং ও নয়া দিল্লিতেও আলোচনা হয়েছে।
এর আগেও এরকম অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল ২০১৩ সালে ডেপসাংয়ে, ২০১৪ সালে চুমারে এবং ২০১৭ সালে ডোকলামে- কূটনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ে বহুবার আলোচনার পর সে অচলাবস্থা ভাঙে। এবারও সম্ভবত তেমনটাই হবে, তবে এ প্রক্রিয়া দীর্ঘকালীন হতে পারে।