Advertisment

সীমান্তে ভারত-চিন সংঘর্ষ: পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, এর পর কী?

গালওয়ান উপত্যকা তাদের বলে ফের দাবি করেছে চিন এবং তাদের সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে ভারতীয় সেনা দু বার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
India-China Galwan

লাদাখে গালওয়ান উপত্যকার উপগ্রহ চিত্র

লাদাখে ভারত-চিন সেনা সংঘর্ষের পর বেশ কিছু সময় গড়িয়েছে। একবার দেখে নেওয়া যাক, আমরা এ নিয়ে কী কী জেনেছি।

Advertisment

পরিস্থিতি কি গুরুতর?

নিঃসন্দেহে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে পর এই প্রথম লাদাখের ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষে সৈন্যের প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। অন্য জায়গার হিসেবও যদি করা হয় তাহলে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় শেষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল অরুণাচল প্রদেশে আসাম রাইফেলসের টহলদারির সময়ে, ১৯৭৫ সালে। তবে দু দেশের সেনার মধ্যে সত্যিকারের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল সিকিমের নাথু লা-য়, ১৯৬৭ সালে। সেবার ভারতের ৮৮ জন সেনা প্রাণ হারিয়েছিলেন, মৃত্যু ঘটেছিল ৩০০-র বেশি চিনা সেনার।

কিন্তু এসব ঘটনাই ১৯৯৩ সালে সীমান্তে শান্তি ও সুস্থিতি রক্ষার জন্য দু দেশের মধ্যে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে।

আরও পড়ুন, ভারত-চিন সংঘর্ষ: ফিরে দেখা ১৯৬৭ সালের গুলির লড়াই

সবচেয়ে বড় কথা, সোমবার গালওয়ানে একজন কম্যান্ডিং অফিসার সহ অন্তত ২০ জন সৈনিক প্রাণ হারিয়েছেন। যদি সংখ্যাকে প্রেক্ষিত ধরা যায়, ২০১৬ সালে উরি হামলায় ১৯ জন সেনা প্রাণ হারানোর পর নরেন্দ্র মোদী সরকার এলওসি-র ওপারে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল।

কিন্তু দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়নি। সেটা কি একটা ভাল দিক নয়?

না, তা নয়। এক রাউন্ড গুলি না চালিয়েও যদি এত বড় সংখ্যক সেনার মৃত্যু ঘটে থাকে তাহলে সে মৃত্যু বন্দুক-রাইফেলের গুলিতে মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি বর্বর।

তবে হাতাহাতিতে সংঘর্ষ সীমাবদ্ধ থাকায় রাইফেল, হাওইৎজার, রকেট, মিসাইল ও ফাইটার বিমানের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি ঘটেনি। চিন ও ভারত দু দেশই পরমাণু শক্তিধর এবং তীব্রতাবৃদ্ধির কোনও রকম সম্ভাবনাই বিপজ্জনক।

কিন্তু এটা কিছুটা সুতোয় ঝোলানো আশার মত যে দু দেশের ইতিহাসে এরকম কোনও ঘটনা নেই। এমনকি নাথু লাতেও, সেনা আর্টিলারি গান ও ফাইটার বিমান বৃদ্ধির আগে দু দেশের সেনাদের মধ্যে সীমান্তে হাতাহাতি হয়েছিল।

সোমবার গালওয়ান উপত্যকায় ঠিক কী ঘটেছিল?

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এলাকায় উত্তেজনা বাড়ছিল, দু দেশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবরা সেনা ও সামরিক সামগ্রী জড়ো করছিল। গালওয়ান উপত্যকা নিয়ে দু দেশের মধ্যে কখনও বিবাদ না হওয়া সত্ত্বেও ওই এলাকায় চিনারা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে। ৬ জুন কর্প কম্যান্ডার স্তরে বৈঠকের পর, স্থানীয় কম্যান্ডারদের মধ্যে আলোচনা হয় এবং দু দেশের সেনাই পিছু হঠার ব্যাপারে সম্মত হয়।

আরও পড়ুন, চিনের পেশিপ্রদর্শনের কারণ কী?

তারই প্রক্রিয়ায়, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ও শিয়ক ও গালওয়ান নদীর মিলনস্থলের মাঝে দু দেশের মধ্যে সংঘর্ষ এড়াতে বাফার জোন তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এর প্রথম ধাপ হিসেবে দু দেশের সেনা এক কিলোমিটার করে পিছু হঠতে সম্মত হন।

এই প্রক্রিয়ার দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্নেল বি সন্তোষ বাবু দেখেন একটি চিনা শিবির তখনও ওখানে রয়েছে, তিনি শিবির সরানোর জন্য সেখানে যান। এর পরেই ঘুষোঘুষি শুরু হয়, যার জেরে হতাহতের ঘটনা ঘটে।

ভারতীয় সেনাদের কাছে অস্ত্র ছিল না?

না। দু পক্ষই ড্রিল অনুসারে সীমান্ত এলাকায় গুলি চালনার মাধ্যমে উত্তেজনাবৃদ্ধির ঘটনা এড়াতে এই প্রথা মেনে থাকে।

১৯৯৬ সালের চুক্তি অনুসারে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সামরিক সম্ভার, অনুশীলন, বিস্ফোরণ ও বিমান বিষয়ক প্রচুর বিধিনিষেধ আরোপিত রয়েছে।

কিন্তু গুলি না চললে এত সেনা মারা গেল কী করে?

লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির পর থেকেই দু দেশের সেনার মধ্যে বিক্ষিপ্ত হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। ৫ মের গভীর রাতে প্যাংগং সো এলাকায় দু দেশের সেনার মধ্যে ব্যাপক হাতাহাতি হয়, যার জেরে ৭০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু ঘটে। অধিকাংশ সংঘর্ষেই চিনারা ব্যাট, লাঠি, পাথর, ঘুসি এসবই ব্যবহার করেছে।

সোমবারের ঘটনায় ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত ছাড়াও কিছুজনকে খরস্রোতা গালওয়ান নদীতে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। অধিকাংশের মৃত্যুই হয়েছে  সঙ্গে উঁচু জায়গার প্রবল ঠান্ডায় ক্ষতবৃদ্ধি হওয়ায়।

আরও পড়ুন, একটি রাস্তাই কি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় বিবাদের মূলে?

কত চিনা সৈন্য এই সংঘর্ষে মারা গিয়েছেন বা আহত হয়েছেন?

সেনাবাহিনী ও বিদেশমন্ত্রকের দেওয়া সরকারি বয়ানে চিনা সৈন্যের হতাহতের কোনও বিবরণ দেওয়া হয়নি, তবে মঙ্গলবার সেনবাহিনীর প্রথম বয়ানে বলা হয়েছিল দু পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

চিন সরকার বা গণমুক্তি ফৌজের করফেও সেনাবাহিনীর হতাহতের কথা বলা হয়নি।

একমাত্র সংবাদসংস্থা এএনআই নামহীন সূত্র উদ্ধৃত করে দাবি করেছে, রেডিও ট্রান্সপিশন ইন্টারসেপ্ট করে জানা গিয়েছে ৪৩ জন চিনা সৈন্য সংঘর্ষে হতাহত হয়েছেন।

usnews.com -এর এক রিপোর্টে আমেরিকান গোয়েন্দাবিভাগকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে এক আধিকারিক সহ ৩৫ জন চিনা সৈন্য মারা গিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

সংঘর্ষস্থলের উত্তেজনা কি এখন প্রশমিত হয়েছে?

দু দেশের সেনার মধ্যে মেজর জেনারেল পর্যায়ের বৈঠকে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়, যা রাত অবধি গড়িয়েছে। এর ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং ভারত সম মৃতদেহ উদ্ধার করতে পেরেছে। চিনকে হেলিকপ্টার এনে আহতদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনা নিশ্চয় তুঙ্গে?

হ্যাঁ, লাদাখ সীমান্তের বেশ কিছু জায়গায় মে মাস থেকেই ভারতীয় ও চিন সেনারা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। সাম্প্রতিক ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা বাড়লেও কোনও সংঘর্ষের খবর এখনও নেই।

আরও পড়ুন, কীভাবে ছ’বছর আগে মিটেছিল আরেক ভারত-চিন সংঘাত

সব মিলিয়ে পরিস্থিতির অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে?

৬ জুন কর্পস কম্যান্ডারদের মধ্যে বৈঠকের পর দু দেশই সেনা অপসারণ ও তীব্রতাহ্রাস করবে বলে আশা করা গিয়েছিল। ১০ জুন থেকে অন্য সেনা কম্যান্ডারদের মধ্যেও ১০ দিন ধরে বৈঠকের কথা ছিল এবং তার মধ্যে অপসারণের প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার কথাও ছিল।

কিন্তু এই ঘটনার পর, সে প্রক্রিয়া এখন পিছনের সারিতে চলে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে এবং খুব দ্রুত সমস্যা মেটা সম্ভব হবে বলেও মনে হচ্ছে না। গালওয়ান উপত্যকা তাদের বলে ফের দাবি করেছে চিন এবং তাদের সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে ভারতীয় সেনা দু বার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করেছে।

বিদেশমন্ত্রকও বলেছে চিন গালওয়ান উপত্যকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করেছে যার জেরে বর্তমান পরিস্থিতি। এই অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের পরিস্থিতিতে এবং এতজন সেনার মৃত্যুর ফলে জনমানসে উদ্ভূত আবেগের জেরে যে কোনও সমাধান প্রচেষ্টা পরীক্ষার মুখে পড়বে।

এর পর কি পরিস্থিতির তীব্রতাবৃদ্ধি হবে?

দুপক্ষের সামরিক ও কূটনৈতিক স্তরে আলাপ আলোচনা যখন চলছে সে সময়ে বড়সড় সংঘর্ষ পরিস্থিতি ঘটবে না বলেই আশা করা যাচ্ছে। কিন্তু সংঘর্ষ পরিস্থিতির নিজস্বতাও থাকে এবং বিভিন্ন ঘটনা সেরা পরিকল্পনাকেও ভেস্তে দিতে পারে। যদি সামরিক সংঘর্ষ হয় তাহলে তা একটি নির্দিষ্ট এলাকায়, পুরো সীমান্ত জুড়ে বা কোনও একটি সেক্টরে হতে পারে। তবে যদি নতুন করে কোনও প্ররোচনা বা সংকট তৈরি না হয় তাহলে দু পক্ষেরই শান্তিপূর্ণ সমাধান করে ফেলা উচিত।

সরকার সেক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণ তৈরি রাখবে এবং কিছু সেনাকে এগিয়েও রাখবে যদি কোনও ঘটনা ঘটে তার দ্রুত প্রতিক্রিয়া ঘটাবার জন্য।

একই সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে সংকটের সমাধানও করতে চাইবে সরকার এবং চিনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দেশের জনমানসের তরফ থেকে যেন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি না হয় তারও চেষ্টা চলবে। এই কৌশলের রূপায়ণ কেমন ভাবে হচ্ছে তার উপরেই নির্ভর করছে চিন সম্পর্কে ভারতের পরবর্তী অ্যাকশন।

china
Advertisment