আইএনএক্স মিডিয়া মামলায় গত ২১ অগস্ট রীতিমতো নাটকীয়ভাবে দিল্লির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয় দেশের প্রাক্তন অর্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমকে। এ সংক্রান্ত দুর্নীতি ও টাকা নয়ছয়ের মামলায় এই প্রবীণ কংগ্রেস নেতাকে গ্রেফতারি থেকে সুরক্ষাকবচ দেয়নি সুপ্রিমকোর্ট। এর আগে দিল্লি হাইকোর্টও পি চিদাম্বরমের আগাম জামিন ও অন্তর্বর্তী সুরক্ষাকবচের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল।
২০১৭ সালের মে মাসে সিবিআই একটি এফআইআর দায়ের করে। তাতে অভিযোগ করা হয়, ফরেন ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন বোর্ড (এফআইপিবি) ২০০৭ সালে বিদেশ থেকে ৩০৫ কোটি টাকার ফান্ড পাওয়ার জন্য আইএনএক্স গোষ্ঠীকে যে ছাড়পত্র দিয়েছিল তাতে অনিয়ম করা হয়েছে। ওই সময়ে পি চিদাম্বরম ছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
গত বছর ইডি অর্থ পাচারের একটি মামলা দায়ের করে এবং সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চিদাম্বরমকে ডেকে পাঠায়। এ বছর দুটি মামলাতেই আগাম জামিনের আবেদন করে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন চিদাম্বরম।
আরও পড়ুন, সিবিআই দফতরে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তৃণমূল ও সারদা যোগাযোগ
প্রথম বেনিয়ম
২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অধীন ফিনানসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট মরিশাসের তিনটি সংস্থাকে আইএনএক্স মিডিয়া গোষ্ঠীতে ৩০৫ কোটি টাকা লগ্নির অনুমোদন দেয়। ওই সংস্থার কর্ণধার ছিলেন পিটার ও ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়।
মুম্বইয়ের আয়কর দফতর এ মামলা ইডির কাছে পাঠায়। ২০১০ সালে আইএনএক্স মিডিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশি মু্দ্রা আইন (ফেমা)-এ একটি মামলা দায়ের করে ইডি।
আরও পড়ুন, পাক সেনাপ্রধান বাজওয়ার মেয়াদ বৃদ্ধি কী ইঙ্গিত করে?
কার্তি চিদাম্বরম
বেশ কয়েকবছর পর চিদাম্বরমের ছেলে কার্তির সঙ্গে যুক্ত একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর সময়ে কার্তির চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ভাস্কররমনের কম্পিউটার থেকে আইএনএক্স মিডিয়া সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য পায় ইডি। ওই নথিগুলি থেকে ইঙ্গিত মেলে যে সময়ে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক এফআইপিবি ছাড়পত্র দিয়েছে, সে সময়েই আইএনএক্স মিডিয়া কার্তির অভিযুক্ত সংস্থায় অর্থ প্রদান করেছে।
ইডির কাছ থেকে এ ব্যাপারে তথ্য পেয়ে সিবিআই ২০১৭ সালের মে মাসে একটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে এবং কার্তি ও তাঁর বাবা পি চিদাম্বরমের বাড়ি তল্লাশি করে। এর পর ইডি কার্তির বিরুদ্ধে অর্থ নয়ছয়ের মামলা রুজু করে।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সিবিআই কার্তিকে গ্রেফতার করে। পরে দিল্লি হাইকোর্ট তাঁকে ছেড়ে দেয়। তিনি এখন শিবগঙ্গা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের লোকসভা সাংসদ।
সিবিআইয়ের মামলা
এফআইআরে সিবিআই বলে, আইএনএক্স মিডিয়া ২০০৭ সালের মার্চ মাসে এফআইপিবি-র দ্বারস্থ হয়। তাদের আর্জি ছিল ১০ টাকা দরে তারা তিন অনাবাসীর কাছে ১৪.৯৮ লাখ ইকুইটি শেয়ার ও ৩১.২২ লক্ষ প্রেফারেন্স শেয়ার ছাড়তে চায়।
আইএনএক্স মিডিয়ার ইকুইটি মূলধনের ৪৬.২১ শতাংশই এই শেয়ারের মূল্য।
২০০৭ সালের ৩০ মে এফআইপিবি আইএনএক্স মিডিয়াকে ৪.৬২ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্র দেয়।
সিবিআইয়ের অভিযোগ আইএনএক্স মিডিয়া এফআইপিবি-র শর্তসাপেক্ষ ছাড়পত্র এড়িয়ে ৪.৬২ কোটি টাকার বদলে ৩০৫ কোটি টাকা সংস্থায় নিয়ে আসে।
সিবিআই সূত্র জানিয়েছে, বিদেশি সংস্থাগুলি আইএনএক্সের শেয়ার কেনে প্রতিটি ৮৬২.৩১ টাকায়, যা দর্শিত দামের চেয়ে ৮৬.২ গুণ বেশি।
আরও পড়ুন, মোদীর এক দেশ, এক ভোট: এর অর্থ কী?
চিদাম্বরমের সঙ্গে যোগসাজশ
সিবিআই অভিযোগ করেছে আয়কর দফতর এ নিয়ে তদন্ত শুরু করার পর এফআইপিবি ২০০৮ সালের ২৬ মে এ ব্যাপারে আইএনএক্স মিডিয়ার কাছে ব্যাখ্যা চাইলে, ওই সংস্থার তরফ থেকে কার্তি চিদাম্বরমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁকে অনুরোধ করা হয় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে অর্থমন্ত্রকের এফআইপিবি ইউনিটের সরকারি অফিসারদের উপর প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টি মিটমাট করিয়ে দেওয়ার।
সিবিআই অভিযোগ করেছে, তদন্ত করার বদলে ওই গোষ্ঠীকে অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেয় এফআইপিবি। ইতিমধ্যেই যে লগ্নি এসে পৌঁছেছে তার জন্য নতুন করে আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয় আইএনএক্স-কে।
চিদাম্বরমের বিরুদ্ধে মামলার সনতারিখ
১৫ মার্চ, ২০১৭- আইএনএক্স মিডিয়ার বিদেশ থেকে ২০০৭ সালে ৩০৫ কোটি টাকা লগ্নির জন্য এফআইপিবি ছাড়পত্রে গরমিলের অভিযোগ এনে সিবিআই এফআইআর রুজু করে। সে সময়ে কার্তি চিদাম্বরমের বাবা পি চিদাম্বরম কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ছিলেন।
ওই মাসেই আর্থিক দুর্নীতির মামলা দায়ের করে ইডি।
১৬ জুন, ২০১৭- কার্তির বিরুদ্ধে লুক আউট সার্কুলার জারি করে ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ ব্যুরো অফ ইমিগ্রেশন।
১০ অগাস্ট, ২০১৭- মাদ্রাজ হাইকোর্ট কার্তি ও আরও চারজনের বিরুদ্ধে জারি করা লুক আউট সার্কুলারের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে।
১৪ অগাস্ট, ২০১৭- সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ দেয়।
১৮ অগাস্ট, ২০১৭- সুপ্রিম কোর্ট কার্তিকে সিবিআইয়ের সামনে ২৩ অগাস্ট হাজিরা দিতে বলে।
১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭- সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে জানায় তারা বিদেশে এবং কার্তির ২৫টি বিদেশি সংস্থায় সম্ভাব্য লেনদেনের খুঁটিনাটি একটি বন্ধ খামে লিপিবদ্ধ রেখেছে।
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭- সিবিআই সুপ্রিম কোর্টকে জানায় কার্তির বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়েছে কারণ তিনি বিদেশি ব্যাঙ্কের অ্যাকউন্ট বন্ধ করার চেষ্টা করছিলেন।
৯ অক্টোবর, ২০১৭- কার্তি তাঁর মেয়েকে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য ব্রিটেন যাওয়ার অনুমতি চান সুপ্রিম কোর্টের কাছে।
৯ অক্টোবর, ২০১৭- পি চিদাম্বরম সুপ্রিম কোর্টে বলেন, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার তাঁর ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে।
২০ নভেম্বর, ২০১৭- সুপ্রিম কোর্ট কার্তিকে মেয়ের ভর্তির জন্য ব্রিটেন যাওয়ার অনুমতি দেয়।
৮ ডিসেম্বর, ২০১৭- কার্তি সুপ্রিম কোর্টে এয়ারসেল মাক্সিস মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের দেওয়া সমনকে চ্যালেঞ্জ জানান।
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮- কার্তিকে সিবিআই চেন্নাই বিমানবন্দরে গ্রেফতার করে দিল্লি নিয়ে আসে। দিল্লি আদালত তাঁকে একদিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেয়।
৫ মার্চ, ২০১৮- কার্তি আর্থিক দুর্নীতি মামলায় ইডি-র দেওয়া সমনকে চ্যালেঞ্জ জানান।
৬ মার্চ, ২০১৮- বিশেষ আদালত কার্তিকে ৩ দিনের সিবিআই হেফাজতে পাঠায়।
১২ মার্চ, ২০১৮- আদালত কার্তিকে ১২ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠায়। কার্তি দুর্নীতি মামলায় জামিন চেয়ে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন।
১৫ মার্চ, ২০১৮- সুপ্রিম কোর্ট কার্তিকে ইডির হাতে গ্রেফতারের উপর অন্তর্বর্তী সুরক্ষাকবচ দেয়।
২৩ মার্চ, ২০১৮- দিল্লি হাইকোর্ট আইএনএক্স মিডিয়া দুর্নীতি মামলায় কার্তিকে জামিন দেয়।
৩০ মে, ২০১৮- চিদাম্বরম সিবিআই দুর্নীতি মামলায় অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করেন দিল্লি হাইকোর্টে।
২৩ জুলাই, ২০১৮- ইডির দায়ের করা আর্থিক দুর্নীতি মামলায় অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন করেন পি চিদাম্বরম।
২৫ জুলাই, ২০১৮- হাইকোর্ট তাঁকে দুটি মামলাতেই অন্তর্বর্তী জামিন দেয়।
১১ অক্টোবর, ২০১৮- ইডি চিদাম্বরমের জোর বাংলো-র অর্ধেক অংশ বাজেয়াপ্ত করে।
১১ জুলাই, ২০১৯- শিনা বোরা হত্যা মামলায় অভিযুক্ত তথা আইএনএক্স মিডিয়ার কর্ণধার ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় রাজসাক্ষী হন।
২০ অগাস্ট, ২০১৯- হাইকোর্ট আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয় এবং সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের জন্য ৩ দিনের সময় দিতেও অস্বীকার করে।
২২ অক্টোবর, ২০১৯- সিবিআইয়ের দায়ের করা মামলায় জামিন পান প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
৪ ডিসেম্বর, ২০১৯- ইডি-র মামলায় জামিন পেলেন চিদাম্বরম, ১০৪ দিন পরে জেলের বাইরে।
Read the Full Story in English