জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নতুন ইন্টারগভর্নমেন্টাল রিপোর্ট সামনে এসেছে। প্রায় পুরনো কথাগুলিই নতুন করে, নতুন সুরে ও কায়দায় বলা হয়েছে এতে। রাষ্ট্রপুঞ্জের এই আইপিসিসি (Intergovernmental Panel on Climate Change) রিপোর্ট, যা কিনা ষষ্ঠতম, এবং কঠোর আগেরগুলি থেকে। বলেছে সময়সীমাটা আগামী পাঁচ কিংবা দশ বছর নয়, সীমায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েছি আমরা এখনই। এর পর খাদে গড়িয়ে যাওয়া পালা, মানে, শিল্পায়নের আগের থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার দিনগুলির শুরু তখন। ফলে কাজের কাজটা করতে হবে অতি দ্রুত বেগে।
রিপোর্ট বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ এখনকার চেয়ে ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে, না হলে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে তাপমাত্রাকে ধরে রাখা যাবে না। এটা বেশ কঠিন কাজ, কার্বন নিঃসরণের যে বাড়াবাড়ি দেখা যাচ্ছে, যে গতি চলছে, তার প্রেক্ষিতে এটিতে ওই অসম্ভবের উজ্জ্বল আলো জ্বলে আছে বলা যায়। ২০১০ সালে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ছিল যা, ২০১৯-এ তার চেয়ে নিঃসরণ বেড়েছে ১২ শতাংশ। এ থেকেই এটা স্পষ্ট পারে যে, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখাটা কার্যত অসম্ভব। আইপিসিস রিপোর্ট বলছে, কার্বন নিঃসরণ রুখতে সমস্ত পদক্ষেপ আরও শক্তপোক্ত করলে, এটা সম্ভবই। এবং সহজ প্রক্রিয়াতেই।
দ্বিচারিতা চলবে না
এখানে বলতে হবে, পৃথিবীর উষ্ণতা ইতিমধ্যেই শিল্পায়নের আগের থেকে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে। যে ভাবে এগোচ্ছে তাতে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মুখে আমরা পড়তে চলেছি আর কিছু কালের মধ্যে, এবং ১.৫ ডিগ্রি পেরিয়ে যাব তার পর। ফলে কোনও শিথিলতার কোনও প্রশ্ন নেই আর, ভাবের ঘরে চুরি করার কোনও দরকার নেই আর, মিথ্যে অর্ধসত্যের দিন গিয়েছে চলে, এখন জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সমস্ত পদক্ষেপগুলি সত্যের উপর আধারিত হতে হবে। ছটাক দ্বিচারিতায় তারগুলি ছিঁড়ে চৌচির হয়ে যাবে। অনেকেই বলছেন, যাই করা হোক না কেন কিছু কালের জন্য ১.৫ ডিগ্রিকে আমরা পেরিয়ে যাবই। কিন্তু তা বলে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর কোনও সুযোগ নেই। এবং এই যে বলা হল, ১.৫ ডিগ্রি পেরিয়ে যাব, এটা ধরে নিয়ে গাছাড়া দেওয়ারও কোনও প্রশ্ন নেই। তাতে তো চরম পরিণতি রোখার লড়াইয়েরই বিনাশ। হারার আগে হার মেনে নেওয়া। মরার আগে মড়া বনে যাওয়া।
এই আইপিসিসি রিপোর্ট নিয়ে দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক নভরোজ দুবাশ বলছেন, 'লক্ষ্যমাত্রা ১.৬ ডিগ্রি নয়, ১.৫ ডিগ্রি রাখতে হবে। চাঁদমারি পিছানো একেবারেই ঠিক হবে না। যত কমে তাপমাত্রাকে আটকে রাখতে পারব, ততই পৃথিবীর পক্ষে মঙ্গল। তাই এই চেষ্টায় কোমর বাঁধতে হবে।' এও শোনা যাচ্ছে যে, জলবায়ু-রক্ষায় যে প্রতিশ্রুতিগুলি দেওয়া হয়েছে, সেই মতো এগিয়ে গেলে আমরা শিল্পায়নের আগের চেয়ে ৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পৌঁছে যাব, যা তীব্র অস্বস্তিকর তো একশো বার, এটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আরও কতটা কড়া রাস্তা আমাদের ধরতে হবে।
হ্যাঁ, আইপিসিসি রিপোর্ট পথ দেখিয়েছে। আমাদের পক্ষে তা এমন কিছু ক্লেশকরও নয়। বলা হয়েছে, গোটা পৃথিবীর কার্বন নিঃসরণ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেক করা সম্ভব নয়া প্রযুক্তির মাধ্যমে। এক টন কার্বন্ডাই অক্সাইডের সমতুল নিঃসরণ কমাতে খরচ হবে সে ক্ষেত্রে ১০০ ডলারেরও কম। এই রাস্তায় প্রযুক্তির স্টপ হল-- সৌর এবং জলশক্তির ব্যবহার, মানে পেট্রোলিয়াম কিংবা কয়লাজাত শক্তির ব্যবহার দ্রুতবেগে কমিয়ে, জঙ্গল-কাটা কমিয়ে ফেলা ইত্যাদি। এবং ২৫ শতাংশ নিঃসরণ কমানো যাবে প্রযুক্তির আর এক প্রয়োগে, এক টন কার্বন্ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমানোর জন্য খরচ হবে সে ক্ষেত্রে ২০ ডলারের কম। এর মধ্যে রয়েছে ইলেক্ট্রিক গাড়ির ব্যবহার, মোটরসাইকেলের বদলে সাইকেলে চড়া এবং গণপরিবহণের মাধ্যমে যথাস্থানে পৌঁছানো ইত্যাদি। রিপোর্ট বলছে, বেশ কিছু প্রযুক্তিক্ষেত্রের দাম গত কিছু বছরে ভাল মাত্রায় কমেছে। যেমন ২০১০ সাল থেকে বায়ুশক্তি বা উইন্ড পাওয়ারের দাম ৫৫ শতাংশ কমেছে। ফলে ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানির (কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি) বদলে যদি আমরা বায়ুশক্তির ব্যবহার করি, তা হলে খরচও যেমন কম হবে, তেমন প্রকৃতিও বাঁচবে।
এ ছাড়া বলার দরকার রয়েছে যে, বায়ু থেকে কার্বন টেনে নেওয়ার এক যন্ত্র এসে গিয়েছে, কয়েক বছর হল। বিরাট পুঁজিপতিদের অনেকেই এমন যন্ত্র নির্মাণে বিনিয়োগ করছেন। এর কাজ হল বায়ু থেকে কার্বন্ডাই অক্সাইড টেনে নিয়ে তার পর জলের সঙ্গে তাকে মিশিয়ে মাটির অনেক গভীরে পৌঁছে দেওয়া। যেখানে কার্বনের থাকার জায়গা, সেইখানে। ঘুমিয়ে থাকা যে কার্বনকে আমরা বিভিন্ন চেহারায় টেনে হিঁচড়ে বার করে এনে নিজেদেরই সাড়ে সর্বনাশের ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিয়েছি।
Read story in English