ইরানের এত তেল থাকতেও কেন তেলের দাম বাড়াল সরকার?

এই মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কাতারে কাতারে পথে নামেন প্রধানত বেকার বা দরিদ্র যুবকেরা। জবাবে তাঁদের ওপর গুলি চালায় ইরানের বিখ্যাত ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডস কোর।

এই মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কাতারে কাতারে পথে নামেন প্রধানত বেকার বা দরিদ্র যুবকেরা। জবাবে তাঁদের ওপর গুলি চালায় ইরানের বিখ্যাত ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডস কোর।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
iran protests 2019

ছবি: উইকিপিডিয়া কমনস থেকে

বিভিন্ন পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম, যেমন 'নিউ ইয়র্ক টাইমস', মনে করছে যে, ইরানের বর্তমান টালমাটাল অবস্থা সম্ভবত শেষবার দেখা গিয়েছিল ১৯৭৯ সালে, যখন প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নির্মম পদক্ষেপের ফলে নিহত হয়েছিলেন অন্তত ১৮০ জন।

Advertisment

এবছর যে শুধু তেলের দাম এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে ইরান সরকার তাই নয়, পাশাপাশি কড়া নির্দেশ দিয়েছে যেন নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি তেল কাউকে বিক্রি না করা হয়। এই জোড়া আদেশের বিরুদ্ধে নভেম্বরের মাঝামাঝি শুরু হয় প্রতিবাদ। কাতারে কাতারে পথে নামেন প্রধানত বেকার বা দরিদ্র যুবকেরা। জবাবে তাঁদের ওপর গুলি চালায় ইরানের বিখ্যাত ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডস কোর (Islamic Revolutionary Guards Corps)।

যেমনটা হয়েছে প্রতিবেশী লেবানন বা ইরাকে, ইরানেও প্রতিবাদের ধরন দ্রুত পাল্টেছে, অর্থনৈতিক সঙ্কট দিয়ে শুরু হলেও ক্রমশ পরিণত হয়েছে সমগ্র সরকার-বিরোধী আন্দোলনে।

১৫ নভেম্বর থেকে শুরু করে চারদিনের মধ্যে নিহত হয়েছেন ১৮০ থেকে ৪৫০ জন নাগরিক, আহত হয়েছেন দু'হাজার, আটক হয়েছেন আন্দাজ সাত হাজার। এমনটাই জানিয়েছে 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' যারা সংবাদ সূত্র হিসেবে উদ্ধৃত করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, বিরোধী দল, এবং বিক্ষুব্ধ ইরানি সাংবাদিককে।

Advertisment

কেন তেলের দাম বাড়াতেই হলো ইরানকে?

পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম বলছে, দেশের আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করতেই নতুন শক্তি নীতি গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে গভীরতর হয়েছে আর্থিক সঙ্কট, এবং দ্রুতগতিতে কমেছে অপরিশোধিত তেলের রপ্তানি।

রুহানি বলেছেন, বর্তমানে ইরানের আর্থিক ঘাটতি দেশের ৪৫ বিলিয়ন ডলারের (আন্দাজ ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকা) বার্ষিক বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ।

ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, বর্ধিত তেলের দামের উদ্দেশ্য হলো প্রায় ৬০ মিলিয়ন (৬ কোটি) ইরানির ভর্তুকির যোগান দেওয়া, যা কিনা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে ইরানের মুদ্রাস্ফীতির হার আনুমানিক ৪০ শতাংশ।

সরকারি সংবাদমাধ্যম বলছে দাম বাড়ার সঙ্গে বাজেটের কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'কে দেশের রাজধানী তেহরানের তেল ব্যবসায়ী মায়সাম শরিফি জানিয়েছেন, "রাজকোষ শূন্য, ওদের কাছে সেটা ভরার একমাত্র রাস্তা হলো লোকের পকেট থেকে টাকা নিয়ে নেওয়া"।

দাম বাড়লে কি ইরানের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে?

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, না। বহুদিন ধরেই অর্থনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে শক্তি ভর্তুকি বাতিল করার কথা বলে এসেছে ইরান সরকার, এবং রুহানির পূর্বসূরি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ভর্তুকির পরিবর্তে চালু করেছিলেন সরাসরি ক্যাশ ট্রান্সফার। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন নীতি সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এর প্রধান কারণ হলো, তেলের দাম যতটা বাড়লে সরকারি কোষাগারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারত, ততটা বাড়েনি, অথচ যা বেড়েছে, তাতে নাজেহাল হবেন সাধারণ মানুষ। লন্ডন প্রবাসী রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ আলিরেজা সালাভাতি নিউ ইয়র্ক টাইম্‌সের এক প্রতিবেদনে বলেছেন, "এই নীতির পেছনে যে দুর্বল পরিকল্পনা এবং জঘন্য রূপায়ণ রয়েছে, তার ফলে আরও বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি এবং অস্থিরতার মাত্রা।"

'তেলের ডিপো' ইরানে তেলের কারণেই অশান্তি অদ্ভুত নয়?

বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে তেলের ওপর ভালো পরিমাণ ভর্তুকি লাগু থাকার ফলে তা যথেচ্ছ ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি হয়েছে দেশে। বর্তমানে সরকার এক লিটার পেট্রোলের দাম ১০ হাজার রিয়াল থেকে বাড়িয়ে আন্দাজ ১৫ হাজার রিয়াল করে দিয়েছে, যা ভারতীয় টাকায় হিসেব করলে দাঁড়ায়, ১৭ টাকা থেকে বেড়ে ২৬ টাকা।

এছাড়াও যে কোনও প্রাইভেট গাড়ির মাসিক তেলের বরাদ্দ নির্ধারিত হয়েছে ৬০ লিটার, যার বেশি তেল কিনলে লিটার প্রতি দিতে হবে ৩০ হাজার রিয়াল (প্রায় ৫১ টাকা)।

ভারতীয়দের কাছে এই দাম অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা মনে হলেও, ভর্তুকিতে অভ্যস্ত ইরানিদের কাছে এই মূল্যবৃদ্ধি বড় রকমের ধাক্কা। প্রসঙ্গত, ইরানে রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ-বৃহত্তম তেলের ভাণ্ডার, এবং দ্বিতীয়-বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডারও।

সম্প্রতি দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে এক বিশাল তেলের খনি আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি রুহানি, যা থেকে উৎপন্ন হবে ৫৩ বিলিয়ন (৫,৩০০ কোটি) ব্যারেল তেল। উল্লেখ্য, এক ব্যারেল আন্দাজ ১৬০ লিটারের সমান। এই আবিষ্কার যদি নিশ্চিতরূপে হয়ে থাকে, তবে ইরান হয়ে যাবে বিশ্বের তৃতীয়-বৃহত্তম তেলের ভাণ্ডার।