Advertisment

ইরম শর্মিলা ও তাঁর আফস্পা বিরোধী সংগ্রাম

মাদার্স ডে-র দিন বেঙ্গালুরুতে মা হয়েছেন মণিপুরের লৌহমানবী ইরম শর্মিলা। যমজ সন্তানের জন্মদাত্রী শর্মিলার ফেলে আসা জীবন ও তাঁর লড়াইয়ের ইতিহাস এক নজরে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Irom Sharmila

বেঙ্গালুরুর ক্লাউডনাইন হাসপাতালে যমজ কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন ইরম শর্মিলা

মণিপুরের লৌহমানবী হিসেবে খ্যাত ইরম শর্মিলা রবিবার যমজ কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। দুজনের নাম রাখা হয়েছে নিক্স সাক্ষী এবং অটাম তারা। মণিপুরে গত ৬০ বছর ধরে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা) প্রত্যাহারের দাবিতে ১৬ বছর ধরে অনশন চালানোর জন্য সবিশেষ খ্যাত। তিনি জানিয়েছে এই দুই কন্যার জন্ম তাঁর জীবনের এক নতুন শুরু।

Advertisment

*  ইরম শর্মিলা কে এবং আফস্পার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইটা ঠিক কী?

মণিপুরের রাজধানী ইমফলের মধ্যবিত্ত মেইতেই পরিবারে জন্মেছিলেন ইরম শর্মিলা। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে ছোট। একেবারেই সাধারণ এক মহিলা ছিলেন তিনি। মণিপুরে যে সময়ে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে যুদ্ধপরিস্থিতি, নির্বিচারে খুন হচ্ছে চারদিকে, সে সময়েই অ্যাক্টিভিজমের জগতে প্রবেশ তাঁর। ২০০০ সালের নভেম্বরে, ইরমের যখন ২৮ বছর বয়স, তখন ইম্ফলের তুলিহাল বিমানবন্দরের কাছে মোলোম মাখা লেইকাই এলাকায় গুলিতে মৃত্যু হয় ১০ জন নাগরিকের। এ ঘটনায় অভিযোগের আঙুল ওঠে অষ্টম আসাম রাইফেলসের দিকে। এ ঘটনা মালোম ম্যাসাকার নামে কুখ্যাত। মালোমের এই নৃশংস কাণ্ডের প্রতিবাদেই অনশন শুরু করেন ইরম শর্মিলা, যে অনশন পরবর্তীকালে চালিত হয় আফস্পার বিরুদ্ধে।

তিনদিন অনশন চালানোর পর ইরম শর্মিলাকে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর পর ১৬ বছর তিনি কাটান পুলিশ হেফাজতে, অনশনরত অবস্থাতেই। এই পর্যায়ে তাঁকে রাইলস টিউবের মাধ্যমে জোর করে খাওয়ানো হত।

* আফস্পা ও মণিপুর

১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আফস্পা। এই আইন বলে ভারতের সশস্ত্রবাহিনী উপদ্রুত এলাকায় বিশেষ অধিকার লাভ করে। সম্প্রতি আফস্পা বলবৎ রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর, আসাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল প্রদেশ ও মণিপুরের কিছু অংশে।

এই আইনবলে, সশস্ত্র বাহিনী গুলি চালাতে পারে, কোনও পরওয়ানা ছাড়াই কোথাও প্রবেশ করতে পারে, তল্লাশি চালাতে পারে এবং বিচারযোগ্য অপরাধ করেছে এমন কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করতে পারে। এসবের জন্য বাহিনীর কোনও বিচার হবে না।

এই আইনের সমালোচকদের মতে, এর ফলে নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিচার হত্যার অধিকার পেয়ে যায়। মণিপুরে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে, যার নাম EEVFAM। নির্বিচারে শাস্তিপ্রাপ্তদের পরিবারদের নিয়ে গঠিত এই সংগঠন ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে অভিযোগ করে ১৯৮০ সাল থেকে সে সময় পর্যন্ত মোট ১৫২৮ জন নিহত হয়েছেন ষুধু এই আইন বলবৎ থাকার ফলে। এ বছর ধরলে মণিপুরে আফস্পা বলবৎ রয়েছে ৬১ বছর ধরে।

* ইরম শর্মিলা তাঁর অনশন প্রত্যাহার করলেন কেন?

২০১৬ সালের ৯ অগাস্ট অনশন প্রত্যাহার করেন ইরম শর্মিলা। এ সিদ্ধান্তের পিছনে দুটি কারণ দেখিয়েছিলেন তিনি। প্রথমত, তাঁর অনশনের প্রায় কোনও প্রভাবই সরকারের উপর পড়েনি। তাঁর অনশনও চলেছে, চলেছে আফস্পাও, এবং সরকারের তরফ থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। ইরম বলেছিলেন, যদি তিনি বোধ করেন তাহলে ভিন্ন পথ গ্রহণ করবেন তিনি। এরপর তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মণিপুর থেকে আফস্পা প্রত্য়াহারই ছিল তাঁর ভোটের ইস্যু।

ইরম শর্মিলার উপর প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর প্রেমিক ডেসমন্ড কুটিনহো-ও। ডেসমন্ড ব্রিটিশ নাগরিক, গোয়ার বাসিন্দা। দুজনের সাক্ষাৎ হত আদালতে ইরম শর্মিলার পেশের সময়ে, অল্প সময়ের জন্য। শুধু চিঠির মাধ্যমেই তাঁদের সম্পর্ক চলেছিল বছরের পর বছর ধরে। ইরম ও কুটিনহোর সম্পর্কের বিরুদ্ধে ছিলেন ইরমের পরিবার এবং মণিপুরের বহু মানুষ। ইরম শর্মিলা জানিয়েছিলেন, প্রেমিককে বিয়ে করতে আকাঙ্ক্ষাও তাঁর অনশন ধর্মঘট শেষ করার একটা কারণ।

* ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে কী হল?

ইরম শর্মিলা এবং হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্য়াজুয়েট আরনের্দে লিচোমবাম মিলে একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন, নাম- পিপলস রিসার্জেন্স অ্যান্ড জাস্টিস অ্যালায়েন্স (PRJA)।  দলের তরফ তেকে মণিপুরের পাঁচটি আসনে প্রার্থী দেওয়া হয়। ইরম নিজে দাঁড়ান মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবোবি সিংয়ের বিরুদ্ধে।

ইরম খুব খারাপ ভাবে হেরে যান, পান মাত্র ৯০টি ভোট। হেরে যান তাঁর দলের পাঁচজন প্রার্থীও। এই এলাকার ভোটাররা বলেছিলেন, যে তাঁরা শর্মিলাকে বোনের মত ভালবাসেন, কিন্তু শর্মিলার নির্বাচনী রাজনীতিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত তাঁরা মেনে নিতে পারেননি।

ইরম শর্মিলার নিজের কাছে এই নির্বাচন শুধু এ কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না যে তিনি ভোটে লড়েছিলেন, একই সঙ্গে তিনি ২০ বছর পর নিজে ভোট দিচ্ছিলেন। নিজের মানুষদের কাছে প্রত্যাখ্য়াত হওয়ার পর নির্বাচনী রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান তিনি, একই সঙ্গে ছেড়ে দেন নিজের রাজ্যও। ভোটের কিছুদিন পরই প্রেমিক ডেসমন্ড কুটিনহোকে বিয়ে করেন তিনি। আর অন্যদিকে মণিপুরে কোনওরকম অস্তিত্বই ছিল না য়াদের, সেই বিজেপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবার সে রাজ্যে সরকার গঠন করে।

* এখন ইরম শর্মিলা কোথায়?

ভোটের ফলের পর অপমানিত এবং বিষণ্ণ চিত্তে মণিপুর ছাড়েন ইরম শর্মিলা। গতবছর বেঙ্গালুরুতে চলে আসার আগে পর্যন্ত তিনি থাকতেন কোডাইকানালে।

* ইরম শর্মিলার প্রস্থানের পর কী অবস্থায় রয়েছে আফস্পা-বিরোধী আন্দোলন?

ইরম শর্মিলা মণিপুর ছাড়ার পরে সে রাজ্যে আফস্পা বিরোধী আন্দোলনে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আন্দোলন চললেও, লোকসভা ভোটে সে নিয়ে খুব কথা হয়নি। মণিপুর তথা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের আফস্পা বিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে পরিচিত মুখ ছিলেন তিনি, এমনকী আন্তর্জাতিক স্তরেও।

সমাজকর্মীদের বলছেন, মণিপুরে ১৫২৮টি ভুয়ো সংঘর্ষের মামলায় শীর্ষ আদালতের যে পর্যবেক্ষণ, তার ফলে বাধাহীন ভাবে চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারবে না নিরাপত্তা বাহিনী। এর ফলে নির্বিচার হত্যা এবং নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে নাগরিকদের নিত্য দিনের হেনস্থার পরিমাণও কমে এসেছে। মণিপুর থেকে ইপম শর্মিলা চলে যাওয়ার পরই ঘটনাক্রমে শীর্ষ আদালতের তদন্ত এবং রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা হ্রাস হয়েছে। এ ইস্যু ঘিরে মণিপুরের মানুষের আবেগসঞ্জাত জমায়েতের সংখ্যাও কমেছে।

Read the Story in English

Advertisment