ইশরাত জাহান হত্যার পর ১৫ বছর কেটে গেছে। অভিযোগ, ভুয়ো সংঘর্ষে এই তরুণীর মৃত্যু ঘটেছিল। এ ঘটনায় দুই প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক ডি জি বানজারা এবং এন কে আমিনকে মুক্তি দিয়েছে আমেদবাদের বিশেষ সিবিআই আদালত। ২০০১৪ সালের ১৫ জুন আমেদাবাদের শহরতলিতে এই ঘটনা ঘটে। ঘটনায় মূল অভিযুক্ত বানজারা সে সময়ে আমেদাবারে ডিটেকশন অফ ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডিসিপি ছিলেন। এন কে আমি ছিলেন ওই বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার।
কেন এঁদের মুক্তি দেওয়া হল?
কোনও সরকারি চাকুরে যদি কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারানুসারে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। গুজরাট সরকার সে অনুমোদন দিতে অস্বীকার করেছে। প্রধানত সে কারণেই এই মুক্তি।
২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই মামলায় অভিযুক্ত চার আইবি অফিসারের ব্যাপারে এ সংক্রান্ত অনুমোদন দিতে অস্বীকার করে। এঁরাও এ মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন এবং সে মামলা চলছে মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে।
সংঘর্ষ এবং তার পর
সেদিন ভোরে বানজারার নেতৃত্বে ডিটেকশন অফ ক্রাইম ব্রাঞ্চ ইশরাত এবং আরও তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ। গুজরাট পুলিশের দাবি তারা গোয়েন্দা বিভাগ থেকে খবর পেয়েছিল ওই তিনজন গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যা করতে এসেছিল। এদের মধ্যে দুজন ছিল পাকিস্তানি নাগরিক। আমেদাবাদ সিটি ক্রাইম ব্রাঞ্চ সেদিন যে এফআইআর দায়ের করেছিল, তাতে ইশরাতের পরিচয় দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল একজন মহিলা জঙ্গি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিল।
২০০৬ সালে ইশরাতের মা শামিমা কাইজার গুজরাট হাইকোর্টে একটি পিটিশন ফাইল করেন। এই ভুয়ো হত্যা মামলায় সিবিআই তদন্ত দাবি করেন তিনি। এক বছর পর অন্য একটি সংঘর্ষের মামলায় গ্রেফতার করা হয় বানজারাকে। সে ঘটনায় সোহরাবুদ্দিন শেখকে হত্যা করা হয়েছিল।
গত ১৫ বছরে তদন্ত ও মামলা কী ভাবে এগোল?
হাই কোর্ট নিযুক্ত বিশেষ তদন্ত দল এবং সিবিআই দুপক্ষই তাদের তদন্তে জানায় এই সংঘর্ষ ভুয়ো। সিবিআই এ ব্যাপারে গুজরাট পুলিশ এবং ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ, এই দু পক্ষকেই এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে।
প্রথম বার এ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয় ২০০৯ সালে, যখন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস পি তামাং এ সংঘর্ষ ভুয়ো ছিল এবং শুধুমাত্র পুরস্কার ও পদোন্নতির জন্য এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল।
২০০৯ সালের অগাস্ট মাসে কেন্দ্র একটি হলফনামা দাখিল করে। যাতে ইশরাতকে লশকর এ তৈবা জঙ্গি হিসেবে দেখানো হয়। এ ব্য়াপারে একটি লশকর এ তৈবার মুখপত্রের অতিরঞ্জিত রিপোর্ট উদ্ধৃত করে কেন্দ্র, যে রিপোর্টে ইশরাতে সদস্যপদ স্বীকৃতির কথা উল্লিখিত ছিল। কেন্দ্র অবশ্য একমাসের মধ্যেই সে রিপোর্ট প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু ২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক মুখপাত্র দাবি করেন, তাঁকেজোর করে দ্বিতীয় রিপোর্ট লেখানো হয়েছিল, যে রিপোর্ট থেকে লশকর জঙ্গি যোগাযোগের কথা মুছে ফেলা হয়েছিল। ওই আধিকারিক বলেন, হাইকোর্ট নিযুক্ত বিশেষ তদন্ত দলের সদস্য আইপিএস অফিসার সতীশ শর্মা তাঁর ওপর অত্যাচার চালিয়ে দ্বিতীয় রিপোর্ট দিতে বাধ্য করেন।
সিবিআই তাদের চার্জশিটে ২০ জন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে হত্যা ও অপরাধমূল ষড়যন্ত্র এবং অস্ত্র আইনে অভিযোগ আনে। এদের মধ্যে ছিল গুজরাটের ডিজিপি কেআর কৌশিকের নামও। চার্জশিট ফাইল করা হয় গুজরাট পুলিশের ৮ অফিসারের বিরুদ্ধে। বানজারা এবং আমিন ছাড়া অন্য যাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল, তাঁরা হলেন, পিপি পাণ্ডে (গুজরাট পুলিশের প্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত), জিএল সিংহল, তরুণ বারোট, অনুজ চৌধরি, জেজি পারমার, এবং মোগন কালাসভা (২০০৭ সালে মৃত)। এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল হত্যা, অপহরণ, প্রমাণ লোপাট ও অন্যান্য অভিযোগে। এ ছাড়া চারজন আইবি আধিকারিক - অবসরপ্রাপ্ত স্পেশাল ডিরেক্টর রাজিন্দর কুমার (সংঘর্ষের সময়ে চিনি গুজরাটের এসআইবি-র জয়েন্ট ডিরেক্টর ছিলেন), টি মিত্তল, এম কে সিনহা এবং রাজীব ওয়াংখাড়ের বিরুদ্ধে। এঁদের বিরুদ্ধে অপহরণ এবং ভুয়ো সংঘর্ষে মৃত চারজনকে বেআইনিভাবে আটক রাখার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এঁদের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি দেয়নি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
মামলার কার্যপদ্ধতি কীভাবে সমালোচনার মুখে পড়ল?
বানজারা এবং আমিনের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর জন্য আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল তাঁদের ভূমিকা এ মামলায় ডিজিপি পিপি পাণ্ডের চেয়ে বৃহত্তর। ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে আদালত এই দুজনের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দেয়। তার আগে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই পিপি পাণ্ডেকে মুক্তি দেওয়া হয়। কৌসেরের কৌঁশুলি এ বিষয়ের উল্লেখের সঙ্গেই পুলিশি সংঘর্ষকে সরকারি কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত বলে সংজ্ঞায়িত করার বিরুদ্ধে সওয়াল করেন।
পাণ্ডেকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল কারণ প্রধান সাক্ষীরা পরস্পরবিরোধী বিবৃতি দিয়েছিলেন, এবং সিবিআই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চালানোর জন্য আগে থেকে অনুমতি চায়নি। বানজারা এবং আমিনকে খালাস করার আর্জি প্রত্যাখ্যান করে আদালত। একই সঙ্গে তারা সিবিআইকে জিজ্ঞাসা করে এই দুজনের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর প্রয়োজনীয় অনুমতি তারা সংগ্রহ করতে পারবে কিনা। সিবিআই তা করেওছিল।
খালাস করার বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধির ২২৭ নং ধারার সঙ্গে যুক্ত। ওই ধারায় বলা হয়েছে, মামলার তথ্যপ্রমাণ বিবেচনা করে এবং দু পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারক যদি মনে করেন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট ভিত্তি নেই, সে ক্ষেত্রে তিনি অভিযুক্তকে খালাস করতে পারেন এবং কৃতকর্ম সম্পর্কে তার বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে পারেন। নতুন কোনও তথ্য প্রমাণ যেহেতু আর হাজির করার নেই, সেক্ষেত্রে সিবিআই বা ইশরাতের পরিবার যদি উচ্চকর আদালতের শরণাপন্ন হয়, তাহলে আদালত ২২৭ ধারা কীভাবে বিবেচনা করছে, তার উপরেই বিষয়টি স্থির হবে।
অভিযুক্ত অন্য পুলিশকর্মীদের কী হবে?
আরও চারজন পুলিশকর্মী জামিনে মুক্ত রয়েছেন এবং তাঁদের পুনর্বহাল করা হয়েছে। এদের মধ্যে কারো কারো ফের বিচার হবে। এই চারজন হলেন জিএল সিংহল, তরুণ বারোট, অনুজ চৌধরি, জেজি পারমার। এবার এঁদের বিচার হবে বিশেষ সিবিআই আদালতে। এ বছরই সিংহলের পদোন্নতি হয়েছে এবং এখন তিনি গান্ধীনগরে কম্যান্ডো ট্রেনিং সেন্টারের শীর্ষপদে রয়েছেন। যদি এঁরাও অভিযোগমুক্তির আবেদন জানান, তাহলে বানজারা ও আমিনের মতই একই পথে যাবে মামলা। যদি তাঁরা খালাসের আবেদন না করেন, তাগলে আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করবে।
বৃহস্পতিবারের আদালতের রায়ের অর্থ কি ইশরাত জাহান মামলার পরিসমাপ্তি?
না। শামিমা কৌসের বা সিবিআই বৃহস্পতিবার সিবিআই আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চতর আদালতে যেতে পারেন। সিবিআই-এর ক্ষেত্রে আবেদনের সময়সীমা ৬০ দিন, শামিমাদের পক্ষে ৯০ দিন। শামিমার আইনজীবী জানিয়েছেন তাঁরা রায় হাতে পাওয়ার পর গুজরাট হাইকোর্টে আবেদনের পরিকল্পনা করবেন। ইতিমধ্যে অন্য অভিযুক্ত যাঁরা জামিনে বাইরে রয়েছেন তাঁরা সমমর্যাদার ভিত্তিতে খালাসের আবেদন করতে পারেন।
বানজারা এবং আমিন অন্য যে সংঘর্ষ মামলায় অভিযুক্ত সেগুলির হাল কী?
শোহরাবুদ্দিন শেখ ও তুলসীরাম প্রজাপতি সংঘর্ষ মামলায় খালাস পেয়ে গিয়েছেন বানজারা। সেহরাবুদ্দিন মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন এন কে আমিন। তিনিও ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন।