কাবুলে গত ২৫ মার্চ এক গুরদোয়ারায় আত্মঘাতী হামলায় বেশ কয়েকজন শিখের মৃত্যুর পর দয়েশ (আইসিস) দাবি করেছে ভারতীয়দের উপর আফগানিস্তানে এই তাদের দ্বিতীয় হামলা। একমাত্র হামলাবাজের নাম আবু খালিদ আল হিন্দি (কেরালার মহম্মদ মহসিন, যে ২০১৮ সালে উপসাগের গিয়েছিল)। আইসিস একে কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য প্রতিশোধ আখ্যা দিয়েছে।
এর পরেই আফগান নিরাপত্তা বাহিনী আইএসকেপি বা ইসলামিক স্টেট খুরাশান প্রভিন্স (আফগানিস্তান পাকিস্তানে আইসিস শাখা)-এর আমির ও অন্যান্য কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। আমিরের নাম আসলাম ফারুকি অখুনজাদা, যে পাকিস্তানের লোক। ধৃতদের মধ্যে রয়েছে কাশ্মীরি জঙ্গি আইজাজ আহানগর, যে দুদশক ধরে ওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছে। আইএসকেপি গত ৪ মে তাদের হেফাজতে থাকা এক আফগান আধিকারিকের মুণ্ডচ্ছেদের ছবি ও ভিডিও পোস্ট করে। আফগান তালিবানরা আসলামকে আফগানিস্তান সরকারের চর বলে অভিহিত করেছে, কিন্তু তার ওই এলাকায় যোগাযোগ আইসিসের জন্মের আগে থেকেই রয়েছে। এই ঘটনাশৃ্ঙ্খল ওই এলাকায় আইএসকেপি-র বিপদ সম্পর্কে খুঁটিয়ে দেখার দাবি রাখে।
ভারতে রাসায়নিক দুর্ঘটনা বিষয়ে কী ধরনের সুরক্ষাকবচ রয়েছে?
আইসিস ও তালিবান
২০১৯ সালের ২৩ মার্চ ক্যালিফেটের পতনের একমাসের কম সময়ে আগে আইসিস শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ আঘাত হানে। ২০২০ সালের মার্তে কাবুলে এক উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সমাবেশে আইসিস মর্টার হামলা করে। সেটা ছিল প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানির উদ্বোধন অনুষ্ঠান। এ ছাড়া বাগরামে মার্কিন ঘাঁটির উপর দুবার হামলা চালায় তারা। ২৫ মার্চের হামলা কি তাহলে তাদের বার্ষিক উদযাপন হামলা?
আইসিস কি স্থানীয় উগ্র গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে শত্রুদের টার্গেট করছে, যেমনটা তারা করেছিল ২০১৬ সালের ঢাকার বেকারি হামলা বা ২০১৯ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার হামলায়? যে দেশে আইসিসের টার্গেট মাত্রই কয়েকটা, সেখানে অতিক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের উপর হামলার কারণ অবশ্যই কৌতূহল উদ্রেককারী।
তার ওপর সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে মার্কিন-তালিবান চুক্তির পর তালিবানরা দাবি করে এসেছে তারা আফগানিস্তানে আইএসকেপি-কে নির্মূল করে দিয়েছে। সাপ্তাহিক আল নাভা পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় এই চুক্তির বিরোধিতা করে আইসিস তাদের সমর্থকদের এই সময়ে শত্রুদের উপর হামলা করতে বলেছে, কারণ এই শত্রুদের সম্পদ এখন কোভিড মোকাবিলায় ব্যস্ত। গত কয়েক সপ্তাহে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন হামলার খবর এসেছে। ফলে গুরদোয়ারায় হামলা একটু আশ্চর্যজনক।
তার উপর একজন বিদেশি যোদ্ধার উপর নির্ভর করার দাবি, মোডাস অপারেন্ডি এবং প্রচারে দুর্বলতা- এর কোনও কিছুই আইসিস সুলভ নয়। তবে আইএসকেপি-র এই হামলার দায়িত্ব নেওয়া ক্যালিফেট পরবর্তী কৌশলের একটা সম্ভাব্য বদল হতে পারে।
আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান ও মধ্য এশিয়ার অংশ নিয়ে তৈরি উইলায়াত খুরাসানের ধারণা তৈরি হয়েছিল ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে, যে সময়ে আইসিস হাফিজ সঈদ নামে এক প্রাক্তন তেহরিক এ তালিবান (TTP) কম্যান্ডারকে ওয়ালি ও আব্দুল রউফ নামে এক রাউফ নামে এক বিক্ষুব্ধ আফগান তালিবান কম্যান্ডারকে সহ ওয়ালির পদে নিযুক্ত করে।
নর্দমার জল থেকে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কার কথা বলছেন গবেষকরা
২০১৩ সালে TTP আমির হাকিমুল্লার ড্রোন হামলায় মৃত্যুর পর হাফিজ সআদ এবং TTP মুখপাত্র শেখ মকবুল TTP থেকে মুখ ফেরাতে থাকে আইএসআইয়ের দিকে। টিটিপির মধ্যে মেহসুদেদের অন্তর্গত ঝামেলার জেরে আমির হিসেবে উঠে আসে মোল্লা ফজলুল্লা, যার জেরে বেশ কিছু কম্যান্ডার বেরিয়ে যায়, আইএসআই যাদের আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো শুরু করে।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে হাফিজ সঈদ এবং শেখ মকবুল হঠাৎই আইসিসেসর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। সে সময়ে আইসিসের ভাবধারা পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল, আফগানিস্তানে তত নয়।
সে সময়ে অনলাইনে প্রচার এবং বিদেশ থেকে লোকনিয়োগের উদ্যোগও নেওয়া হয়, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মধ্য এশিয়া থেকে। তবে পাকিস্তান ছাড়া অন্যত্র বিশেষ সাড়া মেলেনি। কাশ্মীর থেকে উঠে এসেছিল দুজন, আবু উসমান আল কাশ্মীরি, এবং হুজাইফা ওল বাকিস্তানি, যে ননগরহারে নিহত হয়েছে বলে খবর।
অল্প সময়ের মধ্যেই আইএসকেপি-র স্থানীয় যোদ্ধারা শক্তিশালী তালিবানদের ননগরহার থেকে হঠিয়ে দেয়। এই সময়ে নিজেদের নিরাপত্তার জন্যেই কঠোরভাবে সীমানা দিয়ে যাতায়াত ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছিল পাকিস্তান।
ক্ষুদ্র একটা এলাকা থেকে আইএসকেপি-কে সরাতে প্রায় পাঁচ বছর সময় লেগেছে। কুনার প্রদেশে আইএসকেপির কিছু অংশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, অন্যদিকে পাকিস্তান বছরের পর বছর ধরে অভিযোগ করে এসেছে সেখানে টিটিপি ও জামাক উল আহরারের ঘাঁটি রয়েছে। আইএসকেপির ভৌগোলিক বিস্তার, তাদের হিসেব করা এবং বড় হামলা (যা তালিবানরা সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করে এসেছে), এবং তালিবানদের সঙ্গে প্রায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চোখে পড়তে বাধ্য।
আইএসকেপি-র চারজন আমির নিহত এবং পঞ্চমজন এখন গ্রেফতার হয়েছে। এই গোষ্ঠী আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কাবুল ও কোয়েটায় কয়েকটি বড় হামলার দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া নিজেদের এলাকা বা প্রভাববৃদ্ধির কোনও চেষ্টাও তারা করেনি। ক্যালিফেট পরবর্তী সময়ে স্থানীয় বিদেশি যোদ্ধাদের নিয়োগের খবরও তেমন নেই। সব মিলিয়ে আঞ্চলিক স্তরে এদের প্রভাব অতি সীমিত।
আসলাম ফারুকি পাকিস্তানের জনজাতি এলাকার প্রথম পাশতুন কম্যান্ডার। মৌলবি নাজির এবং হাফিজ গুল বাহাদুরের সঙ্গে মিলে তারা তালিবানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মার্কিন ISAF বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যার মিছনে মদত ছিল পাক সামরিক বাহিনীর। এসব ২০০১ সালের অক্টোবরের কথা। টিটিপি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতাদের সেই অন্যতম, যারা পাকিস্তান সেনার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। তবে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আসলাম ফারুকি পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি করে বলে খবর। পাকিস্তানে এরকম চুক্তির ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, এক্ষেত্রেও তাই ঘটে। প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা অস্বীকার করা হয়।
এই এলাকার সংকেত
অনেকেই মনে করেন ১০০-র বেশি ভারতীয় ক্যালিফেটে চলে গিয়েছেন। একই সঙ্গে জানা গিয়েছে কেরালা থেকে মহিলা ও শিশুসহ একটি দল ২০১৬-১৭ নাগাদ কেরালা থেকে আফগানিস্তানে চলে যায়।
কিছু শিশুর জন্মও হয় সেখানে। মনে করা হয় ননগরহারে আইএসকেপি অধ্যুষিত এলাকায় ৬০ জনেরও বেশি ভারতীয়ের বাস। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আএসকেপি-র ১৪০০ জনেরও বেশি আফগান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এদের মধ্যে যোদ্ধারা ছিল, ছিল তাদের পরিবারের লোকজনও।
আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারেতর যোদ্ধারাও ছিল। ওই গোষ্ঠীতে ছিলেন কিছু ভারতীয় মহিলা ও শিশু। কিছু ভারতীয় যোদ্ধা নিহত হয়েছেন বলে জানা গেলেও তার কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি, কয়েকজন এখনও নিখোঁজ। মহসিন সামনে আসায় মনে করা হচ্ছে আরও কিছু ভারতীয় আইএসকেপি-তে যোগ দিয়ে থাকতে পারে।
সম্প্রতি ইসলামিক স্টেট হিন্দ প্রভিন্স (ISHP) বা ইসলামিক স্টেট কাশ্মীরের (IS-K) মত কিছু অনলাইন অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটেছে, যাদের উদ্দেশ্য প্রচার ও ভারতীয়দের নিয়োগ করা বা কিছু আঞ্চলিক স্তরের যোদ্ধা নিয়োগ করা যারা ভারতীয় সম্পত্তির উপর হামলা করবে।
ISHP ও IS-K-র সঙ্গে আইএসকেপির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। মার্চের প্রথমে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল এক কাশ্মীরি দম্পতিকে গ্রেফতার করে যাদের যোগাযোগ রয়েছে ISHP/IS-K র সঙ্গে। এই গ্রেফতারি ভারতীয়দের মধ্যে জল মাপার একটা প্রচেষ্টা হতে পারেয় যে ব্যক্তিগত ক্ষোভের জায়গা থেকে যারা আইসিসের নামে উগ্রপন্থার আশ্রয় নিয়ে দিল্লি বা অন্যত্র হামলার চেষ্টা করবে।
ISKP/ISHP/IS-K-র উৎস জানা না গেলেও তারা ঝুঁকি তৈরি করেছে তার পরিমাণ কমে না। আইসিস যেহেতু এখন প্রায় সব হামলারই দায়িত্ব নিচ্ছে, ফলে এই সব গোষ্ঠীগুলি প্রচার ও নিয়োগের জন্য হাতের কাছে মঞ্চ প্রস্তুত রাখছে।
এ ছাড়া কোভিড-১৯ পর্যায়ে আইসিস সাইবারস্পেসে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আইএসকেপি নেটওয়ার্কের মত সংগঠনগুলির হামলার দায় তারা খুশিমনে স্বীকার করে নিচ্ছে এবং এদের দ্বারা এই এলাকায় কীধরনের হামলা ঘটানো সম্ভব তাও মেপে নিচ্ছে। ফলে উগ্রপন্থা শান্ত করার সঙ্গে ভারতে ও পশ্চিমে কী ধরনের ঝুঁকি বাড়ছে, সে ব্যাপারেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
(অঞ্জু গুপ্তা আইপিএস অফিসার, মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন