সোমবার ৪৩ বছরের মনু শর্মা জেল থেকে মুক্তি পেল। ১৯৯৯ সালে মডেল জেসিকা লাল হত্যায় অপরাধী মনুকে মেয়াদের আগে মুক্তি দেওয়ার সুপারিশ করে শাস্তি পর্যালোচনাকারী বোর্ড। তাতে সম্মতি দেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর। হত্যাকাণ্ড ও তার বিচারপ্রক্রিয়া নানারকম দিকবদল ঘটেছে। একবার সেগুলি দেখে নেওয়া যাক।
হত্যা ও গ্রেফতারি
১৯৯৯ সালের ২৯ এপ্রিল দিল্লির কুতুব কলোনেডে, সোশালাইট বীণা রামানির ওয়ান্স আপন এ টাইম রেস্তোরাঁয় জেসিকা লাল খুন হন। সে পার্টিতে জেসিকা লাল এবং অভিনেতা সায়ান মুন্সি মদ পরিবেশন করছিলেন।
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা হরিয়ানা কংগ্রেস নেতা বিনোদ শর্মার ছেসে মনু শর্মা ওই পার্টিতে বন্ধুদের সঙ্গে উপস্থিত ছিল। রাত দুটোর সময়ে মনুরা মদ চায়। তখন পার্টি শেষ হয়ে গিয়েছিল, ফলে তাদের আর মদ দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়। এর পর কথা কাটাকাটির সময়ে মনু পিস্তল বের করে ছাদে একটি গুলি চালায় এবং জেসিকা লালের উপর আরেকটি গুলি চালায়। গুলি লাগে জেসিকার বাঁ চোখের কাছে। মনু পালিয়ে যায়। ৩০ এপ্রিলের ভোর নাগাদ জেসিকাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
সায়ান মুন্সির বিবৃতির পর মেহরৌলি থানায় ভোর চারটে নাগাদ এফআইআর দায়ের করা হয়। পুলিশ দুটি খালি কার্তুজের খোল উদ্ধার করে, এবং পার্টি থেকে উধাও হওয়া একটি টাটা সাফারি গাড়ির খোঁজ পায়। ২ মে উত্তর প্রদেশ পুলিশ টাটা সাফারিটি আটক করে। তিন দিন পরে পুলিশ অমরদীপ সিং ওরফে টোনি গিল এবং অলোক খান্নাকে গ্রেফতার করে। এদের বিবৃতির পর পুলিশ মনু শর্মার আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। ৬ জুন মনু আত্মসমর্পণ করে। পুলিশ আরও ১০ জনকে গ্রেফতার করে, যাদের মধ্যে ছিল উত্তর প্রদেশের আরেক রাজনৈতিক নেতার ছেলে বিকাশ যাদবও।
জেসিকা লাল হত্যাকারী মনু শর্মার মুক্তি: কী কী ঘটেছিল এই মামলায়?
বিচার ও খালাস
৩ অগাস্ট চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২৩ নভেম্বর অতিরিক্ত দায়রা আদালত মনু শর্মার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ (হত্যা), ২০১ (অপরাধের প্রমাণ লোপাট বা অপরাধীকে আড়াল করার জন্য মিখ্যা তথ্য দেওয়া), ১২০ বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের শাস্তি) এবং অস্ত্র আইনের ২৭ নং ধারায় চার্জ গঠন করেন। ২০০১ সালের মে মাসে ৯ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। অভিযোগকারীদের তরফে ১০১ জন সাক্ষী ও দুজন আদালত সাক্ষীর বয়ান নেওয়া হয়।
বিচার চলাকালীন মনু বেশ কয়েকবার জামিন পায়। এরপর ২০০৩ সালের ১১ নভেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট তার জামিনের আবেদন নাকচ করে এবং সুপ্রিম কোর্টও তার বিশেষ লিভ পিটিশন নাকচ করে দেয়। এর পর মনু জামিন পায়নি।
২০০৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মনু ও অন্যান্য অভিযুক্তরা নিম্ন আদালতে খালাস পায়। নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত ছিল প্রমাণের শৃঙ্খল হয় হারিয়ে গিয়েছে নয়ত ভেঙে গিয়েছে। আদালত বলে এ ঘটনায় অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ করতে অভিযোগকারী সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
অভিযুক্ত পক্ষ দুই অস্ত্রের তত্ত্ব আনে। তারা বলে সায়ান মুন্সি বলেছিল দুটি আলাদা অস্ত্র থেকে দুজন গুলি চালিয়েছিল এবং তার বিবৃতিত তাকে পড়ে শোনানো হয়নি, কারণ বিবৃতি লেখা ছিল হিন্দিতে, যে ভাষা সে জানে না। আদালত বলেছিল সায়ান মুন্সি সহ অভিযোগকারী পক্ষের তিনজন সাক্ষী প্রত্যক্ষদর্শী নয়।
নিম্ন আদালত মেনে নিয়েছিল যে অভিযোগকারীরা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে যে মনুর কাছে .২২ বোরের ব্যারেটা পিস্তল ছিল এবং হরিয়ানা গান হাউস থেকে সে ২৫ রাউন্ড কার্তুজও এনেছিল, কিন্তু আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল পিস্তল মনুর কাছ থেকে উদ্ধার হয়নি।
লকডাউনে সত্যিই কত কোভিড মৃত্যু আটকানো গেল?
যে টাটা সাফারি গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছিল তা মেসার্স পিকাডিলি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেডের নামে ছিল এবং মনু তার ডিরেক্টরদের অন্যতম। আদালত এ কথা মানতে রাজি হয়নি যে অভিযুক্ত কুতুব কলোনেডে এই গাড়ি চড়ে গিয়েছিল। আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল পার্টিতে এই গাড়ির উপস্থিতি কিছুই প্রমাণ করে না।
আদালত এও বলেছিল অভিযুক্তরা ঘটনার আগে পরে টেলিফোনে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের ঘটনা থেকেও কিছু প্রমাণিত হয় না, যেহেতু কল রেকর্ড করা হয়নি।
মনু যে অপরাধের পরেই পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেছিল, সে কথাও মানতে রাজি হয়নি আদালত।
জনরোষ ও শাস্তি
মনুর খালাসের পর ব্যাপক জনরোষের সৃষ্টি হয়েছিল, যার পরে পুলিশ দিল্লি হাইকোর্টে একটি স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা দেয় যাআদালত গ্রহণ করে এবং ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার শুরু হয়। মনু শর্মার হয়ে দিল্লি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেছিলেন বর্তমানে প্রয়াত আইনজীবী রাম জেঠমালানি।
২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর হাইকোর্ট মনুকে অপরাধী ঘোষণা করে এবং একাধিক কারণ দর্শিয়ে নিম্ন আদালতের নির্দেশকে নস্যাৎ করে দেয়। আদালত মনুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়, বিকাশ যাদব ও অমরদীপ সিংকে তুলনামূলক কম শাস্তি দেয় ও ৬জনকে মুক্তি দেয়।
দুই অস্ত্রের তত্ত্ব দিল্লি হাইকোর্ট খারিজ করে দেয়। মনু সুপ্রিম কোর্টে দুবার আবেদন করে এবং ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট তার সাজা বহাল রাখে।
সুপ্রিম কোর্ট বলে এই ঘটনার প্রমাণাদি, সাক্ষীদের বয়ান, মনুর গাড়ি ও কার্তুজের সঙ্গে সংযোগ এবং ঘটনার পর তার আচরণ থেকে তার অপরাধ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়।
আরেকজন ভদ্রলোক গুলি চালিয়েছিলেন বলে সায়ান মুন্সির যে বিবৃ্তি, সে সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট বলে যে সায়ান বয়ান বদল করলেও প্রমাণিত হয় যে সে সময়ে মনু ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল এবং হাইকোর্ট এ ব্যাপারে যথাযথ। শপথ নিয়ে দায়রা আদালতে মিথ্যা বলার জন্য সায়ান মুন্সি অভিযুক্ত হয়।
এ মামলা থেকে যা গ্রহণীয়
এই মামলা সংবাদমাধ্যমের প্রভাবের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে। দিল্লি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট উভয় জায়গাতেই বিষয়টি উল্লিখিত হয়। সুপ্রিম কোর্ট বলে মুদ্রিত মাধ্যমে বিভিন্ন নিবন্ধ বিষয়টি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে যার জেরে অপরাধের ন্যায়বিচারের বিষয়টিতে প্রভাব পড়েছে।
মনু শর্মার খালাসের বিষয়টি খারিজ করে দিয়ে দিল্লি হাইকোর্ট আদালতের কাজকর্ম নিয়ে মন্তব্য করে। এর ফলে ক্ষমতাবান লোকজনকে আইনের আওতায় শাস্তির প্রসঙ্গে পক্ষপাতিত্ব নিয়ে জনগণের মধ্যু হুলুস্থূল পড়ে। সুপ্রিম কোর্ট বলে যাতে জনগণের আস্থা বজায় রাখা যায় সে সম্পর্কে সম্পর্কে সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
হাইকোর্টে শাস্তিদানের পর অন্য একটি বেঞ্চ সরকারকে সাক্ষী সুরক্ষা নীতি তৈরির নির্দেশ দেয়।