জুলিয়ান আসাঞ্জের নাম সর্বসমক্ষে আসে ২০১০ সালে। উইকিলিকস তখন হাজার হাজার কূটনৈতিক কেবল ও সামরিক তথ্য প্রকাশ করেছিল। সেসব নথি তাদের সরবরাহ করেছিলেন মার্কিন সেনাকর্মী চেলসি ম্যানিং। ফাঁস হওয়া নথির মধ্যে ছিল হাড় হিম করা একটি ভিডিও-ও, যাতে দেখা গিয়েছিল মার্কিন আপাচে হেলিকপ্টার ইরাকে রয়টার্সের দুই সাংবাদিক সহ ১২ জনকে গুলি করে মারছে।
ওই বছরই সুইডেন ঘোষণা করে যে তারা একটি ধর্ষণ ও নিগ্রহের ঘটনায় আসাঞ্জের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। দুই মহিলা এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে জানায় তারা। সে সময়ে ব্রিটেনের তারা আসাঞ্জের বিরুদ্ধে প্রত্যর্পণের পরোয়ানা জারিরও চেষ্টা করেছিল সুইডেন। সুইডিশ পরোওয়ানার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের জন্য ২০১১ সালে ব্রিটিশ আদালতের শরণাপন্ন হন আসাঞ্জ।আদালতের সিদ্ধান্ত তাঁর বিপক্ষে যায় এবং ২০১২ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টে আপিল মামলাতেও হেরে যান তিনি।
জামিন পাওয়ার পর লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন আসাঞ্জ। সে সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটির নেতৃত্বে ছিলেন বামপন্থী নেতা রাফায়েল কোরিয়া। ২০১২ সালের অগাস্ট মাসে তাঁর আশ্রয়ের আবেদনে সরকারি সাড়া মেলে। সে সময় থেকে এই গ্রেফতারি পর্যন্ত সময়কাল পর্যন্ত লন্ডনে অবস্থিত ইকুয়েডরের দূতাবাসেই বসবাস করছিলেন তিনি।
জামিন পেয়েও পালানোর অভিযোগে ২০১২ সালে ওয়েস্টমিনিস্টার ম্যাজিস্ট্রেটস কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে। ইকুয়েডর দূতাবাসের বাইরে বেরোনো মাত্র যাতে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, সে কথাও লেখা ছিল পরওয়ানায়। আসাঞ্জ পুরো সময় ধরেই বলে গিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো অভিযোগ আনা হয়েছে, এ সবই তাঁকে আমেরিকায় ফেরত পাঠানোর ছল। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রসংঘের একটি প্যানেল আসাঞ্জের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল এবং আসাঞ্জকে আটকে রাখার জন্য ব্রিটেন ও সুইডেনকে তিরস্কার করেছিল।
কে এই জুলিয়ান আসাঞ্জ?
দূতাবাসের মধ্যে থেকেও আসাঞ্জ তাঁর বিতর্কিত তদন্তমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে উইকিলিকস ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির বেশ কিছু ইমেল ফাঁস করে দেয়। এর ফলে অসুবিধের মুখে পড়েন প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টন, যিনি সে সময়ে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জোর লড়াই দিচ্ছিলেন। মার্কিন তদন্তকারীরা মনে করেন উইকিলিকস রাশিয়ান গোয়েন্দাবিভাগের সঙ্গে যোগসাজশেই তাদের কার্যকলাপ চালায়। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ঘটনাচক্রে জানাজানি হয় যে আমেরিকাও আসাঞ্জের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ আনার প্রক্রিয়া দ্রুততর করছে।
এরই মধ্যে, ইকুয়েডরে ২০১৭ সালের নির্বাচনে আসাঞ্জের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন কোরিয়াকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন লেনিন মনরো। মনরো পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে তুলনামূলক ভাবে ভাল সম্পর্ক রাখরা পক্ষপাতী। লন্ডনের দূতাবাসে আসাঞ্জের পরিস্থিতিও খারাপ হতে শুরু করে, তাঁর কাছে দেখা করতে আসা লোকজনের সংখ্যার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তাঁর ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে ব্রিটেনের সঙ্গে শত্রুতা কমাতে মনরো আসাঞ্জকে ইকুয়েডরের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে তাঁকে অপোক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় বসবাসের কথা বলেন। ব্রিটেন জানিয়ে দেয় তারা আসাঞ্জতে কোনওরকম কূটনৈতিক রক্ষাকবচ দেবে না।
গোটা পরিস্থিতিই পাল্টে যায় বৃহস্পতিবার। তিতিবিরক্ত ইকুয়েডর আসাঞ্জকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়। ২০১২ সালের পরওয়ানার ভিত্তিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে আটক করে। আমেরিকার প্রত্যর্পণের আবেদনের ভিত্তিতে তাঁকে ফের গ্রেফতারও করা হয়। ইকুয়েডরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কোরিয়া এ ঘটনাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে বর্ণনা করেছেন।
Read the Story in English