টুইটার এবং অন্যান্য সোশাল মিডিয়ায় একটি ফোটো প্রকাশিত হয়েছে, যার উপর B L A লেখা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে চারজন সশস্ত্র ব্যক্তি ছদ্মবেশে রয়েছে এবং তারা পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জে আত্মঘাতী হামলা করতে যাচ্ছে বলে ক্যাপশনে লেখা রয়েছে। বহুদর্শিত এ ছবিকে এই হামলার পিছনে নিজেদের হাত রয়েছে বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মির দাবি বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএলএ একটি বালোচ বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী, যার শীর্ষে রয়েছে ব্রিটেনে বসবাসকারী হায়িরবাইর মারি। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে ভারত বালোচ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের মদত দিচ্ছে, যে অভিযোগ ভারত কঠোরভাবে অস্বীকার করে আসছে। এই আন্দোলনের পিছনে আফগানদের হাত রয়েছে বলে তাদের দাবি।
ছবিতে যাদের দেখা যাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা গিয়েছে। এরা হল তাসলিম বালোচ ওরফে মুসলিম, শেহজাদ বালোচ ওরফে কোবরা, সালমান হাম্মাল ওরফে নোটাক, এবং সিরাজ কাঙ্গুর ওরফে যাগ্গি। এরা সকলেই বিএলএ-র মাজিদ ব্রিগেডের সদস্য, মাজিদ ব্রিগেডের নামকরণ হয়েছে বিএলএ কম্যান্ডার আব্দুল মজিদ বালোচের নামে।
সোমবারের হামলা পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জের গেটের সামনেই থমকে যায় বলে মনে করা হচ্ছে, সেখানেই চার জনকে গুলি করে মারে নিরাপত্তাবাহিনী। ঘটনায় একজন পুলিশ কর্মী ও দুজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। চার সশস্ত্র হামলাকারী কমপ্লেক্সে ঢোকার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড ছুড়েছিল। পাক মিডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে এদের ব্যাকপ্যাকে খাবার দাবার ও গুলিবারুদ ছিল, যা থেকে মনে হচ্ছে, এরা দীর্ঘক্ষণ অপারেশন চালানোর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল।
যদি সত্যিই এই হামলা বিএলএ-র হয়, তাহলে পাকিস্তানের বাণিজ্য রাজধানী তথা বৃহত্তম শহরে করাচিতে এ নিয়ে তাদের দ্বিতীয় হামলা। এই করাচিতেই পাকিস্তানের বৃহত্তম বন্দর অবস্থিত। করাচি সিন্ধ প্রদেশের রাজধানীও বটে। এর আগে করাচিতে জঙ্গি হামলা ঘটেছিল ২০১৮ সালের নভেম্বরে, যে সময়ে চিনা দূতাবাসে হামলা চালিয়ে বিএলএ চারজনকে হত্যা করে। এই চারজনের মধ্যে দুজন ছিলেন ভিসা আবেদনকারী ও দুজন পুলিশ কর্মী। তিন হামলাকারীকেই গুলি করে মেরেছিল নিরাপত্তাবাহিনী।
সোমবারের হামলাতেও একটা চিনা দৃষ্টিকোণ রয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পাক সংবাদপত্র জনের একটি রিপোর্ট অনুসারে, পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ ৪০ শতাংশ স্ট্র্যাটেজিক শেয়ার বিক্রি করেছিল একটি চিনা কনসোর্টিয়ামের কাছে, যাতে ছিল তিনটি চিনা এক্সচেঞ্জ - চায়না ফিনান্সিয়াল ফিউচার্স এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেড, শাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ, এবং শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জ- যারা ৩০ শতাংশ স্ট্র্যাটেজিক স্টক কিনেছিল এবং স্থানীয় দুই আর্থিক সংস্থা পাক-চায়না ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি ও হাবিব ব্যাঙ্ক, যারা কিনেছিল ৫ শতাংশ করে। মোট লেনদেনের মূল্য ছিল ৮৫ মিলিয়ন ডলার।
মজিদ ব্রিগেড বা বিএলএ-র পাক সরকার বা চিনাদের উপর অন্য হামলার ঘটনা ঘটেছে বালোচ প্রদেশে। ২০১১ সালে এই গোষ্ঠী আত্মঘাতী হামলা চালায় সরকারপন্থী বালোচ রাজনীতিবিদ নাসির মেঙ্গালের কোয়েটার বাড়িতে। সে ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে করাচির চিনা দূতাবাসে হামলার এক মাস আগে দালবানদিনে চিনা ইঞ্জিনিয়রদের একটি বাসে আত্মঘাতী হামলায় চিনা নৈগরিকরা আহত হন।
গত বছর টুইটার ও অন্যান্য সোশাল মিডিয়ায় প্রচারিত এক ভিডিওয় মজিদ ব্রিগেডের এক তথাকথিত সদস্যকে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বালোচিস্তান থেকে হাত ওঠানোর হুমকি দিতে শোনা যায়। সামরিক পোশাক পরিহিত, কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা ওই ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, এখনও সময় আছে, বালোচিস্তান ছাড়ো নয়ত বালোচের ছেলে মেয়েরা এমন শিক্ষা দেবে যে তুমি ভুলবে না।
গদরের এক পাঁচতারা হোটেলে মজিদ ব্রিগেডের হামলার পরেই ওই ভিডিও প্রকাশিত হয়। পাঁচতারা ওই হোটেলে সাধারণভাবে চিনা অতিথিরা এসে থাকেন। ওই হামলায় চার হোটেলকর্মী, এক সেনাকর্মী ও তিন হামলাকারীর মৃত্যু হয়।
ইউ টিউবে অন্য একটি ভিডিওয়, মজিদ ব্রিগেজের প্রাক্তন নেতা জেনারেল আসলাম বালোচ অভিযোগ করেন, চিনা সরকার বালোচদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য পাক নিরাপত্তবাহিনীকে সাহায্য করছে, তাদের নজরদারির সরঞ্জাম সরবরাহ করার মাধ্যমে। তিনি আরও অভিযোগ করেন চিনারা বালোচিস্তান উপকূলে মিলিটারি বেস বানাচ্ছে।
ভারতের প্রাক্তন পাক রাষ্ট্রদূত আবদুল বাসিতের নেতৃ পাকিস্তান ইনস্টিট্যুট অফ কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের তরফ থেকে মজিদ ব্রিগেড সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে এই গোষ্ঠীর ট্রেনিংয়ের ভিডিও থেকে মনে হচ্ছে এরা আফগানিস্তানে রয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিএলএ-র নেতৃত্বাধীন মজিদ ব্রিগেডের মূল কাজ চিনা স্বার্থের উপর হামলা।
বালোচিস্তানে গদর বন্দর বানাচ্ছে চিন যা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। চিন-পাক আর্থিক করিডোর শুরু হচ্ছে খুনজেরাব পাস দিয়ে, শেষ হচ্চে গদপে। মধ্যপ্রাচ্যের তৈলখনির সঙ্গে এটি চিনের সুপার হাইওয়ে বলে দেখা হচ্ছে।
বিএএ-র নেতা হিসেবে পরিচিত হায়ারবাইর মারি খৈর বকশ মারির পুত্র। খৈর ছিলেন বালোচের বৃহত্তম জনজাতি মারির প্রধান। পাক নিরাপত্তা বাহিনী তাঁকে পাকিস্তান বিরোধী জনজাতি অক্ষের অন্যতম প্রধান বসে মনে করে। অন্য প্রধানরা হলেন নবাব আকবর খান বুগতি ও সর্দার আতাউল্লা মেঙ্গল। খৈর ২০১৪ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন বালোচ জাতীয়তাবাদী, দীর্ঘদিন তিনি আফগানিস্তানে নির্বাসনে কাটিয়েছিলেন।
জঙ্গি বালোচ বিচ্ছিন্নতাবাদ কম ক্ষমতাসম্পন্ন গেরিলা যুদ্ধ গড়ে তুলেছে যা ১৯৭০-এর দশক ছাড়া আর কখনও জনপ্রিয়তা অর্জন করে ওঠেনি, তার মূল কারণ বালোচিস্তানের কম জনসংখ্যা। কোনও কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী বৃহত্তর বালোচিস্তানের দাবি করেছেন, যার মধ্যে ইরানের সিস্তান বালোচিস্তান প্রদেশও পড়ে।