Advertisment

বিশ্লেষণ: করাচির একদা ডন এবার মোদীর আশ্রয়প্রার্থী

ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সরকারের এক নালিশের ভিত্তিতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ২০১৬ সালে ভাষণের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদে উৎসাহ দেবার অভিযোগ দায়ের করে হুসেনের বিরুদ্ধে। সে বছরের জুন মাসে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

মুত্তাহিদ কোয়ামি মুভমেন্ট। পাকিস্তানের এ দল যখন তাদের তুঙ্গ পর্যায়ে ছিল, সে সময়ে তাদের দলীয় সদস্য এবং কর্মীরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সুশৃঙ্খল ভাবে সারি দিয়ে বসে থাকতেন। অপেক্ষা করতেন সংগঠনের নেতার জন্য। টাক মাথার চশমা পরা তাঁর ছবি সম্বলিত ব্যানার মঞ্চের উপর সাজানো থাকত। মুত্তাহিদ কোয়ামি মুভমেন্টের কেন্দ্রীয় কমিটি, যা রাবিতা কমিটি নামে পরিচিত, তার সদস্যরা মঞ্চের উপর একটি টেলিফোনের পাশে বসে অপেক্ষা করতেন।

Advertisment

যথাবিহিত মুহূর্তে মঞ্চের উপর থাকা কেউ একজন রিসিভার তুলে নিতেন, আলতাফ হুসেনের গলা গমগম করে ছড়িয়ে পড়ত মাইকের মধ্যে দিয়ে। হুসেন কথা বলতেন তাঁর লন্ডনের বাড়ি থেকে। দলের মধ্যে হিংসাত্মক সংঘর্ষের পর ১৯৯২ সালে তিনি সেখানে পালিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। শুধু দলের আভ্যন্তরীণ ঝামেলাই নয়, আশঙ্কা ছিল পাক মিলিটারি হানারও।

সেই আলতাফ হুসেন রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে নিজের ও তাঁর সতীর্থদের জন্য ভারতে আশ্রয় চেয়েছেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি ভারতে আশ্রয় চাইলেন। গত দু দশক ধরে হুসেনের উপস্থিতি দেখেও দেখেনি ব্রিটেন। কিন্তু ২০১৬ সালে করাচিতে হিংসা ছড়ানোর জন্য তাঁর টেলিফোনিক ভাষণকে দায়ী করে আলতাফ হুসেনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে ব্রিটেনের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনে।

সেদিন কী ঘটেছিল

দুটি মিডিয়া হাউস ভাঙচুর করা হয়েছিল সেদিন, করাচির রাস্তায় মারপিট ও লুঠতরাজের জেরে একজন নিহত ও অনেক আহত হন। হুসেন সেদিন তাঁর দলের কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন।  মুত্তাহিদ কোয়ামি মুভমেন্টকে দল হিসেবে মাফিয়াদের মত অপারেশন চালিয়ে থাকে এবং রাস্তায় খণ্ডযুদ্ধ করে- এরকমটাই তাদের পরিচয়। ২০১৩ সালে পাকিস্তান রেঞ্জার্সের এক অপারেশনের পর থেকে মুত্তাহিদ কোয়ামি মুভমেন্টের বেশ কিছু কর্মী নিখোঁজ হয়ে যান। সে ঘটনাকে অপরাধ বিরোধী অপারেশন বলে উল্লেখ করা হয়। হুসেন সেদিন যাঁদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাঁরা দলীয় সহকর্মীদের নিখোঁজ হওয়ার বিরুদ্ধে সবে অনশন শেষ করছিলেন।

হুসেন পাকিস্তানকে "সারা দুনিয়ার এক ক্যানসার" বলে বর্ণনা করেছিলেন সেদিন। বলেছিলেন "পাকিস্তান সারা পৃথিবীর মাথাব্যথার কারণ।" তিনি বলেছিলেন, "পাকিস্তান সারা পৃথিবীর সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্র। যারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে ... তারা পাকিস্তানের সঙ্গেই মরবে।" এর পর তিনি দুটি সংবাদ মাধ্যমের দফতের হামলা করার ইঙ্গিত দেন।

"তাহলে আপনারা এখানে থেকে এআরওয়াই এবং সামা (টিভি চ্যানেল)-য় যাচ্ছেন... তাই তো? তাহলে আপনারা সামা আর এআরওয়াইয়ে আজ যান, তারপর কাল রেঞ্জার্স প্লেসের জন্য তৈরি হোন। কাল আমরা সিন্ধ সেক্রেটারিয়েট নামক সিন্ধ সরকারের দফতর বন্ধ করে দেব।"

সেদিনের হিংসার জেরে পাকিস্তানি রাষ্ট্র এমকিউএমের উপর চূড়ান্ত দমন নীতি প্রয়োগ করে। এতদিনের ভয়ংকর পার্টি অফিস, যেখানে আন্ডারগ্রাউন্ড টর্চার চেম্বার রয়েছে বলে গুজব, সেই নাইন জিরো বন্ধ করে দেয় পাক রেঞ্জার্স। এ সংগঠনের তথা হুসেনের চার দশকের রাজনৈতিক জীবনের শেষের শুরু সেদিন থেকেই।

পরদিনই করাচির সমস্ত নেতারা তাঁদের নেতার বক্তব্য থেকে দূরত্ব অবসম্বন করেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এমকিউএম আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৮ সালের ভোটে তাদের থেকে ভেঙে বেরোনো পাকিস্তান সরজমিন পার্টি নিজেদের প্রার্থী দেয়। তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ছিল স্পষ্ট।

এম কিউ এম মাত্র সাতটি আসন পায় ভোটে। ২০১৩ সালে তারা জিতেছিল ১৮টি আসনে, ২০০৮ সালে জিতেছিল ২৫টি আসনে। পিএসপি কোনও আসন পায়নি।

ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সরকারের এক নালিশের ভিত্তিতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ২০১৬ সালে ভাষণের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদে উৎসাহ দেবার অভিযোগ দায়ের করে হুসেনের বিরুদ্ধে। সে বছরের জুন মাসে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এখন তিনি জামিনে মুক্ত রয়েছেন।

হুসেন ও তাঁর দল

হুসেন পাকিস্তানের রাজনৈতিক মানচিত্রে প্রবেশ করেন ছাত্র নেতা হিসেবে, ৭-এর দশকের মাঝামাঝি। অল পাকিস্তানের মোজাহির স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএমপিএমএসও)-র নেতা ছিলেন তিনি। যখন সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি জিয়া উল হকের সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-র পিছনে জড়ো হচ্ছে, সে সময়ে করাচি ও সিন্ধ প্রদেশের অন্য কিছু শহরে পিপিপি-র বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জই শুধ ছুড়ছিল না, বাড়ছিল আকারপ্রকারেও।

করাচিকে সিন্ধ থেকে আলাদা করে মোজাহির সভা তৈরি ছিল এপিএমএসও-র অন্যতম দাবি। উত্তর প্রদেশ, দিল্লি এবং ভারতের অন্যান্য এলাকা থেকে পাকিস্তানে যাঁরা উদ্বাস্তু হয়েছিলেন তাঁদের মোজাহির বলা হয়।

করাচির উর্দুভাষী মধ্যবিত্ত ও যুবদের মধ্যে এমকিউএমের জনপ্রিয়তা বাড়তেই নড়ে চড়ে বসে পাক সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলগুলি। পিপিপি এবং এমকিউএম সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়ে করাচির রাস্তায়। ৯-এর দশক জুড়ে এমকিউএম মিলিটারিদের টার্গেট হতে থাকে, যার জেরে হিংসাত্মক ও রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে অনেক।

এই সময়েই অভিযোগ ওঠে, এমকিএম বিচ্ছিন্নতাবাদী, ভারতের সংস্থা র-এর হয়ে তারা করাচিকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এমকিউএম-এর সদস্যদের ভারতীয় জাতিগত পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে তাঁদের দিকে কাদা ছোড়া হতে থাকে। সামরিক অপারেশন চলাকালীন কিছু নেতা ভারতে পালিয়ে আসার ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে সন্দেহ জোরদার হয়, মনে করা হয় তাঁরা ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে যোগ রেখে চলেছেন।

১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মুশারফ ক্যুয়ের মাধ্যমের পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর পটপরিবর্তন ঘটে। তিনি নিজে ছিলেন দিল্লির থেকে আগত মোহাজির এবং উর্দুভাষী। ২০০৭ সালে মুশারফ যাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন, দেশের সেই প্রধান বিচারপতিকে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য করাচিতে প্রবেশ করতে বাধা দেয় এমকিউ এম। এর জেরে হিংসাত্মক ঘটনায় ২০ জনেরও বেশি নিহত হন।

সে সময়ে এমকিউএম পাকিস্তানের একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিত। তারা করচির তালিবানায়নের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ করেছিল। আলতাফ হুসেন সে সময়েই প্রথমবার ভারতে আসেন, এবং তাঁগে ভারত-পাক শান্তিদূত হিসেবে আবাহন করা হয়। এমকিউএম রাজনীতিবিদ তথা করাচির সর্বকনিষ্ঠ মেয়র সৈয়দ মুস্তাফা কামাল শহরের উন্নয়নের জন্য তাঁর প্রচেষ্টার জন্য প্রশংসাবাক্য অর্জন করেন।

সব যখন শেষ, আঁকড়ানোর জন্য কেবল খড়কুটো

এমকিউএমের পতন শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহস থেকে মুশারফের বিদায়ের পর। লন্ডনের নিজের বাড়ির বাইরে খুন হন ইমরান ফারুক নামে দলের এক সিনিয়র নেতা। হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ হুসেনের বাড়ি ও অফিসে প্রচুর পরিমাণ টাকার খোঁজ পায়, যে ঘটনার জেরে শুরু হয় অর্থপাচার তদন্ত। হুসেনের সঙ্গে র-এর যোগসাজশ নিয়ে নতুন অভিযোগের কথা সম্প্রচার করে বিবিসি।

করাচিতে রেঞ্জার্স, সেনা এবং পাক গোয়েন্দাবাহিনী শুরু করে অপরাধবিরোধী অভিযান। এমকিউএমের অভিযোগ তাদের দলে ভাঙন ধরাতে এবং শহরে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব শেষ করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

এর পর দলে একাধিকবার ভাঙন ধরে। হুসেন নেহাৎই ভ্রমবশত বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে পারবেন, ২০১৬ সালে হিংসাউদ্রেককারী ভাষণ সে পরিকল্পনারই অঙ্গ ছিল তাঁর।

এর পর থেকে হুসেনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে বলে শোনা যায়, করাচির উপর থেকে তাঁর নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকে, তাঁর নিজের এবং দলের অর্থের জোগান ফুরোতে শুরু করে। যেনতেনপ্রকারেণ তিনি ব্রিটেনের বিচার এড়াতে চান।

এই প্রথমবার তিনি মোদীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন এমন নয়। ২০১৫ সালে ব্রিটেনে তাঁর সমস্যা বাড়তে থাকায় এবং করাচিতে পাক হানা তৃতীয় বর্ষে প্রবেশ করার পর তিনি মোহাজিরদের নিয়ে কথা বলার জন্য মোদীর কাছে আবেদন জানান। কিন্তু ভারত তাঁতে একবারের বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেনি, এবারও তার অন্যথা হবে বলে মনে হয় না।

PM Narendra Modi pakistan
Advertisment