কর্তারপুর করিডোর খুলে দেওয়া হয়েছে। ৫০০ ভারতীয় তীর্থযাত্রীর প্রথম জাঠা গুরদাসপুর থেকে পাকিস্তানের কর্তারপুরের গুরদোয়ারা দরবার সাহিব পর্যন্ত ৪.২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। শিখ ধর্মের কাছে কর্তারপুর পবিত্রতম কেন, কেন তার গুরুত্ব এত বেশি, একবার দেখে নেওয়া যাক।
তালওয়ান্দি থেকে কর্তারপুর: গুরুর পথ
গুরু নানক দেবের দীবনে কর্তারপুর অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। এখানেই রবি নদীর তীরে নিজের তৈরি করা সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন তিনি। গুরু নানক দেব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক জে এস গ্রেওয়াল বলেন, গুরু নানক এ শহরে এসেছিলেন ১৫২০ থেকে ১৫২২ সালের মধ্যে, এর পর তিনি সারা বিশ্বে পরিভ্রমণ করতে শুরু করেন।
জীবনের শুরুর দিনগুলো তালওয়ান্দিতে কাটিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানের লাহোরের ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে এ শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজ ভোই নামে এক উচ্চবিত্ত জমিদার। তাঁর জন্ম ১৪৬৯ সালে। রাজ রাই বংশধর রাই বুলার ভাট্টি এ শহরের নতুন নাম করণ করেন গুরু নানকের নামে। সে শহর এখন নানকানা সাহিব। এখন এ শহর আবার নানকানা সাহিব জেলার সদর।
পরবর্তী ১০ বছর গুরু নানক কাটান সুলতানপুর লোধিতে। এখানে তিনি বোধি অর্জন করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন কর্তারপুর এলে পৌঁছন, তখন তাঁর ঝুলিতে শাসক থেকে সাধারণ মানুষ, উপাসক থেকে চিন্তকদের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করার অভিজ্ঞতা। জানা যায় গুরু নানককে এক খণ্ড জমি দিতে চেয়েছিলেন এক পরগণার অধিকর্তা। সে অধিকর্তা আবার শুরুতে নানকের বিরুদ্ধে থাকলেও পরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
গুরু নানক এ স্থানের নাম দেন কর্তারপুর, সেথানেই তিনি তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী মাতা সুলখনি, দুই ছেলে শ্রী চাঁদ ও লক্ষ্মী চাঁদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। তাঁর এ জীবনযাপন দেখিয়ে দেয়, সন্ন্যাসী জীবনের থেকে তিনি বেশি পছন্দ করতেন গার্হস্থ্য জীবন।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: অযোধ্যা রায়ের আদ্যোপান্ত
গুরু নানকের মতে জীবনের লক্ষ্য
নানক বিশ্বাস করতেন মানবজীবনের চরম উদ্দেশ্য হল হয় বোধি প্রাপ্তি নয়ত ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন। কর্তারপুরেই তিনি তাঁর শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন অনুশীলনের মাধ্যমে কীভাবে মুক্তি অর্জন করতে হয়।
অধ্যাপক গ্রেওয়াল বলছেন, নানক কখনওই ত্যাগের জীবন পছন্দ করতেন না, বরং তিনি মনে করতেন মুক্তি পাওয়ার পর অতিরিক্ত দায়িত্ব বর্তায়, কারণ সে তখন বুঝতে পারে তার জীবন তার একার নয় অন্যদের ভালোমন্দের দায়িত্বও তার।
গুরুর দেখানো পথ
কর্তারপুরে গুরু নানক মুক্তির পথ হিসেবে যা বিশ্বাস করতেন, তারই অনুশীলন করেছেন। পুজো, কর্ম এবং সকলের সঙ্গে সহভাগ।
তিনি এবং তাঁর শিষ্যরা কর্তারপুরে চাষবাস করতেন, পশু চরাতেন। তাঁর জীবনপঞ্জি অনুসারে তিনি তাঁর পশু চরাতে নিয়ে যেতেন একটি কুয়োর কাছে, যে জায়গা এখন ডেরা বাবা নানক বলে পরিচিত। কর্তারপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ জায়গা থেকেই শুরু কর্তারপুর করিডোর।
নানকের বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরের নাম গান মুক্তির অন্যতম পথ। তিনি কর্তারপুরে ধর্মশাল (যেখানে ধর্মপ্রাপ্তি সম্ভব) তৈরি করেন, এখানে তিনি ও তাঁর অনুগামীরা প্রতিদিন সকাল সন্ধেয় নানকের লেখা গান গাইতেন।
অধ্যাপক গ্রেওয়াল বলেছেন, ২০০ বছর ধরে এসব জায়গাকে ধর্মশাল বলেই ডাকা হত। ১৮ শতাব্দীতে এগুলি গুরুদোয়ারা নামে পরিচিত হয়।
কর্তারপুরেই নানক লঙ্গর শুরু করেন, যেখানে তাদের সামাজিক পরিচিত কী সেকথা ভুলে গিয়ে সকলে একসঙ্গে মেঝেয় বসে খাবে।
আরও পড়ুন, অযোধ্যার বিতর্কিত জমির সবটাই কেন হিন্দুদের হাতে তুলে দিল সুপ্রিম কোর্ট?
শিখ পরিচিতির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য হল নিজের আগে সেবা- কর্তারপুরেই যে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন গুরু নানক। নানক বলেছেন, যে কোনও মানুষ, তার পরিবার, জাত, লিঙ্গ যাই হোক না কেন, সকলেই পূজা, কর্ম ও সহভাগের ভিত্তিতে মুক্তি পেতে পারে।
অধ্যাপক গ্রেওয়াল বলছেন, শিখ ধর্মের তিন গ- গুরদোয়ারা, গ্রন্থ এবং গুরু স্বয়ং-এর মিলন ঘটেছে কর্তারপুরে।
গুরু-শিষ্য পরম্পরা
কর্তারপুরেই নানক তাঁর উত্তরাধিকারী অঙ্গদ দেবকে মনোনীত করেন। এখানেই গুরু ও শিষ্যের অবস্থানবদলের কথাও বলেন তিনি। অধ্যাপক গ্রেওয়াল বলেন, অঙ্গদকে নিজের আসনে বসিয়ে পাঁচ মুদ্রা এবং একটি নারকোল দিয়ে তাঁকে প্রণাম করেন নানক।
তাঁর ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে, দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতে থাকেন তাঁকে দেখতে। দিওয়ালি ও বৈশাখীর সময়ে সে সংখ্যা হত সবচেয়ে বেশি।
কর্তারপুরেই ১৫৩৯ খ্রীষ্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গুরু নানক।
কর্তারপুর এবং ডেরা বাবা নানক
বাবা সুখদীপ সিং বেদী ছিলেন গুরু নানক দেবের সপ্তদশ উত্তরাধিকারী। তিনি জানিয়েছেন, গুরুর মৃত্যুর পর হিন্দু ও মুসলমান উভয় পক্ষই তাঁর দেহাবশেষের অধিকার চেয়েছিল। জন্মপঞ্জী অনুসারে, সাদা চাদর সরানোর পর সেখানে থিল শুধু ফল। সেই ফুলই তাঁরা ভাগাভাগি করে নেন।
বেদী বলেছেন চাদর ও ফুল দুইই ভাগাভাগি হয়েছিল। মুসলিমরা একটি মাজারে তা সমাধিস্থ করেন, হিন্দুরা একটি কলসপাতত্রের মধ্যে রেখে তা মাটির তলায় পুঁতে দেন। গুরদোয়ারা সাহিব এখনও সেখানেই রয়েছে এবং স্থানীয়রা সে মাজারে এখনও প্রার্থনা করেন।
কিন্তু কয়েকবছর পর এলাকায় যখন বন্যা হয় তখন গুরু নানকের পুত্র শ্রী চাঁদ মাটি খুঁড়ে কলস তুলে নিয়ে ডেরা বাবা নানকে নিয়ে য়ান এবং সেখানে গুরদোয়ারা নির্মাণ করেন। নানক যে কুয়োটি ব্যবহার করতেন, সেটিও গুরদোয়ারা চত্বরের মধ্যেই রয়েছে।
গুরু নানক জন্মবার্ষিকী
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নানকের শিষ্যরা তাঁর জন্মবার্ষিকীর দিনটিকে তাঁর বোধিপ্রাপ্তির দিন হিসেবে পালন করতে থাকেন, যদিও তাঁর জন্ম ১৪৬৯ সালের এপ্রিল মাসে।