৩০ বছর হল কাশ্মীরের সংখ্যালঘু হিন্দু পণ্ডিতরা ঘরছাড়া। ১৯৯০-এ জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে তাঁদের স্বভূমি থেকে চলে আসতে হয় তপ্ত বাতাবরণের মধ্যে। তাঁদের ঘরে ফেরার বিষয়টি নিয়ে ভারতে বছরের পর বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের চেষ্টা হয়ে চলেছে, যার ফলে উপত্যকতাতেও হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব বাড়ছে। বিজেপি যে সময়ে উত্তর ভারত জুড়ে সামনে আসছে, সে সময়েই কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘর ছাড়ার ঘটনা ঘটেছে, আর পরবর্তী বছরগুলিতে তা হয়ে উঠেছে হিন্দুত্বের ইস্যু।
১৯৯০-এর সে ঘটনার সময়ে কাশ্মীর ছিল উত্তপ্ত। শেখ আবদুল্লা ১৯৮২ সালে মারা গিয়েছেন, ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতৃত্ব গিয়েছে তাঁর পুত্র ফারুক আবদুল্লার কাছে। ফারুক ১৯৮৩ সালে ভোটে জেতেন। কিন্তু দু বছরের মধ্যেই কেন্দ্রের সঙ্গে ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিচ্ছেদ ঘটে, কেন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী পদে বহাল করে বিক্ষুব্ধ নেতা গুলাম মহম্মদ শাহকে। জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ)-এর সক্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯৮৪ সালে উগ্রপন্থী নেতা মকবুল ভাটের ফাঁসি উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধী সরকার বাবরি মসজিডের দরজা হিন্দুদের জন্য খুলে দেয়, যার জের পৌঁছয় কাশ্মীরেও।
কংগ্রেস নেতা মুফতি মহম্মদ সঈদের বিধানসবা এলাকা অনন্তনাগে হিন্দু মন্দিরের উপর আক্রমণ বাড়তে থাকে, আক্রান্ত হতে থাকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দোকান ও সম্পত্তি, অভিযোগের আঙুল ওঠে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দিকে। ১৯৮৬ সালে শাহ সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হতেই রাজীব গান্ধী ফের ফারুক আবদুল্লার উপর ভরসা করেন, তাঁকে আবার মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৭ সালের রিগিং হওয়া ভোটে জিতে ফারুক সরকার তৈরি করেন। এরপরেই জঙ্গিরা অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৯ সালে জেকেএলএফ মুফতি মহম্মদ সঈদের মেয়েকে অপহরণ করবার পর পরবর্তী দশকের মঞ্চ তৈরি করে দেয়।
ততদিনে পণ্ডিতদের টার্গেট করা শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর গুলিতে খুন হন উপত্যকার বিজেপি নেতা টিকা লাল টাপলু। মকবুল ভাটের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন যে বিচারপতি, নীলকণ্ঠ গাঞ্জু, তিনি ততদিনে অবসরপ্রাপ্ত। জম্মু কাশ্মীর হাইকোর্টের বাইরে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা ৪ নভেম্বর। সাংবাদিক-আইনজীবী প্রেম নাথ ভাট ২৭ ডিসেম্বর অনন্তনাগে খুন হন, গুলি করে মারা হয় তাঁকেও। পণ্ডিতদের হিট লিস্ট তখন জঙ্গি হাতে ঘুরছে। গোটা সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাসের আবহ। এরই মধ্যে একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হল একটি বার্তা, নামহীন। সেখানে পণ্ডিতদের উপত্যকা ছাড়তে বলা হল। অভিযোগ, এ বার্তা হিজবুল মুজাহিদিনের।
১৯ জানুয়ারি, ১৯৯০-এর রাত
১৯ জানুয়ারির রাতে আর কোনও আড়াল রইল না। ততদিনে ফারুক আবদুল্লা সরকারকে বরখাস্ত করে লাগু হয়েছে রাজ্যপালের শাসন। বেশ কিছু পরিচিত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রকাশিত বয়ান অনুসারে, মসজিদের লাউডস্পিকার থেকে ভেসে আসছিল হুমকি স্লোগান, রাস্তায় রাস্তায়ও একই পরিস্থিতি। পাকিস্তান ও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের গুণগান করে ভাষণ দেওয়া হচ্ছিল, সে ভাষণে বিরোধিতা করা হচ্ছিল হিন্দুত্বের।
কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায় এলাকা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০ জানুয়ারি, প্রথম একদল উপত্যকা ছাড়েন কোনওরকমে, হাতের কাছে যেটুকু জিনিসপত্র পান, তা গুছিয়ে নিয়ে, যে গাড়ি পান, তাতে চড়ে। দ্বিতীয় ও আরও বড় দেশছাড়ার স্রোত তৈরি হয় মার্চ ও এপ্রিল মাসে, বহু পণ্ডিতের হত্যার পর।
২১ জানুয়ারি, সিআরপিএফ ১৬০ জন কাশ্মীরি মুসলিম বিক্ষোভকারীকে গাওকাড়ল ব্রিজের কাছে গুলি করে মারে সিআরপিএফ বাহিনী। কাশ্মীরের ইতিহাসে এটি জঘন্যতম গণহত্যা বলে স্বীকৃত। পণ্ডিতদের পলায়ন ও গাওকাড়ল গণহত্যা ঘটেছিল ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে, কিন্তু এত বছর পরেও কোনও সম্প্রদায়ই অন্যের বেদনা উপলব্ধি করতে পারেনি।
কাশ্মীরি পণ্ডিত সংঘর্ষ সমিতি (কেপিএসএস)-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী. ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে ঘর ছেড়েছেন ৭৫,৩৪৩ কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবার, ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে আরও ৭০ হাজার। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। কেপিএসএস-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছেন ৩৯৯ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত, এর মধ্যে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডই ঘটেছে ১৯৮৯-৯০-এ। তিন দশক ধরে উপত্যকাতে রয়ে গিয়েছে ৮০০ পণ্ডিত পরিবার।
প্রশাসনের ভূমিকা
এই ঘর ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন রয়েছে যা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই, তা হল প্রশাসনের ভূমিকা, বিশেষ করে জম্মু কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যপাল জগমোহনের ভূমিকা।
সবেমাত্র পদে বহাল হয়ে তিনি শ্রীনগর পৌঁছন ওই ১৯ জানুয়ারিই। কাশ্মীরি মুসলিমদের বক্তব্য হল, পণ্ডিতদের ঘর ছাড়ার ব্যাপারে তিনি উৎসাহ দিয়েছিলেন, যার জেরে এতদিনের অ-ধর্মীয় কাশ্মীর ইস্যু সাম্প্রদায়িক মাত্রা পায়। কাশ্মীরি হিন্দুদের মতে, এ বক্তব্যে সার নেই। তাঁদের বিশ্বাস, যে কাশ্মীরি মুসলিমদের সঙ্গে তাঁরা কয়েক শতক ধরে একসঙ্গে বাস করে এসেছেন, তারাই ইসলামোন্মত্ত হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে পণ্ডিতদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করেন, যে পরিস্থিতির কথা কয়েক মাস আগেও ভাবা যেত না। অনেকের মতেই, সত্য এ দুয়ের মাঝামাঝি কিছু।
জম্মু কাশ্মীর সরকারের বরিষ্ঠ আধিকারিক ছিলেন ওয়াজাহাত আবদুল্লা। ১৯৯০ সালে অনন্তনাগে স্পেশাল কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের সিটিজেন-এ তিনি লিখেছেন, ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে কয়েকশ লোক তাঁর দফতরের সামনে জড়ো হয়ে প্রশ্ন করতে থাকে পণ্ডিতরা কেন চলে যাচ্ছেন এবং প্রশাসন তাঁদের চলে যেতে উৎসাহ দিচ্ছে বলে অভিযোগও করেন তাঁরা। তাঁদের অভিযোগ ছিল, "এর ফলে সেনাকে খোলা ছেড়ে দেওয়া হবে, যাতে তারা কাশ্মীরের সমস্ত অধিবাসীদের উপর ভারী হামলা চালাতে পারে।" হবিবুল্লা এ অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং বিক্ষোভকারীদের বলেন, প্রতিটি মসজিদ থেকে যখন হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং ওই সম্প্রদায়ের লোকজনকে যখন খুন করা হচ্ছে, তখন তাঁরা এখানে থাকবেন, এমন প্রত্যাশা করা যায় না। তিনি কাশ্মীরি মুসলিমদের বলেন, পণ্ডিতরা যাতে নিরাপদ বোধ করেন, তার ব্যবস্থা করতে।
হাবিবুল্লা লিখেছেন, তিনি জগমোহনকে আবেদন করেছিলেন, "যাতে তিনি পণ্ডিতদের কাশ্মীরে থাকার জন্য আবেদন সম্প্রচার করেন, অনন্তনাগের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার ভিত্তিতে তাঁদের সকলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত বলে জানান। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তেমন আবেদন করা হয়নি, কেবলমাত্র পণ্ডিতদের নিরাপত্তার সুনিশ্চিত করতে উপত্যকায় উদ্বাস্তু শিবির তৈরির কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল, যে পণ্ডিতরা বিপদ বোধ করছেন, তাঁরা উপত্যকা না ছেড়ে এই শিবিরে চলে আসতে পারেন। যেসব পণ্ডিতরা চাকরি করতেন, তাঁরা বিপদ বোধ করলে স্টেশন ছেড়ে যেতে পারেন, তাঁদের বেতন দেওয়া হতে থাকবে..."
অন্য লেখায় দেখানো হয়েছে কীভাবে সরকার পলায়নপর পণ্ডিতদের জন্য পরিবহণের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল, যাতে তাঁরা জম্মুতে চলে যেতে পারেন।
ফেরার প্রশ্ন
যে পণ্ডিতরা পালাচ্ছিলেন তাঁরা উপত্যকায় ফেরার কথা ভাবেননি। কিন্তু কাশ্মীর সম্পূর্ণ জঙ্গি চক্রে ঢুকে পড়বার পর, প্রত্যাবর্তন অসম্ভব না হলেও দূরতর হয়ে যাচ্ছিল। ১৯৯০-এর প্রথম কয়েক মাসে জম্মুতে পৌঁছেছিলেন প্রায় ১০ হাজার পণ্ডিত। এঁরা প্রায় সকলেই মধ্যবিত্ত। তাঁদের ঠাঁই হয়েছিল নোংরা শিবিরের তাঁবু গুলোতে, বাড়ি থেকে অনেক দূরে। যাঁদের ক্ষমতা ছিল তাঁরা দেশের অন্যত্র - দিল্লি, পুণে, মুম্বই ও আমেদাবাদে জায়গা করে নিচ্ছিলেন, যাচ্ছিলেন জয়পুর এ লখনউয়েও- কেউ কেউ বিদেশযাত্রা করছিলেন। জম্মুতে একটি দু কামরার টাউনশিপ বানানো হল, যার নাম জাগতি। সেথানে ভাড়া দিয়ে গত এক দশকে থেকে গিয়েছেন ৪ থেকে ৫ হাজার পণ্ডিত পরিবার। এর সঙ্গে জম্মুর কাছে পুখরু, মুথি ও নাগরোকোটায় সরকারি আবাদে ভাড়া দিয়ে থাকছেন কেউ কেউ। অনেকে নিজেরা বাড়ি বানিয়েছেন, বা উঠে গিয়েছেন অন্য ভাড়া বাড়িতে।
এত বছর পরেও উপত্যকায় ফেরার আকাঙ্ক্ষা তাঁদের চলে যায়নি, তবে তা এখন সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বেশি আইডিয়া এখন। একের পর এক সরকার এ ব্যাপারে তাঁদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু কাশ্মীর পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট, এ কেবল ইচ্ছামাত্র। পণ্ডিতদের কাশ্মীরে ফেরানোর সরকারি প্রয়াস হিসেবে দেখা গেছে এদিক এদিক জুড়ে ছড়ানো ঘেটোর মত কিছু কাঠামো, যে জায়গাগুলো কাঁটাতারে ভারী নিরাপত্তা দিয়ে ঘেরা, যা থেকে স্পষ্ট, স্বাভাবিক জীবন এখানে অসম্ভব। পণ্ডিতদের স্পষ্ট ধারণা উপত্যকা আর সেই তাঁদের ছেড়ে যাওয়া ১৯৯০-এর মত নেই। অনেকক্ষেত্রেই সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে অথবা তড়িঘড়ি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে কাশ্মীরি মুসলিমদের কাছে। অনেক সম্পত্তিরই ভগ্নদশা।
বিজেপি দাবি করে চলেছে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ফিরবেন, #হামওয়াপসজেয়েঙ্গে সোশাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে। কাশ্মীরি মুসলিমরাও চাইছেন পণ্ডিতরা ফিরুন, কিন্তু তাঁদের আলাদা ক্যাম্পে রাখার ভাবনা প্রত্যাখ্যান করছেন তাঁরা।
২০১৯ সালের ৫ অগাস্ট সরকার জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয়, তাতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন কাশ্মীরি পণ্ডিতরা। তাঁদের সঙ্গে ৩ দশক আগে যা ঘটেছে, তার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রতিশোধ হিসেবেই একে বরণ করে নিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু ফেরার ব্যাপারটা এখনও সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে।