Advertisment

কোভিড-১৯ ও কেরালার অভিবাসন সংকট

সম্প্রতি কুয়েত ঘোষণা করেছে, তারা নথিহীন কর্মীদের জরিমানা ছাড়া দেশ ছাড়ার সুবিধা দেবে। অন্য উপসাগরীয় দেশগুলিও নথিহীন কর্মীদের হাত থেকে ছাড়া পেতে চাইনে, ফলে তাঁদের অধিকাংশকেই ফিরতে হবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Covid-19, Kerala Migration

কেরালার অভিবাসীদের সবচেয়ে বৃহৎ গন্তব্যস্থল হল উপসাগরীয় অঞ্চল

লকডাউন উঠলে কেরালার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ শুরু হবে, যখন মধ্য প্রাচ্য থেকে কেরালাবাসীর একটা বড় অংশ ফিরবেন। কেরালার বহির্মুখী অভিবাসনের গুরুত্ব কেরালার অর্থনীতিতে কতটা জরুরি তার উপর যেমন নজর পড়ছে, তেমনই এর ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

Advertisment

 আগের ও এখনকার পরিস্থিতি

১৯৫৬ সালে কেরালা রাজ্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই কেরালার উন্নতির মূল বিন্দু থেকেছে অভিবাসন, অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী, দুইই। পুরনো ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন এলাকার পরিসংখ্যান থেকে ১৯৪১ থেকে এখানে মানুষ আসতে শুরু করেন। এই পরিস্থিতির নাটকীয় বদল হয় পরবর্তী কয়েক দশকে, যখন যত মানুষ আসতে থাকেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ চলে যেতে থাকেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত, কেরালাবাসীদের একটা বড় অংশ ভারতের মধ্যেই অন্যত্র, দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোরের মত বড় শহরে অভিবাসী হচ্ছিলেন।  তার একটা বড় কারণ ছিল দক্ষ ও শিক্ষিত মানুষের চাহিদা, যা কেরালা তার তুলনামূলক বেশি সাক্ষরতার হারের মাধ্যমে মেটাতে পারছিল।

কোভিড মৃত্যুতে আমেদাবাদ দু নম্বরে, মুম্বই শীর্ষে

১৯৭০-এর দশকগুলিতে তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপসাগরীয় অর্থনীতি বিদেশি কর্মীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়, এর পরেই কেরালা থেকে বিদেসে অভিবাসন হুহু করে বাড়তে থাকে। ভারতের সেন্সাস থেকে অপ্রত্যক্ষ হিসেবের মাধ্যমে অনুমান করা যাচ্ছে, ১৯৭১-৮১-তে এই সংখ্যাটা সবচেয়ে বাড়ে, পৌঁছয় আড়াই লাখে।

প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে ৮ ও ৯-এর দশকেও বহির্মুখী যাত্রা অব্যাহত থাকে। একইভাবে যেসব মালয়ালিরা প্রথমদিকে দেশের মধ্যেই অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন, তাঁরাও উপসাগর অঞ্চলে পাড়ি দিতে শুরু করেন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত, কেরালায় একটিই বিমানবন্দর ছিল। এখন, আন্তর্জাতিক অভিবাসনের গুরুত্ব এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চারে।

কেরালা অভিবাসন জরিপ

 এই পরিপ্রেক্ষিতেই সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের তরফ থেকে ১৯৯৮ সালে কে সি জাকারিয়া এবং আমি প্রথম কেরালা মাইগ্রেশন সার্ভে (KMS) করি। তার পর থেকে আমরা আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন, অভিবাসন করিডোর, কত অর্থ বাইরে যাচ্ছে, আর্থিক সুবিধা এবং সামাজিক খরচের বিষয়ে নজর রেখে আসছি। এ পর্যন্ত আমরা ৮টি রাউন্ড সম্পূর্ণ করেছি, সাম্প্রতিকতমটা ২০১৮-তে। একবার দেখা যাক বিভিন্ন সার্ভে থেকে কী তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

কোভিড ১৯ আর লকডাউনে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সর্বনাশ

প্রথমবারের গবেষণায় ১৯৯৮ সালে দেখা গিয়েছিল প্রায় ১৫ লক্ষ কেরালার মানুষ ভারতের বাইরে থাকেন, ৭৫০০০০ প্রাক্তন অভিবাসী কেরালায় ফিরে এসেছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে সার্ভেতে দেখা গিয়েছে তাঁরা মূলত জমানো অর্থ, কাজের অভিজ্ঞতা এবং বিদেশ থেকে নিয়ে আসা কর্মদক্ষতার উপর নির্ভর করে জীবন কাটান।

দশ লক্ষেরও বেশি পরিবার নির্ভর করে থাকেন আভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের রোজগারের উপর, শিশুশিক্ষার এবং অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে। আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ত্রিশূর-মালাপ্পুরম এলাকার মুসলিমরাই প্রবাসের অন্যতম ভিত্তি, শিক্ষার দিক থেকে অগ্রগণ্য পূর্বতন ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন রাজ্যের এজাহাওয়া, নায়ার এবং সিরিয়ার খ্রিস্টানরা আভ্যন্তরীণ অভিবাসনের শিরদাঁড়া।

প্রবাসের জেরে ফিরে আসার ঘটনাও ঘটেছে। কেরালায় প্রতি অভিবাসনের ভয়ংকর ধাক্কা দেখা গিয়েছে অন্তত তিনটি সময়ে- উপসাগরীয় যুদ্ধ, বিশ্বজনীন আর্থিক সংকট এবং সৌদি আরবের নিয়াকত নীতি। আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি কেরালার অভিবাসীরা তিনটি ক্ষেত্রেই তৎপরতা দেখিয়েছেন। যেমন উপসাগরে বিশ্ব সংকট দেখা দেবার সময়ে সরকার আশঙ্কা করেছিল ব্যাপক সংখ্যক মানুষ পিরে আসবেন, কিন্তু ২০০৯ সালে মাত্র ৫০ হাজার মানুষ ফিরেছিলেন।

কোভিড ১৯ মোকাবিলা- কেরালার রাস্তা

২০১৮ সালের KMS পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। কেরালা থেকে সারা পৃথিবীতে ২.১২ মিলিয়ন মানুষ অভিবাসী। যা ২০১৬ সালের KMS-এর হিসেবের থেকে ১৪৯ হাজার কম, এবং ২০১৩ সালের ওই হিসেব থেকে ২৭৮ হাজার কম। সব মিলিয়ে পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে ২০০৮ সাল থেকে অভিবাসনের সংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে থেকেছে।

তবে একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে কয়েকটি বছরে, বিশেষ করে ২০১১ ও ২০১৩ সালে ২০০৮-১১-র তুলনায় বেশি মানুষ অভিবাসী হয়েছেন।

কেরালার অভিবাসীদের সবচেয়ে বৃহৎ গন্তব্যস্থল হল উপসাগরীয় অঞ্চল। প্রথম থেকেই সংযুক্ত আরব আমিরশাহী কেরালাবাসীর পছন্দের গন্তব্য। ১.৮৯ মিলিয়ন অভিবাসী উপসাগরীয় দেশগুলিতে বাস করেন। ২০১৮ সালের KMS সার্ভের পর কেরালায় বন্যা হয়েছে এবং আমাদের ধারণা এতে অভিবাসন বাড়বে, কারণ বাড়ি তৈরিতে অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে।

২০২০ সালের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, কাতার, বাহরিন, ওমান ও কুয়েতে কেরালার অভিবাসীর সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ লাখের মধ্যে পৌঁছতে পারে বলে ধারণা। আমাদের হিসেবে উপসাগরীয় অঞ্চলের অভিবাসীদের এক চতুর্থাংশ কেরালার বাসিন্দা।

কোভিড-১৯ পরবর্তী অভিবাসন

উপসাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসন ও প্রতি অভিবাসনের কী হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে আমার ধারণা এখন কেরালায় ১ লক্ষের বেশি প্রতি অভিবাসী রয়েছেন যাঁরা বিমানবন্দর বন্ধ থাকায় ফিরতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, ৩০ হাজার নয়া অভিবাসী ভিসা না পাওয়ায় যেতে পারছেন না। তৃতীয়ত ভ্রমণ শুরু হলে, মে ২০২০-র মধ্যে অনেক অভিবাসীই ফিরে আসবেন, যাঁদের অধিকাংশই নির্ভরশীল।

উপসাগরীয় দেশগুলিতে কোভিড সংকটের ফল দেখতে শুরু করেছে, তেলের দাম সর্বনিম্ন। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপক পরিমাণ কাজ হারানোর সম্ভাবনা। ফলে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরও এক লক্ষ মানুষ ফিরতে পারেন।

আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনও সময়ে অন্তত ১০ শতাংশ কেরালার অভিবাসী বা ২ লক্ষ কাগজপত্রহীন ভাবে কাজ করছেন। সম্প্রতি কুয়েত ঘোষণা করেছে, তারা নথিহীন কর্মীদের জরিমানা ছাড়া দেশ ছাড়ার সুবিধা দেবে।

অন্য উপসাগরীয় দেশগুলিও নথিহীন কর্মীদের হাত থেকে ছাড়া পেতে চাইনে, ফলে তাঁদের অধিকাংশকেই ফিরতে হবে। ফলে আরও তিন লক্ষ পরিযায়ী উপসাগর থেকে ফিরবেন। এব্যাপারটা কেরালা সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

(লেখক কেরালার সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টাল স্টাডিজের অধ্যাপক এবং কোভিড-১৯ সম্পর্কিত কেরালা সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

kerala COVID-19
Advertisment