Advertisment

কেরালার সোনা পাচার, কূটনৈতিক কার্গো ও এক পলাতক মহিলা

স্বপ্না ঘোরাফেরা করতেন সামাজিক, রাজনৈতিক ও আমলা মহলে, মাঝে মাঝে নিজেকে ডিপ্লোম্যাট হিসেবে পরিচয়ও দিতেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Kerala Gold Smuggling

এম শিবশঙ্কর, স্বপ্না সুরেশ

গত রবিবার তিরুবনন্তপুরমে এক কূটনৈতিক কার্গো বিমান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির কনসুলেট জেনারেলের দফতরের উদ্দেশে পাঠানো ৩০ কিলোগ্রাম চোরাই সোনা আটক হয়েছে। এ ঘটনায় কেরালায় ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোনা পাচার দৈনন্দিন ঘটনা।

Advertisment

কিন্তু এ ঘটনা সাড়া ফেলেছে অন্য কারণে। ১৫ কোটি টাকা মূল্যের এই সোনা পাওয়া গিয়েছে কূটনৈতিক কার্গো বিমানে, যাতে নিয়মিত শুল্ক বিভাগীয় পরীক্ষা হয় না। এর পিছনের চক্র এবং তাদের সঙ্গে বরিষ্ঠ সরকারি আধিকারিকদের যোগাযোগের যে অভিযোগ তার জেরেই এই গোটা পর্ব আরও কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।

মঙ্গলবার কেরালার মুখ্যমন্ত্রী প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির পদ থেকে এম শিবশঙ্করকে সরিয়ে দিয়েছেন। তার আগে এই আইএএশ অফিসারের সঙ্গে পাচার চক্রের মাথা স্বপ্না সুরেশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টি সামনে আসে। স্বপ্না আগে সংযু্ক্ত আরব আমিরশাহির কনসুলেট জেনারেলের দফতরে একজিকিউটিভ সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতেন।

কূটনৈতিক কার্গোয় সোনা

এই সোনা দুবাই থেকে ডিপ্লোম্যাটিক কার্গো বিমানে গত সপ্তাহে তিরুবনন্তপুরম এসে পৌঁছয়। আইন অনুসারে ডিপ্লোম্যাটিক কার্গো বিমানে নিয়মমাফিক কাস্টমস চেকিং হয় না এবং যত দ্রুত সম্ভব তা ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দেওয়া হয়। ওই কার্গোয় শরিয়ার আল জাতর স্পাইসেস থেকে বাথরুম ফিটিং, নুডলস, বিস্কুট ও খেজুর পাঠানোর কথা বলা ছিল। কিন্তু শুল্ক বিভাগের কাছে খবর ছিল এসবের আড়ালে সোনা আসছেে।

তিরুবনন্তপুরমের কনসুলেট জেনারেলের দফতরে আগে জনসংযোগ আধিকারিকের চাকরি করতেন সরিত কুমার। তিনি ওই কার্গো নিতে পৌঁছন, ভাব করেন যেন তিনি এখনও সেখানেই চাকরি করেন। কনসুলেট থেকে তার আগেই কাস্টমস বিভাগকে জানানো হয়েছিল সরিতকে এক বছর আগেই চাকরি থেকে সরিয়ে দেওযা হয়েছে এবং কূটনৈতিক কার্গো ক্লিয়ারেন্সের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়নি। কাস্টমস সিদ্ধান্ত নেয় কার্গো ছাড়া হবে না, এবং স্থির করে কার্গো খোলা হবে কনসুলেটের আধিকারিকদের উপস্থিতিতে, যা যে কোনও কার্গো পরীক্ষার সময়ের শর্ত।

গ্রেফতার

শুল্ক দফতর সরিত কুমারকে গ্রেফতার করে, যিনি ২০১৬ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত কনসুলেটে কাজ করতেন। এর আগে সরিত দুবাইয়ে কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনালে অ্যাসেট অফিসার হিসেবে কাজ করতেন। ১২ বছর আগে সামান্য কিছুদিন তিনি ফিউচার গ্রুপ ইন্ডিয়াতেও কাজ করেছেন।

স্বপ্না সুরেশ কে?

সরিত এই দুষ্কর্মের সহযোগী হিসেবে স্বপ্না সুরেশের নাম জানায়। স্বপ্না সাত মাস আগে পর্যন্ত তিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত সংযুক্ত আরব আমিরশাহি দূতাবাসে একজিকিউটিভ সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ডিপ্লোম্যাটিক কার্গো খোলার ব্যাপারে শুল্ক বিভাগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার একদিন আগে তিনি পালিয়ে যান।

স্বপ্নাও দুবাইয়ে থাকতেন। সেখানে তাঁর বাবার ব্যবসা ছিল। তাঁর ঘোরাফেরা ছিল অভিজাত মহলে। ২০১৩ সালে তিনি তিরুবনন্তপুরমের বিমানবন্দর পরিষেবা সংস্থা AISATS-এ মানব সম্পদ দফতরে কাজে যোগ দেন। পরে জানা গিয়েছে তিনি ও আরেকজন বরিষ্ঠ আধিকারিক মিলে একজন বিমানবন্দর কর্মীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার ভুয়ো অভিযোগ করেন।

তিনি মোট ১৭টি অভিযোগ করেন, বিভিন্ন ভুয়ো নামে। সবকটি অভিযোগই একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছিল। ওই ব্যক্তি পরে এই ষড়যন্ত্রের তদন্তের জন্য রাজ্য পুলিশের দ্বারস্থ হন। স্বপ্নাকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তবে তদন্ত চলেনি - অভিযোগ এ ব্যাপারেও প্রভাব খাটাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।

২০১৬ সালে তিরুবনন্তপুরমে কনসুলেট জেনারেলের দফতর খোলার পর স্বপ্না সেখানে যোগ দেন। আমিরশাহিতে তাঁর পরিচিতি ও আরবি ভাষায় তিনি সড়গড় হওয়া এ ব্যাপারে কাজে দেয়। কেরালা সরকারের সঙ্গে আমিরশাহির সুসম্পর্ক রয়েছে, ফলে দূতাবাসের স্থানীয় কর্মী হিসেবে স্বপ্না গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।

স্বপ্না ঘোরাফেরা করতেন সামাজিক, রাজনৈতিক ও আমলা মহলে, মাঝে মাঝে নিজেকে ডিপ্লোম্যাট হিসেবে পরিচয়ও দিতেন। ২০১৭ সালে শারজার শাসক যখন কেরালায় চারদিনের সরকারি সফরে আসেন, তখন স্বপ্না অন্য অতিথিদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করেন এবং বেশ কিছু সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

বছর খানেক আগে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার জন্য তাঁকে কনসুলেট জেনারেলের দফতর থেকে বরখাস্ত করা হয়। সরিতকেও ওই সময়েই বরখাস্ত করা হয়।

তবে নিজের যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে স্বপ্না কেরালা স্টেট ইনফর্মেশন টেকনলজি ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজারের কাজ পান। সে সময়ে সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন বরিষ্ঠ আইএএস অফিসার ও তথ্য প্রযুক্তি সচিব এম শিবশঙ্কর। শিবশঙ্কর সে সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান সচিব ছিলেন, যা মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ।

পাচার কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর জানা যায় শিবশঙ্কর আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্ট প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্সের মাধ্যমে কেরালা স্টেট ইনফর্মেশন টেকনলজি ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের ম্যানেজার পদের জন্য স্বপ্নার নাম সুপারিশ করেন। কেরালা স্টেট ইনফর্মেশন টেকনলজি ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড-কৎ আধিকারিকদের দাবি স্নাতক হিসেবে স্বপ্না ওই পদের যোগ্য ছিলেন। তবে স্বপ্নার বিদেশে বসবাসকারী ভাই জানিয়েছেন তিনি স্কুলের পরীক্ষাও পাশ করেননি। এক ট্রাভেল এজেন্সিতে স্বপ্নার প্রাক্তন সহকর্মীও তাঁর যোগ্যতান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, তিনি টুয়েলভ পাশ করেছেন।

তদন্ত

শুল্ক বিভাগ এখন এই পাচার চক্রে আর কারা যুক্ত রয়েছে সে ব্যাপারে তদন্ত করছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে কনসুলেট জেনারেলের দফতরের অন্য কোনও কর্মী এ ব্যাপারে যুক্ত কিনা। এখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র সরিতকেই গ্রেফতার করা হয়েছে, পলাতক স্বপ্নার খোঁজ চলছে।

শুল্ক আধিকারিকরা বলছেন, তাঁদের সন্দেহ মধ্যপ্রাচ্যে একটি ধুরন্ধর পাচার চক্র এ ঘটনার পিছনে থাকতে পারে। বরিষ্ঠ এক আধিকারিক বলেছেন, অতীতে দেখা গিয়েছে সোনা চোরাচালানের ব্যাপারে পাচার চক্র সবসময়েই একটাই। তারা বিভিন্ন লোকজনের সাহায্যে নানা রকম অদ্ভুত উপায়ে সোনা লুকিয়ে পাচার করে। আমার তাদের মিশন সফল হয়ে যাওয়ার পর সে ব্যাপারে জানতে পারি। এই চক্র অন্য উপায় কাজে লাগাবে।

kerala
Advertisment