পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর আর উত্তর আন্দামান সাগরে তৈরি নিম্নচাপ ঘনীভূত হয়ে পরিণত সুপার সাইক্লোন ইয়াসে। আবহবিদদের মত, ‘একটা গভীর নিম্নচাপ যতক্ষণ সমুদ্রপৃষ্ঠে থাকবে, ততক্ষণ সেই শক্তি সঞ্চয় করবে।‘ এভাবেই নিম্নচাপ শক্তি সঞ্চয় করে আরও ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়। আম্ফান-আয়লার মতো ক্রমে এগোতে থাকে বাংলার দিকে।ল্যান্ডফলের বিপত্তি আন্দাজ করে প্রমাদ গোনা শুরু করে নবান্ন।
কিন্তু কোনও এক ‘মিরাক্যালে’ সেই ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখ ঘোরে ওড়িশার দিকে। হঠাৎই সাগরদ্বীপের বদলে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সে বাঁক নিয়ে এগোতে থাকে ওড়িশার বালাসোর আর ধামারা বন্দরের দিকে। আবহবিদেরা বলছেন, ঠিক যেভাবে হঠাৎ বাঁক খেত রবার্তো কার্লোসের ফ্রি-কিক।সেভাবেই মাঝসমুদ্রে বেঁকে গিয়ে বুধবার সকালে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পূর্ণ শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ে ওড়িশার ধামারা বন্দরে। সে সময় ইয়াসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৫-১৬০ কিমি। সেই মিরাক্যালের জেরেই এবার ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থেকে রেহাই পায় কলকাতা, হাওড়া,হুগলী এবং দুই ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা।
এখন প্রশ্ন উঠছে কী সেই মিরাক্যাল। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জিসি দেবনাথ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ-মায়ানমার উপকূলে থাকা উচ্চচাপ বলয়ের বায়ুপ্রবাহ ধাক্কা মেরে ইয়াসের অভিমুখ বদলেছে। ফলে ঝড়ো হাওয়া আর ভারি বৃষ্টিপাত বাদে সেভাবে ইয়াস প্রভাব পড়েনি কলকাতায়।‘ যদিও নবান্ন সূত্রে খবর, প্রায় ভেসে গিয়েছে ফ্রেজারগঞ্জ, গোসাবা, ক্যানিং, হিঙ্গলগঞ্জের নদী তীরবর্তী এলাকা। বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে কিংবা নদী ছাপিয়ে জল ঢুকে এই বিপত্তি।
কথা প্রসঙ্গে জানা গিয়েছে, ঠিক এদিনেই ১২ বছর আগে সাগরদ্বীপে আছড়ে পড়েছিল আয়লা। যার ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ গ্রাম। সেবার বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়ে সোজা ছুটে এসে সাগরদ্বীপে ল্যান্ডফল করে বাংলার বিপত্তি বাড়িয়েছিল ওই ঘূর্ণিঝড়।
এমনকি, গত বছর মে মাসে তৈরি হওয়া আম্ফানের অভিমুখ ছিল উত্তর-পশ্চিমমুখী। কিন্তু মায়ানামার উপকূলের একই উচ্চচাপ বলয়ের বায়ু তাকে ঠেলে বঙ্গ উপকূলমুখী করে দেয়। এমনটাই জানান গোকুলবাবু। হাওয়া অফিস জানিয়েছে, আম্ফান দীঘায় ল্যান্ডফল হওয়ায় তার প্রভাব টের পায় কলকাতা-সহ পার্শ্ববর্তী জেলা।
ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি প্রসঙ্গে গোকুলবাবু বলেছেন, ‘বায়ুমণ্ডলের ৫ ধরণের ফোর্সের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখ নিয়ন্ত্রিত হয়। ৫টি বলের মিলিত প্রভাবকে বলা হয় স্টিয়ারিং ফোর্স। এই ৫টি বলের অন্যতম দুটি কারণ উচ্চচাপ এবং পৃথিবীর আবর্তজনিত বল। যাকে আবহবিদদের ভাষায় কোরিয়োলিস ফোর্স বলে। এই বেগ বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন একাধিক ঘূর্ণিঝড়কে উত্তর-পশ্চিমমুখী করে তোলে। এই বাঁক নিয়ে সে কোনদিকে যাবে তা স্থির হয় উচ্চচাপের মতিগতির ওপর। মায়ানমার উপকূলে তৈরি হওয়া এই উচ্চচাপের বায়ু গতি পশ্চিমমুখী ছিল। ফলে ইয়াসকে আরও ঠেলে উত্তর-পশ্চিমমুখী করে তোলে।‘ যার জেরে এ যাত্রায় ঘূর্ণিতাণ্ডব রক্ষা পেয়েছে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলা। এমনটাই মন করছেন আবহবিদরা।