Advertisment

উন্নাও কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত সেঙ্গার, এক নজরে মামলার গতিপ্রকৃতি

২০১৮ সালেরই ৮ এপ্রিল এক যুবতী, যাঁকে পরবর্তীকালে "উন্নাওয়ের নির্যাতিতা" বলেই অভিহিত করা হয়ে এসেছে, লখনৌয়ে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাসভবনের সামনে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kuldeep singh sengar

কুলদীপ সেঙ্গার। ফাইল ছবি

আজ, সোমবার, উত্তর প্রদেশের উন্নাওয়ে ২০১৭ সালে এক নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারকে দোষী সাব্যস্ত করেছে দিল্লির এক আদালত। শাস্তির পরিমাণ ধার্য করা হবে ১৮ ডিসেম্বর। উন্নাও জেলার বাঙ্গারমাউ কেন্দ্রের বিধায়ক সেঙ্গার গ্রেফতার হন ১৩ এপ্রিল, ২০১৮ সালে। তদবধি জেলেই রয়েছেন তিনি। দেশজোড়া বিক্ষোভ এবং সংসদে তীব্র প্রতিবাদের চাপে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় বিজেপি।

Advertisment

প্রথম অভিযোগ

২০১৮ সালেরই ৮ এপ্রিল এক যুবতী, যাঁকে পরবর্তীকালে "উন্নাওয়ের নির্যাতিতা" বলেই অভিহিত করা হয়ে এসেছে, লখনৌয়ে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাসভবনের সামনে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর দাবি ছিল, বিধায়কের বিরুদ্ধে তিনি যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করলেও কোনও পদক্ষেপ নেয় নি পুলিশ।

ওই যুবতী এবং তাঁর মা ও দিদিমা সমেত পরিবারের আটজন সদস্যকে গৌতম পল্লী থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সাংবাদিকদের ওই যুবতী জানান যে সেঙ্গার নিজের বাড়িতে ২০১৭ সালের জুন মাসে তাঁকে যৌন নিগ্রহ করেন, এবং তাঁর পরিবারকে হুমকিও দেওয়া হয়।

উন্নাও পুলিশের বক্তব্য, যুবতীর পরিবার অভিযোগ জানায় যে ১১ জুন, ২০১৭-য় যুবতীকে অপহরণ করে তাঁর গ্রামেরই দুই যুবক, এবং ওই দুজনের বিরুদ্ধে ২০ জুন মামলা দায়ের করা হয়। যুবতীর বয়ানের ভিত্তিতে গণধর্ষণ এবং পকসো (POCSO) আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। আরও অভিযোগ, ঘটনার সময় যুবতীর বয়স ছিল ১৭ বছর।

সংশ্লিষ্ট থানার ওসি সেসময় জানিয়েছিলেন, যুবতীর পরিবারের সন্দেহ যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করছেন বিধায়ক সেঙ্গার। ওসি-র কথা অনুযায়ী, এই সন্দেহের বশে যুবতীর পরিবার এরপর অভিযোগ করেন যে ৪ জুন, ২০১৭-য় অভিযুক্তদের একজনের মা যুবতীকে সেঙ্গারের বাড়িতে নিয়ে যান, যেখানে যৌন নির্যাতনের শিকার হন যুবতী। পুলিশ আরও দাবি করে যে যুবতীর বাবা এবং কাকা দাগি আসামী - বাবার বিরুদ্ধে খুন, ডাকাতি ইত্যাদি মিলিয়ে ২৮টি মামলা রয়েছে, এবং কাকার বিরুদ্ধে রয়েছে ১৫টি মামলা, সেই ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে।

পরবর্তীকালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যুবতী বলেন যে বিধায়ক সেঙ্গার তাঁদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন, এবং তিনি ও তাঁর ভাইবোনেরা বিধায়ককে "ভাইয়া" সম্বোধন করতেন। এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় ১৩ এপ্রিল, ২০১৮-য়, যেখানে যুবতী বলেন, "আমাকে একটি ঘরে যেতে বলা হয়, যেখানে তিনি আমাকে ধর্ষণ করেন। পরে আমায় বলা হয়, আমি মুখ খুললে আমার বাবা এবং পরিবারকে মেরে ফেলা হবে। আমি কাউকে কিছু বলি নি, যতদিন না ওঁর কিছু লোক ১১ জুন আমাকে অপহরণ করে। আমাকে কিছুদিন ধরে গণধর্ষণ করার পর একজনের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়, কিন্তু পরে আমি উদ্ধার হই।"

সেঙ্গার তাঁর বিরুদ্ধে সবরকম অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি ছিল, তাঁর বিরুদ্ধে কাজ করছে কিছু দাগি আসামী, যেহেতু তিনি কয়েকজন "নির্দোষ যুবককে" মিথ্যে মামলা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।

যুবতীর বাবার মৃত্যু

লখনৌয়ে নিজের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনার একদিন পর, অর্থাৎ ৯ এপ্রিল, ২০১৮-ইয় উন্নাও জেলে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে মৃত্যু হয় যুবতীর বাবার। বলা হয়, তার ছয়দিন আগে বিধায়কের সমর্থকদের হাতে নৃশংসভাবে আক্রান্ত হন তিনি, এবং সেই আঘাতের ফলেই তাঁর মৃত্যু হয়। বিনীত, বাউয়া, শৈলু এবং সোনু নামে চার সেঙ্গার সমর্থকের নামে ৩ এপ্রিল এফআইআর দায়ের করে যুবতীর পরিবার।

অভিযুক্তরাও এফআইআর করেছিল যুবতীর বাবার বিরুদ্ধে, যাঁর নামে অস্ত্র আইন এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির আওতায় মামলা দায়ের করা হয়। পরিবারের দাবি ছিল, যুবতীর বাবাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন বিধায়ক এবং তাঁর সমর্থকরা।

পরে জানা যায় যে আক্রমণের দিনই গ্রেফতার করা হয় যুবতীর বাবাকে, অথচ জেলে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি বিধায়কের ওই চারজন সমর্থককে।

ঘটনার জেরে বরখাস্ত হন ছ'জন পুলিশকর্মী, এবং ১০ এপ্রিল, ২০১৮ সালে গ্রেফতার হন বিধায়কের ভাই অতুল সিং। ময়নাতদন্তের পর জানা যায়, যুবতীর বাবার দেহে ছিল ১৪টি আঘাতের চিহ্ন, এবং মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখানো হয় সেপ্টিসিমিয়া, অর্থাৎ রক্তে বিষক্রিয়া।

তথাকথিত ধর্ষণের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ১১ এপ্রিল, ২০১৮ সালে গঠিত হয় বিশেষ তদন্তকারী দল বা স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট)।

ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে আসে একটি ভিডিও, যাতে দেখা যায়, পুলিশের সামনেই তাঁকে মেরেছেন বিধায়কের ভাই, এই অভিযোগ করছেন যুবতীর বাবা। সেদিনই সেঙ্গারের স্ত্রী সঙ্গীতা উত্তর প্রদেশের ডিজিপি-র সঙ্গে দেখা করে স্বামীর হয়ে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গীতা জানান, তাঁর স্বামী রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার।

সিবিআই তদন্ত

২০১৮-র ১২ এপ্রিল, ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় এবং পকসো আইনে সেঙ্গারের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে পুলিশ। সেই দিনই, এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে মামলার তদন্তভার চলে যায় সিবিআই-এর কাছে।

পরের দিন, ১৩ এপ্রিল, সিবিআই আদালতের নির্দেশ মেনে সেঙ্গারকে গ্রেফতার করে।

আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে, 'আইন শৃঙ্খলার ব্যবস্থা সরাসরি প্রভাবিত ছিল সেঙ্গারের দ্বারা'। ১৪ এপ্রিল সিবিআই শশী সিংকে গ্রেফতার করে। শশীই সেই মহিলা, যিনি নির্যাতিতাকে ফুসলে ২০১৭-র ৪ জুন সেঙ্গারের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন।

২০১৮-র মে মাসে সিবিআই সেঙ্গার এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে নির্যাতিতার বাবাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর চক্রান্ত করার অভিযোগ আনে। গ্রেফতার হন দুই পুলিশকর্মীও। নির্যাতিতা হাইকোর্টে নিজের আতঙ্কের কথা জানানোর পর সেঙ্গার এবং শশীকে উন্নাও থেকে সরিয়ে সীতাপুর জেলে পাঠানো হয়।

৭ জুলাই নির্যাতিতার বাবার মৃত্যুর দায়ে প্রথম চার্জশিট পেশ করে সিবিআই, সেঙ্গারের ভাই অতুল সিং এবং আরও চারজনের বিরুদ্ধে। চার্জশিট অনুযায়ী, নির্যাতিতার বাবা ৩ এপ্রিল দিল্লি এসেছিলেন ধর্ষণের মামলার শুনানিতে উপস্থিত থাকতে। সন্ধ্যেবেলা তাঁকে নির্মমভাবে নিজের বাড়ির সামনে পেটায় অভিযুক্ত ও তার সঙ্গীরা, চার্জশিটে জানায় সিবিআই।

১১ জুলাই, লখনৌয়ের বিশেষ আদালতে সিবিআই আরেকটি চার্জশিট পেশ করে। সেঙ্গারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। শশী সিংয়ের বিরুদ্ধে আনা হয় সেঙ্গারকে সহায়তার অভিযোগ। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০ বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্ৰ), ৩৬৩ (অপহরণ), ৩৬৬ (জোর করে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে অপহরণ), ৩৭৬ (ধর্ষণ), ৫০৬ (অপরাধমূলক ভীতিপ্রদর্শন) ধারায় এবং পকসো আইনে অভিযুক্ত করা হয় দু'জনকে।

১৪ জুলাই, সেঙ্গার এবং আরও ন'জনের বিরুদ্ধে তৃতীয় চার্জশিট দাখিল করা হয়, চক্রান্ত করে নির্যাতিতার বাবাকে অস্ত্র আইনে ফাঁসানোর অভিযোগে।

নির্যাতিতার পরিবারের বিরূদ্ধে মামলা

সিবিআই-এর চার্জশিটের পাঁচ মাস পরে, মাখি থানায় নির্যাতিতা, তাঁর মা এবং কাকার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ, নির্যাতিতার নাবালিকা হওয়ার যে নথি পুলিশকে দেওয়া হয়েছিল, তা জাল।

শশীর স্বামী হরপাল সিংয়ের অভিযোগে স্থানীয় আদালতের নির্দেশানুসারে এফআইআর রুজু হয়।

১৯ জুলাই নির্যাতিতার কাকা একটি উনিশ বছরের পুরনো মামলায় খুনের চেষ্টার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন। জেলা আদালতের দ্বারা দণ্ডিত হন দশ বছরের কারাবাসে। তাৎপর্যের এই, ২০০০ সালে জুন মাসে উন্নাও-এর পঞ্চায়েত ভোটের সময়ের এই মামলায় অভিযোগকারী ছিলেন সেঙ্গারের ভাই অতুল সিং।

উন্নাও-এর আদালতের সরকারি কৌঁসুলি রামজীবন যাদবের বক্তব্য অনুযায়ী, অতুল এফআইআর-এ অভিযোগ করেছিলেন, নির্বাচনের সময় যখন তিনি ভোট দিচ্ছিলেন, মহিলার বাবা এবং দুই কাকা স্থানীয় মানুষকে 'ভয়' দেখাচ্ছিলেন নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য।

রামজীবনের কথায়, "অতুল যখন প্রতিবাদ করেন, ওঁরা তিনজন অতুলকে গালাগালি দিতে শুরু করেন। অতুল কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। বাড়ি ফিরে আসছিলেন। বাড়ির কাছাকাছি আসার পর অতুল দেখেন, তিন ভাই তাঁর পিছুপিছু এসেছেন। ওঁরা অতুলকে লক্ষ্য করে গুলি চালান, কিন্তু অতুল কোনভাবে পালিয়ে বাঁচেন।"

রহস্যে আবৃত দুর্ঘটনা

এ বছরের ২৮ জুলাই এক রহস্যময় দুর্ঘটনা ঘটে। নির্যাতিতা একটি গাড়িতে করে রায় বেরিলি জেলে যাচ্ছিলেন, যেখানে তাঁর কাকা কারাবাস করছেন।সঙ্গে নির্যাতিতার দুই কাকিমা ছাড়াও ছিলেন তাঁর আইনজীবী। যিনি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। পথে একটি ট্রাকের সঙ্গে গাড়িটির সংঘর্ষ হয়। নির্যাতিতা এবং তাঁর আইনজীবী গুরুতর আহত হন। দুই কাকিমা প্রাণ হারান।

নির্যাতিতার এক কাকা সেঙ্গারকে হাইওয়ের ওই 'দুর্ঘটনা'-র জন্য দায়ী করে অভিযোগ করার পর পুলিশ খুনের দায়ে সেঙ্গারের বিরুদ্ধে এফআইআর রুজু করে। তদন্তের ভার পরবর্তীকালে ন্যস্ত হয় সিবিআই-এর উপর।

১১ অক্টোবর, সিবিআই চার্জশিট জমা দেয়। যাতে সেঙ্গার এবং তাঁর এক সহযোগীর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং ধর্ষিতা ও তাঁর পরিবারকে ভয় দেখানোর অভিযোগ আনা হয়। খুন এবং খুনের চেষ্টার ধারাগুলি অবশ্য চার্জশিট থেকে বাদ পড়ে।

Unnao
Advertisment